১.
কোন ক্ষোভ, রাগ, বিদ্বেষ, আক্রোশ, মোহ, ভালবাসা, স্বার্থ অথবা যুক্তিহীন আবেগ থেকে এই লেখা নয়। এই লেখাটি বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের একজন অতি সাধারন মানুষের চরম অক্ষমতা আর গাঢ় র্নিলিপ্ততার স্থির চিত্রের শব্দরুপ। এই স্থির চিত্রে আমি, আপনি, সে অর্থাৎ আমাদের মত বর্তমান সময়ের সকল সাধারন মানুষ বন্দী।
২.
গতকাল সকালে সময় টেলিভিশনে খবর দেখছিলাম। ব্রেকিং নিউজ টেলপে দেখতে পেলাম সাগর আর রুনির খুন হওয়ার সংবাদ। চ্যানেল বদল করে এটিএন বাংলায় গেলাম। সেখানে তখনও নাটক চলছে। শুধুমাত্র নিউজ টেলপে দেখলাম পরিকল্পিত খুনের সংবাদটি। মাছরাঙা টেলিভিশনেও একই অবস্থা। যে দুই চ্যানেলের জন্য নিবেদিত ছিলেন রুনি আর সাগর সেই দুই চ্যানেলকে শোক প্রকাশ করবার জন্য লেগে গেছে অনেকটা সময়। রাতের খবরে তাদের কফিনে ফুল দিবার সময় নিবেদিত স্ত্রী প্রেমিক এক চ্যানেলের মালিককে ছবি তোলার জন্য পোজ দিতে দেখা গেল।
৩.
রাতের সংবাদে দেখলাম মেঘকে। আমার সন্তানের সমবয়সী। সে তার বাবা-মার কবরে মাটি দিচ্ছে। এই দৃশ্য সহ্য করবার মত নয়। এই দৃশ্য দেখে সারারাত ঘুমহীন কেটেছে। মেঘ এখনও বুঝতে পারছেনা সে কি হারিয়েছে। দিনে দিনে সে বাবা-মার অভাব অনুভব করবে। আমরা যে যার মত তার কথা ভুলে যাব। আমরা নিজেদের সন্তানকে নিয়ে (যদি মৃত্যুবরণ না করি। কারণ অস্বাভাবিক মৃত্যুই এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি) মগ্ন হব। আনন্দিত হব। মেঘ নিসঙ্গ থেকে নিসঙ্গতর হবে। তাতে আমাদের কি!
৪.
এই অস্বাভাবিক মৃত্যু কি খুব বেশী অস্বাভাবিক! গতকাল বারবার নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি। কিন্তু উত্তরে যে বিষয়গুলি সামনে এসেছে তাতে আতংক আরও বেড়ে গেছে। যেমন:-
ক) আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অপহরণ করে হত্যা ও গুম নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হল। দেশী মিডিয়ার গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান করে নিল। তখন কোন এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানালেন তিনি বিষয়টি পত্রিকা পড়ে জেনেছেন। অথচ বিষয়টি পত্রিকার মাধ্যমে শুধু নয়, গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমেই তার জ্ঞাত হবার কথা ছিল। প্রায় প্রতিটি সময়ে দেখা যায়, তিনি বলেন বিষয়টি সর্ম্পকে জানেন না। তাহলে তিনি জানেন কি! গতকালও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেবার পরে তিনি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অপরাধীদের ধরবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে ধরবার জন্য যদি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নহিসত প্রাপ্ত হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয় তবে আমরা আমজনতা কতটা নিরাপদ এটা ভাবলেই মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়।
খ) মুনীর মিশুক এবং তারেক মাসুদের মৃত্যুর পরে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাণিজ্য নিয়ে পত্রিকাগুলি সরব হয়। এই অবৈধ লাইসেন্সগুলির জন্য সুপারিশকারী নৌপরিবহন মন্ত্রী। তিনি প্রকাশ্যে অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। তার সহযোগী হলেন তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব আবুল হোসেন। একটা সময় মিডিয়ার চাপে নাগরিকরা নাটক দেখার সুযোগ পেলেন। মনি কাঞ্চন যোগের মত আবুল আর ইলিয়াস কাঞ্চন যোগ দেখা গেল।
গ) স¤প্রতি এল জি আর ডি মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মিডিয়ার সামনে জানান দিলেন সীমান্তে বি এস এফের হত্যাকান্ড অতীতে চলেছে, বর্তমানে চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। জাতীয় সংসদের মত পবিত্র(!!) জায়গায় বললেন এ্যাকসিডেন্ট ইজ এ্যাকসিডেন্ট।
ঘ) চিহ্নিত অপরাধীদের মামলাগুলিকে রাজনৈতিক হয়রানীমূলক মামলা হিসেবে বিবেচনা করে কতগুলি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে তা মিডিয়া সংশ্লিষ্ট অনেকেই অবগত আছেন। এখানেও নেতৃত্বে ছিলেন মন্ত্রী পরিষদের কয়েকজন মাননীয় সদস্য।
ঙ) যে সকল কলেজে ছাত্র রাজনীতি আছে সেখানে ছাত্রলীগ এক আতংকের নাম। অথচ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকে সামলানো ও শুধরানোর পরিবর্তে তাদের কার্যক্রমকে হালাল করবার জন্য ছাত্রলীগে বহিরাগতদের প্রবেশ আর শিবিরের ষড়যন্ত্র তত্ব উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
চ) বিচারে প্রমানিত হত্যা মামলার আসামীকে মহামান্য রাস্ট্রপতি সাধারন ক্ষমা উপহার দিতে লজ্জিত বা কুণ্ঠিত হননা। অপরাধ অপেক্ষা সংসদীয় পদ্ধতির রাস্ট্রপতির কাছেও দলীয় পরিচয় প্রধানতম বিষয়।
৫.
