ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা ভাবনা এবং কর্পোরেট আগ্রাসন

এহসানুল করিম
Published : 15 Feb 2012, 03:13 PM
Updated : 15 Feb 2012, 03:13 PM

১.
বহুদিন ব্লগে অনিয়মিত। কারণ ব্যস্ততা। প্রতিদিনই ভাবি অন্তত ঘন্টাখানেক নেটে বসবো। কিন্তু ফুরসৎ আর মেলে না। কাজ শেষে আবার কাজ। তারপর আরো কাজ। এভাবেই চলছে দিন। এভাবেই কাটছে রাত। তবে মাঝে মাঝে প্রিয় ব্লগারদের লিখাগুলো পড়বার চেস্টা করি এবং পড়ি। আজ কিছুটা অবসর বের করেছি ব্লগে কাটাবার জন্য। তাই সরাসরি ব্লগেই লিখছি।

২.
আগামীকাল আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। ফেব্রুয়ারী মাস এলেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের এক ধরনের মমত্ববোধ জেগে ওঠে। আমরা বাংলা ব্যবহারে আনন্দবোধ করি। অন্যান্য বিশেষত ইংরেজী ভাষার প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করি। শুধু ফেব্রুয়ারী মাস বলেই বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা আর অন্য ভাষার প্রতি বিদ্বেষ জেগে ওঠে। দুটোই অসুস্থ মানসিকতা।

নিজের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, হৃদয়ের গভীরে ধারন করতে হবে। আমার মতে , নিজের আঞ্চলিক ভাষাটা ভালোভাবে রপ্ত করতে হবে সাথে সাথে প্রমিত বাংলা। আজকাল দেখি অনেকেই বলতে ভালোবাসেন এবং গর্ববোধ করনে বলতে যে তিনি তার আঞ্চলিক ভাষা জানেন না। আবার অনেকেই প্রমিত বাংলাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান যার মধ্যে ভাষার আন্তরিকতাটা আর থাকেনা, থাকে নিপাট গম্ভীর কারুকাজ। ভাষা যদি আন্তরিকভাবে মনের ভাব প্রকাশ না করার মাধ্যম হয়ে ভাষার ব্ষিয়ে নিজের দক্ষতা প্রকাশের মাধ্যম হয় তবে ভাষার নিজস্ব সৌন্দর্য্য আর থাকেনা।

৩.
আমি ইংরেজী বা হিন্দী ভাষার বিদ্বেষী নই। তবে একটা ভাষার সাথে আরেকটা ভাষার মিশ্রণে যে জগাখিচুরী তৈরী হয় তাতে উভয় ভাষারই ইজ্জত আর থাকেনা। আজকাল অনেকেই দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরবার জন্য আহ্বান জানান। অনেক বুদ্ধিজীবি নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ে তাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার দানের পর যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন তাতে দেশীয় সংস্কৃতি কতখানি প্রতিফলিত হয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

কিছুদিন পূর্বে একটি দেশীয় চ্যানেল কোন এক সাংবাদিক সংগঠনের পুরস্কার বিতরণী অনুস্ঠানের কিছু অংশ প্রচার করেছিলো। তাতে নাচের যে দৃশ্য দেখা গেল তা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কোন কালের ধারা বহন করে তা তারাই বলতে পারবেন। তবে আধুনিক টাইট জিন্স আর টি শার্টের উপর কাঁচুলী আকৃতির শার্ট পরিধান যে হিন্দি আইটেম গানের দৃশ্যের নিয়মিত বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

বাংলাদেশের এমন কোন চ্যানেল নেই যাদের বিশেষ অনুষ্ঠান গুলোতে বিজাতীয় বিষয় থাকেনা। অথচ প্রতিটি চ্যানেলই নিজের দেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি তুলে ধরবার মুখরোচক শ্লোগানে মুখর। অথচ বাস্তবতা বড়ই কষ্টকর।

৪.
বাংলাদেশের তরুণদের আলট্রা স্মার্ট বা বিজাতীয় সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ব করবার জন্য মোবাইল কোম্পানীগুলোর ধারাবাহিক কর্পোরেট বিজ্ঞাপন অগ্রাসন চলেছে এবং চলছে। এই কোম্পানীগুলো আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে তাদের বিজ্ঞাপনের কৌশলে পরিণত করেছে। তাই দুনিয়া কাঁপানো ত্রিশ মিনিট-এ যারা পৃষ্ঠপোষকতা করছে তারাই আবার ডিজুস সংস্কৃতিতে উদ্ধুদ্ধ করছে। জাগরণের গান স্পন্সর চলছে আর উদ্দাম নৃত্যের বিজ্ঞাপনও চলছে।

দেশের সকল মানুষকে ইংরেজী শেখাতে মোবাইল কোম্পানীগুলো বিবিসির সহযোগিতায় নতুন কসরত শুরু করেছে। গ্রামীনফোন বলিউডের সর্বশেষ সংবাদ জানানোর জন্য এসএমএস সার্ভিস চালু করেছে। অথচ প্রমিত বাংলা শিখানো কোন উদ্যোগ নেই। নেই দেশের ইতিবাচক সংবাদগুলো জানানোর প্রচেস্টা। কারন বাণিজ্যই শেষ কথা,বাকী সব বাতুলতা।

এক অদ্ভূত ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে আমরা চলছি। জানিনা এই যাত্রা কবে শেষ হবে।

৫.
প্রিয় বাংলাভাষার এখন বিভিন্নরুপ। এফএম বাংলা, ফারুকী বাংলা, বিভিন্ন চ্যানেল-এর বাংলা, মারদাঙ্গা ছায়াছবির বাংলা আরো কত রকমের যে বাংলা আছে!!

আসুন আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজের আঞ্চলিক ভাষাটা ভালোভাবে শিখবার এবং ব্যবহার করবার শপথ নেই; সাথে সাথে প্রমিত বাংলাটা শিখি, অন্তরে ধারন করি এবং ব্যবহারে অভ্যস্ত হই। আর নিজের জন্যই নিখুঁতভাবে একটা বিজাতীয় ভাষা শিখি; সেটা হতে পারে ইংরেজী, হিন্দী, আরবি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ বা অন্য কিছু।

পুনশ্চ: অনেক কথা বলে ফেললাম। বেশী বললে ভুল হতেই পারে। তাই অগ্রীম ক্ষমা চেয়ে রাখলাম। প্রিয় পাঠক এবং প্রিয় ব্লগারবৃন্দ আপনাদের সকলকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা।

সতত শুভ কামনা আপনার জন্য, সকলের জন্য।

অফপিক:
(এই লিখাটি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অন্য একটি ব্লগে লিখেছিলাম। তারপর কিভাবে যেন লিখাটি হারিয়ে গিয়েছিল। আজ এই লিখাটি উদ্ধার করে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। সতত শুভ কামনা আপনার জন্য, সকলের জন্য)