(বিবিসির দক্ষিন এশিয়া প্রতিবেদক জাস্টিন রোলাটের প্রতিবেদন থেকে হুবহু অনুদিত):
অনুবাদ করেছেন: এম. এ. সাঈদ শুভ:
যখন সাংবাদিকেরা নিজেরাই গনমাধ্যমের স্বাধীনতার গুরুত্ব নিয়ে লিখে, এটা অনেকটাই নিজের ঢোল নিজেই পেটানোর মতো একটা ব্যাপার মনে হতে পারে, এটা অনেকটা একজন রাঁধুনীর নিজের রান্না করা নতুন একটা খাবারের গুনাবলী সম্পর্কে নিজেই উল্লাস করা অথবা একজন নরসুন্দরের (নাপিতের) নতুন চুলছাঁটাই শৈলী নিয়ে নিজেই উচ্চ প্রশংসায় মেতে উঠার মতো অবস্থা।
কিন্তু একটি দেশে সত্যিকার অর্থে কি ঘটছে জনগনের তা জানার অধিকারই হলো একটা সত্যিকারের মুক্ত সমাজের মুল ভিত্তি।
সাংবাদিকের সত্যকে খুঁজে বের করতে সর্বদা প্রস্তুত, তাঁদের দ্বারা অবাধ তথ্য-প্রবাহের বিকাশ ছাড়া গনতান্ত্রিক সমাজে আস্বাদনীয় সমস্ত স্বাধীনতাই বিপন্ন হতে পারে।
সেই কারনেই দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী একটি সংবাদপত্র, বাংলাদেশের ডেইলী স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম এর ওপর সমন্বিত আক্রমনে পুরো পৃথিবীর উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ।
পঁচিশ বছর (শিখি শতাব্দী) আগে,বাংলাদেশে যখন সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা ফিরে এসেছিলো তখন এই পত্রিকাটির যাত্রা শুরু হয়েছিলো; এবং পত্রিকাটির সাংবাদিকতায় সততা, উদার এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারনে সবসময়ই একটা সুনাম রয়েছে যেটি 'বাংলাদেশের নিউ ইয়র্ক টাইমস' নামে খ্যাত। আর সেই কারনেই এটা অত্যন্ত দু:খজনক যে মি. আনামকে এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ তাঁকে (মি. অানামকে) "সম্পূর্ন নীতিহীন" এবং মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত করেছেন; এবং সেই সাথে তাঁকে জেলে নিক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছেন। ডজন খানিক রাজনীতিবীদ, ক্ষুব্ধ (সরকার সমর্থিত) ছাত্রনেতা এবং অন্যান্যরা যাঁরা বিশিষ্ট সম্পাদকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধমূলক মানহানির অভিযোগ এনেছেন এই সারির শীর্ষে রয়েছেন মি. ওয়াজেদ।
আমি এক পলকে মি. আনামের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের বিস্তারিত আলোচনায় যাবো; কিন্তু প্রথমে এটা গুরুত্বপূর্ন যে যেসমস্ত অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সেগুলো সাজানো; কারন তাঁর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমন প্রচেষ্টার সর্বশেষ সীমা হচ্ছে দেশের অন্যতম পুরাতন একটি স্বাধীন সংবাদপত্র প্রতষ্ঠানের কন্ঠরোধ করা যেটি না দেখাটাই খুব কঠিন।
প্রতিবেদনে ডেইলী স্টার সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন
দ্য ডেইলী স্টার এবং এটির সহোদরা প্রকাশনা প্রথম আলো (দেশের সর্বোচ্চ পঠিত বাংলা সংবাদপত্র) ইতোমধ্যেই এদের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দেয়ার জন্য গোপন প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
বিবিসি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে গত বছরের গ্রীষ্মকালীন সময়ে, বাংলাদেশের বড় বড় কিছু টেলিকম এবং ভোক্তা পন্যদ্রব্য কোম্পানিসমুহকে দেশের সামরিক গোযেন্দা সংস্থা দ্বারা দুই পত্রিকায় কোন বিজ্ঞাপন না দেয়ার আদেশ দেয়া হযেছে।
নরওয়ে ভিত্তিক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপাপরেটর কোম্পানী গ্রামীন ফোন আল জাজিরার কাছে এটি স্বীকার করেছে। যোগাযোগ বিভাগের প্রধান টেলেনর নিশ্চিত করে বলেছে "অন্যান্য বড় কর্পোরেশনের সাথে এটাও (গ্রামীন ফোন) কর্তপক্ষের নিকট থেকে নির্দেশনা পেয়েছে যাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের এই শীর্ষস্থানীয় দুটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিতে।"
হিসেব অনুযায়ী দ্য ডেইলী স্টার এবং প্রথম আলো তাদের আয়ের এক তৃতীয়াংশ হারিয়েছে এখান থেকে। বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষক ডেভিড বার্গম্যানের মতে, যদিও এই আদেশের আইনগত কোন ভিত্তি নেই।
তিনি বলেন, "কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কেবল এটা জারি করা হয়েছে যেটি এসেছে দেশের সবচেয়ে ভীতিকর একটি গোয়েন্দা সংস্থার নিকট থেকে।"