মেঘ, মেহেরুন রুনি আর সাগর আমার কেউ নয়। তারা বেঁচে থাকলো কি মরে গেল, মেঘের শূন্যতা পূরন হবে কি হবেনা তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা। অথচ কাল সকাল থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত মেঘ, সাগর আর রুনির মুখগুলি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তাদের মুখগুলির পাশাপাশি ভেসে উঠছে কিছু অশ্লীল মুখ। আর সেই অশ্লীল মুখগুলি ক্রমশ পরিণত হচ্ছে শুকরের মুখে। আমি আর দশজনের মতই অক্ষম, সাগর বা মেহেরুন রুনিদের বাঁচাতে পারিনা, তাদের মৃত্যুতে বিদ্রোহ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়তে পারিনা। আমি আর দশজনের মতই এতটা অক্ষম যে, অশ্লীল মুখগুলিকে শুকুরের মুখে পরিণত হওয়া থেকেও বিরত রাখতে পারিনা।
সুলতান আহমেদ বুলু বলেছেনঃ
লেখক , আমি আপনার সাথে পুরু একমত পোষণ করছি সেই সাথে এটা ও বলছি – গত দুদিন যাবত যত বার মেহেরুন রুনি আর সাগরের কথা মনে উধেছে বার বার মেঘ এর কথাই চিন্তা করেছি ! আমি ও একজন বাবা , মেঘ এর মত আমার সন্তান রয়েছে মেঘের স্থানে আমার সন্তান কে চিন্তা করলে পৃথিবীটা অন্ধকার লাগে । । । । । কল্পনা ও করতে পারিনা সেটা ! এই আমাদের সোনার বাংলার ? এই আমাদের জাতীয় নিরাপথা ! কাকে কী বলব জানিনা হায় রে দেশ হায় রে জাতি বড় অসহায় লাগছে নিজেকে !
আবু সাঈদ আহমেদ বলেছেনঃ
কিছুই বলার নাই।
খুব অবাক লাগে ১/১১-এর পরে ভেবেছিলাম একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। নতুন সরকার দিন পাল্টানোর কাজে মনযোগী হবে। কিন্তু দিন কতখানি পাল্টেছে তা বোধগম্য নয়। সত্য নয়, এখন সরকারের কাছে পরিসংখ্যান মূখ্য।
আমরা যারা কোন দলের কাছে দাসখত দেই নাই, আমরা যারা অতি সাধারন মানুষ, আমরা যারা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, আর ধূসরকে ধূসরকে ধূসর দেখতে পাই তারা চোখে অন্ধকার দেখছি। কারণ কোন নেত্রীর বা নেতার স্বপ্ন আমাদের আলোড়িত করেনা। আজ আমরা ভালো খুঁজে পাইনা। আমরা সাধারন মানুষ খুঁজে পাই খারাপের মধ্যে কে কম খারাপ!!
