নূরে আলম জিকু: নিশি হবে ভোর!

এহসানুল করিম
Published : 26 Oct 2012, 02:44 PM
Updated : 26 Oct 2012, 02:44 PM

১.
আমরা স্মৃতিভূক জাতি। ভুলে যাওয়াতেই আমাদের আনন্দ। ভুলে থাকাতেই আমাদের নির্বাণ। আর সবকিছুর মতই আমরা খুব সহজে ভুলে যাই আমাদের সূর্য সন্তানদের। নষ্ট রাজনীতির এই সোনালী সময়ে সফেদ রাজনীতিকদের ভুলে থাকতেই আমাদের কল্যাণ, ভুলে থাকেতই তাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। আজ একজন অতি সাধারন রাজনীতিক নূরে আলম জিকুর ৭৫তম জন্ম বার্ষিকী। নূরে আলম জিকুকে আমরা ভুলে যেতে পেরেছি এটাই তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের বাস্তব চিত্র।

২.
নষ্ট রাজনীতি আর নষ্ট রাজনীতিকদের সুবর্ণ সময়ে নূরে আলম জিকু ছিলেন একজন চরম ব্যর্থ নেতা। তিনি একদিকে শাহজাহান সিরাজের মত তিনি বিএনপি জামাতের দানকৃত মন্ত্রীত্ব যেমন গ্রহন করতে পারেন নাই অন্যদিকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভক্ষনের আশায় ইনু মেনু'দের মত আওয়ামী লীগের মোসাহেবের দায়িত্ব পালনের চাকুরীও গ্রহন করতে পারেন নাই। ২০১০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী একজন অতি সাধারন মানুষের মত খুব নীরবে চির বিদায় নিয়েছেন তিনি। অসুস্থতার সময়টা অতি সাধারন মানুষের মত কাটিয়েছেন। ২০০৫ সালে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য তিনি রাস্ট্রীয় কোন সহযোগিতা তিনি পান নাই, আশাও করেন নাই। (উল্লেখ্য ২০০৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বিএনপি জামাত সরকার, সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার এবং বর্তমান সরকারের কাছ থেকে একই আচরণ পেয়েছেন তিনি)

৩.
ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি ছিলেন কুষ্টিয়ায়। একজন স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছাত্র ও যুব আন্দোলনসহ আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সময়েই তিনি সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থ্যান এবং '৭০-এর নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এই অতি সাধারন রাজনীতিক, অতি সাধারন মানুষ।

৪.
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের দেরাদুনে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) তথা মুজিব বাহিনীর প্রথম ট্রেনিং ক্যাম্পের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বিএলএফের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে পুরো খুলনা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ, বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা এবং পাবনা জেলায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন তোফায়েল আহমেদ।

৫.
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালে অবিভক্ত জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে বিভিন্ন মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ও কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে জাসদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং নূরে আলম জিকু একাংশের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহন করে এবং সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে উনি একবার অতি সাধারন থেকে সামান্য সময়ের জন্য অসাধারন হয়ে উঠেছিলেন । উনার রাজনৈতিক জীবনে অসাধারণত্বের এই অংশটুকু না থাকলেই বোধ হয় ভাল হত।

৬.
নূরে আলম জিকু যতটা ছিলেন রাজনীতিক তার চাইতে বেশী ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল পরিচালক। অথচ চলচিত্র পরিচালনার কাজটিকে দীর্ঘায়িত করেন নাই। বাংলা চলচিত্রের সাদাকালো যুগের অন্যতম সৃষ্টি 'নিশি হলো ভোর' ছবিটি পরিচালক এবং প্রযোজক ছিলেন তিনি। বাংলা হাসির ছবির অন্যতম মাস্টার পিস ১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন ছবিটির সাথেও জড়িত ছিলেন। এছাড়াও তিনটি ফিচার ফিল্ম পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। তাঁর হাতেই কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষা পরিষদ ও লালন লোকসাহিত্য সংসদ নামের দুটি শিল্প-সংস্কৃতি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৭.
নূরে আলম জিকু কতটা বড় রাজনীতিক ছিলেন বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তার দর্শনে কতটা ভুল বা শুদ্ধতা ছিল, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত উনার ভূমিকা কি ছিল সেই সব আলোচনা করার কোন অর্থ হয়না। নষ্ট রাজনীতির এই সুবর্ণ সময়ে একজন অতি সাধারন মানুষ হিসেবেই উনার পরিচিতি হোক। আমার আর দশজন অতি সাধারন মানুষের মত উনার মত সাধারন মানুষকে এবং মানুষদের ভুলে যেতে শিখি।

একদিন নিশি ভোর হবে। অমানিশা কেটে গেলে এই সূর্য সন্তানদের ঠিক স্বরণ করে নিব শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায়।

————————————————————
এই পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

লেখকের ফেসবুক আইডি: Abu Sayeed Ahamed