যুদ্ধাপরাধীদের বিচার লাভজনক এক রাজনৈতিক ফিকির

এহসানুল করিম
Published : 5 Jan 2012, 06:43 AM
Updated : 5 Jan 2012, 06:43 AM


১.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভোটারদের প্রভাবিত করবার জন্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফিকির ছিল তা মহাজোট তথা আওয়ামীলীগের কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্রমাগত স্পষ্ট হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান ইস্যু হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর তাই বিচার করবার চাইতে বিচার নিয়ে নাটক মঞ্চায়নের বিষয়ে আওয়ামী লীগ এখন অতি আন্তরিক ও নিবেদিত প্রান। যারা প্রকৃতই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান তারা ক্রমাগত হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে রাজনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ করা না গেলে আমাদের শুধু একের পর এক নাটকই দেখে যেতে হবে।

২.
সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবার বিষয়টিকে রাজপথের সস্তা রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করার খেলায় মেতেছে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনরা মাত্র তিন বছরে ভুলে গেছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জাতির আপোষহীন সমর্থনের কারণেই তারা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই ট্রাইবুন্যাল গঠন নিয়ে আইনমন্ত্রীর স্ববিরোধী বক্তব্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রতিমন্ত্রী লাগামহীন একই বক্তব্য প্রদান যতটা বেগবান ছিল, মূল কাজের গতি ছিল ততটাই ক্ষীণ। ক্ষমতা গ্রহনে তিন বছরের মাথায় এসে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে ময়দানের বিষয়ে পরিণত করতে হয় তবে এটাই সত্য যে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে বাণিজ্য করতে গিয়ে তাদের সংগঠিত হবার আর জনমতে প্রভাব ফেলবার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সময় দিয়েছে। আর এই সময় প্রদান এই কারণে যে, যেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে একটি দীর্ঘ মেয়াদী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ফন্দিতে পরিণত করা যায় আর নির্বাচনের সময় তা ঝোলা থেকে বের করে প্রদর্শন করা যায়।

৩.
সরকারী দলের মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতারা যখন দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে বক্তব্য দেন তখন শংকিত হই। এই শংকার কারন এই যে, যাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়ন করবার কথা, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবার জন্য ম্যান্ডেট পেয়েছেন তারা বিচার কাজ বাস্তবায়ন না করে আন্দোলন করেন কিসের জন্য? কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন? বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারী দলকে যদি নির্বাচনী ইশতেহার পালন ও রক্ষা করতে বাধ্য করবার জন্য সরকারী দলের মন্ত্রী, সাংসদ আর নেতাদের রাজপথে আন্দোলনে নামতে হয় তবে সরকার যারা চালাচ্ছেন তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে পূর্ণ ম্যান্ডেট পেয়েও ধীরে চলো নীতি কাদের খুশী ও রক্ষা করবার জন্য?

৪.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুন্যাল আর্ন্তজাতিক মানের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য দলীয় মনোনয়নে যে সকল আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের ভূমিকা পুরো বিষয়টিকে রম্য বিষয়ে পরিণত করেছেন। দেলোয়ার হোসেন সাইদীর বিরুদ্ধে যে সকল সাক্ষী স্বাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের বক্তব্য এবং অতীত রেকর্ড এতটাই শুদ্ধ ও তথ্যবহুল(!!!!!!) যে, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য গঠিত ট্রাইবুন্যালে তারা কিভাবে স্বাক্ষী হিসেবে কাঠগড়ায় দাড়ানোর সুযোগ পান সে বিষয়ে একটা গবেষনা হতে পারে। ছিচকে চোর আর যুদ্ধকালীন সময়ে যার বয়স মাত্র বারো বছর ছিল তেমন ব্যক্তি ছাড়া সাঈদীর মত চিহ্নিত রাজাকারের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী পাওয়া গেলনা! ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং দীর্ঘায়িত করে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী তথা মহাজোটিয় নির্বাচনী মূলা হিসেবে ব্যবহার করবার অভিপ্রায় এখন স্পষ্ট।