সতত শুভ কামনা আপনার জন্য, সকলের জন্য।
বিমূর্ত বলেছেনঃ
আমিও লেখকের মতই খুবই নগণ্য এবং সাধারন একজন মানুষ । কারো সমর্থন গাইবার জন্যও এই লেখা নয় । আপনার হতাসা , ক্ষোভ সবই ঠিক আছে । কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক মনে হয়েছে যখন আপনি খুব রাগ দেখিয়েছেন ‘স্বররাষ্ট্র মন্ত্রি পত্রিকা পড়ে যেনেছেন” বলাতে । সারাদেশে প্রতিদিন কতগুলি খুন হয় তা ক আমরা জানি ? সবগুলো খুনের ঘটনা কি মন্ত্রিকে সাথে সাথে জানানো হয় নাকি এর নিয়ম আছে জানানোর ? আজ যদি এই খুন হওয়া দম্পতি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব না হতেন তাহলে মিডিয়াও কি এমন করে এই ঘটনা সব কটি মিডিয়ায় কাভার দিত ? তবে হ্যা , মন্ত্রি হয়তো একটু চালাকি করে অন্যভাবে বলতে পারতেন । কিন্তু আমার মত যারা , তারা চালাকি দেখতে চাইনা। আমি চাই উনি কাজে কি দেখাতে পারেন সেটা দেখতে । ওনার এবং ওনার অধিনস্ত ডিপার্টমেন্ট কি করতে পারে সেটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম । লখককে অনুরোধ করছি মানূষের মৃত্যু নিয়েও রাজনৈতক কথা না বললেই আপনার লেখা আরও বেশি হৃদয়গ্রাহী হতো । এসব কথা তো বলবে রাজনৈতিক নেতা আর পাতি নেতারা । একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপাবেন নিজের স্বার্থের জন্য । ধন্যবাদ ।।
আবু সাঈদ আহমেদ বলেছেনঃ
ধন্যবাদ।
প্রতিজন মন্ত্রীকেই সংবাদপত্রের সংবাদ সমূহ জানান হয়। আর গুপ্ত হত্যা শুধু নয়, সোহেল তাজ যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন, উলফার রাজখোরাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদই তিনি পত্রিকা পড়ে জেনেছিলেন। উনার অধীনস্থ গোয়েন্দা সংস্থাগুলি উনাকে কি শুধু বিটিভির পোষা সংবাদ শোনায়!! আর উনি তাই বিশ্বাস করেন!!!!
চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়েছেন খ্যাত আলতাফ হোসেন, লুকিং ফর সন্ত্রাসীজ খ্যাত বাবর আর বতর্মান সংবাদপত্র পড়ে জেনেছি সাহারা খাতুনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এই যে প্রথম দুজন পুরুষ আর উনি নারী। রুনি আর সাগরের হত্যা কান্ডের তদন্ত তার কৌশলে কোন জজমিয়াকে উপস্থাপন করে সেই অপেক্ষায় আছি।
আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে যখন নষ্ট আদর্শহীন রাজনীতি গন্ধ ছড়াবে তখন রাজনীতির দূর্গন্ধ এসেই যাবে। তবে আপনি কোথায় রাজনীতি পেলেন আমি বুঝলাম না। আমার কোন তথ্যটা ভুল অথবা মিথ্যা তা ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ হতাম। গত জোট সরকারের আমলে যখন লিখতাম তখনও একশ্রেনীর তথাকথিত নিরপেক্ষ লোক আপনার মত রাজনীতিকে আনতে না করতেন। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেনের ‘আল্লাহর মাল’ তত্ব আর বাবরের ‘লুকিং ফর সন্ত্রাসীজ’ উক্তির কত ব্যাখা আর প্রেক্ষাপট যে শুনেছি তা নিয়েই একটা স্বাস্থ্যবান পোস্ট লেখা যায়।
আপনার আশাবাদকে আর শক্ত করবার জন্য বলছি, গতকাল (১৩/০২/২০১২) এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশে সন্ত্রাস নেই।
সতত শুভ কামনা আপনার জন্য, সকলের জন্য।
atmkader বলেছেনঃ
ক] মানূষের সুকুমারবৃত্তি বহু আগেই নিহত হয়েছে রাজনীতির কল্যানে । খুন-খারাবি সম্ভবতঃ এখন আর মানূষকে বিচলিত করেনা । অস্বাভাবিক মৃত্যুই এখন স্বাভাবিক বাংলাদেশে !
খ] আপনার পয়েন্টগুলো একাধিক ব্লগার বহুবার তুলে ধরেছেন । কিন্তু ফলাফল বিলকুল শূন্য, সরকারের ঘুম ভাঙ্গেনি । আগেওনা এখনো না ! রক্ষক যারা, তারাই ভক্ষণ করছে আমদের ! এই গ্যাঁড়াকল থেকে জাতির মুক্তি এই জনমে দেখে যেতে পারবো বলে মনে হয়না ! লেখককে ধন্যবাদ ।
আবু সাঈদ আহমেদ বলেছেনঃ
ধন্যবাদ।
যত আশাবাদী হতে চাই, ততই অন্ধকার চারপাশে ঘিরে আসে। জানি এই লেখালিখি করে কিছুই হবেনা। তবু লিখে যাই এই জন্য যে, ভবিষ্যতে সন্তানকে বলতে পারবো, এই নষ্ট সময়ে অক্ষম আমার লিখা ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিলনা।
জানি লিখা দিয়ে নিজের বা দেশের দিনবদল হয়না, কিন্তু রাজনীতি দিয়ে হয়। অথচ আমাদের দেশের মহান রাজনীতিকরা শুধু নিজেদের দিন বদলই সাধন করতে জানেন। জোট আর মহাজোট শুধু এই একটা সূত্রেই সহমত পোষন করে। সহমত পোষন করে তাদের লেজ ধরে পায়ে পায়ে হাটা পোষা দলগুলিও।
সতত শুভ কামনা আপনার জন্য, সকলের জন্য।