৫.
সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, ঘর ঘর থেকে রাজাকারদের ধরে নিয়ে আসতে। অথচ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে উনার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের টিকেটে বিজয়ী ৮৮ জন সংসদ সদস্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আর গভর্ণর টিক্কাখানের সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। তাদের সদস্যপদ পুর্নবহাল করবার আবেদন করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই ৮৮ জনের নাম, পিতার নাম, ঠিকানা ও সংসদীয় এলাকার নামসহ গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এই তালিকায় ৮৪ নম্বরে ছিলেন সাজেদা চৌধুরী। মহাজোটের অন্যতম শরীক জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হোমো এরশাদ। ১৯৭১-এ পাকিস্তান আর্মির এই অফিসার পকিস্তানে বসে কি ভূমিকা পালন করেছিলেন! কাদের স্বার্থে কাজ করেছিলেন! আত্নীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ মূসা বিন শমসের, আওয়ামী লীগের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ আশিকুর রহমান, আওয়ামী লীগের এম পি মোসলেম উদ্দিনসহ আরো অনেকের নাম নিয়ে এই তালিকাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত করা যায়। যারা অখন্ড পাকিস্তান চেয়েছিল সেই ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্রিয়াকে বাস্তবায়ন করার চেস্টা আর নদীর ঢেউয়ে আঙ্গুল দিয়ে রংহীন ছবি আঁকা একই কথা।

৬.
স্বাধীনতার পরবর্তী প্রতিটি সরকারের আমলেই মুক্তিযুদ্ধের মত মহা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ইতিহাসকে বির্তকিত করা হয়েছে এবং বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। ১৯৭১ সালে অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপন যুদ্ধ করেছিলেন একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেই প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সাহস শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছির গেরিলাদের একের পর এক আঘাতে। প্রতিরোধ গড়তে না পেরে পাকি সেনাবাহিনী ধারাবাহিকভাবে বর্বরতার মাইলস্টোন স্থাপন করে। তাদের জঘন্য বর্বরতা বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিল এই দেশের মানুষরুপী ইবলিশবৃন্দ। অথচ আজ মহাজোট সরকার আর তাদের তবলাবাদক সুশীলবৃন্দ যুদ্ধাপরাধীদের এমনভাবে ফোকাস করছেন যেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মূলত রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের। এই প্রচারণার অংশ হিসেবেই পকিস্তানী পত্রিকা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানী সেনাবহিনীকে নির্দোষ প্রমাণের দাবী করতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য গঠিত আর্ন্তজাতিক মানের ট্রাইবুন্যালে ইয়াহিয়া খান, মোনায়েম খান, নিয়াজীসহ তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের অর্থাৎ মূল আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হবে কবে!

৭.
ক্ষমতাগ্রহনের প্রায় তিন বছর হয়ে গেলেও সরকার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী নির্বাচিত এমপি এবং মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে পারে নাই। অথবা করে নাই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিতে সমগ্র জাতির অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল এবং আছে। সেই সমর্থন তারা তাদের ভোটের মাধ্যমেই প্রদান করেছিল। সেই সমর্থনকে নিয়ে ছেলেখেলা করছে মহাজোট আর স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচিত কিন্তু বর্তমানে লক্ষ্য ও আদর্শ ভ্রষ্ট আওয়ামী লীগ। বিএনপি জামাতকে পালন করবে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করবে প্রকাশ্যে। একই কাজ আওয়ামী লীগ করবে কৌশলে আর গোপনে। আজ আওয়ামী লীগ আর বিএনপির আদর্শ ও লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য এতটুকুই ।

৮.
লক্ষ্য ভ্রষ্ট উদভ্রান্তদের সঠিক পথে আনবার জন্য প্রয়োজন গণ জাগরন। যে যার জায়গা থেকে তাদের সঠিক পথে থাকবার জন্য সাধ্যমত বাধ্য করি। কারণ ভোটের ক্ষমতা আমাদের। আর এই কারনেই অন্তত পাঁচবছর পরপর এসে তারা জনগনের কাছে স্বপ্ন ফেরি করে আর বিগত দিনের ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থন করে। আসুন এই ক্ষমতাকে আমরা কেন্দ্রীভূত করি আর প্রয়োগ করি সবসময়। আদর্শহীন লক্ষ্যভ্রষ্টদের জানিয়ে দেই শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমরাই শতকরা ৯৯ ভাগ।