কিন্তু এটার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এটার উদ্দেশ্য হলো 'স্বাধীন' সংবাদ মাধ্যমকে 'লাইনে' নিয়ে আসা এবং ভিন্নমত পোষনকারীদের কন্ঠরোধ করা।
এখানে বার্তাটি হচ্ছে "লাইন ক্রস করবে তো আমরা ব্যবস্থা নেব", কিন্তু মিডিয়া কর্তৃপক্ষ বা স্বয়ং পুলিশ কর্তৃক এখনও পর্যন্ত কোন পরিষ্কার সীমারেখা টেনে দে্য়া হয় নি। মনে হচ্ছে এটা এভাবেই চলতে থাকবে।
মি. বার্গম্যান লিখেছেন,"দেশে এমন কোন পত্রিকা অথবা টেলিভিশন সম্পাদক নাই যিনি এই অবরোধ সম্পর্কে জানেন না। "কিন্তু প্রায় ৩০ টি টিভি স্টেশন, আর অগনিত সংবাদ পত্রের একটিও ডেইলী স্টার এবং প্রথম আলোকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করে নাই।"
আমি যখন বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু'র সাথে কথা বলি তখন তিনি এরকম কোন আদেশের ব্যাপারে সম্পূর্ন অস্বীকার করলেন।
তিনি আমাকে বললেন যে যদি কোন সংবাদপত্র অথবা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোন কোম্পানী অফিসিয়ালি কোন অভিযোগ দায়ের করেন তিনি তখন এটি তদন্ত করতে আনন্দিত বোধ করবেন; এবং তিনি আরো বললেন যদি বাংলাদেশে ব্যবসার ওপর কোন অবৈধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তাহলে তিনি ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।
যখন ডেইলী স্টারের বিজ্ঞাপনের উপর এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশী সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব পায় নি, কিন্তু ঠিকই মাহফুজ আনামের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ ব্যাপক প্রচার পেয়েছে।
"যে কারনেই মি. আনাম স্বীকার করেছেন তিনি ভুল করেছেন।"
'ভুল জাজমেন্ট' – কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতা?
এর আগে এই মাসেই, একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে (টকশোতে) তিনি স্বীকার করলেন যে, ২০০৭ সালে দূর্নীতির অভিযোগে যে নারীর (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর) বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিলো তা ছিলো সে সময়ের সামরিক সরকারের অসমর্থিত সূত্রের উপর ভিত্তি করে।
তিনি বলেন, তিনি ঐসমস্ত সংবাদ প্রকাশ করে ভুল করেছিলেন। "এটা ছিলো একটি ভুল সম্পাদকীয় জাজমেন্ট বা বিচার-বিশ্লেষন। আমি কোনধরনের সংশয় ছাড়াই তা স্বীকার করছি।"
কিন্তু তাঁর এই ভুল স্বীকার রাষ্ট্রদ্রোহ সংঘটিত করে কি না সেটি সম্পূর্ন ভিন্ন একটি বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র অভিযোগ করেছেন যে মাহফুজ আনাম এবং ডেইলী স্টারের ঐ সমস্ত প্রতিবেদন ছিলো সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে সহায়তা করার প্রচেষ্টা এবং তাঁর মাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা।
যে অভিযোগগুলো মি. আনাম আত্ন-পক্ষ সমর্থন করে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন।
তিনি সামরিক শাসনের সময়ের ২০৩ টি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে তিনি গনতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করেছিলেন। তথাকথিত জরুরী অবস্থাকালীন সময়ে তিনি প্রতি তিন দিনে একটি করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যখন শেখ হাসিনাকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় তখন তাঁর পত্রিকা অনেক সমালোচনামুখর ছিলেন।
আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন না করে শেখ হাসিনাকে সম্পূর্ন ভুল ধারনা থেকে এবং তাড়াহুড়োর মাধ্যমে ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে," গ্রেপ্তারের একদিন পরে তাঁর সম্পাদকীয় দৃঢ়কন্ঠে বলেছিলো এভাবে।
শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই আদালতে পরীক্ষা করা হয় নি কারন ২০০৮ সালে তার দল আওয়ামীলীগ যখন ক্ষমতা অরোহন করে তখন সমস্ত অভিযোগ নির্বাহী আদেশে প্রত্যাহর করে নেয়া হয়েছে।
বিপরীতে, দুর্নীতির একই অভিযোগ যেগুলো প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বিরুদ্ধে করা হয়েছিলো সেগুলোকে পরিচালিত করতে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির অনেক রাজনীতিবিদই এখনো সেগুলোর অভিযোগ থেকে জামিনে রয়েছে।
অনেকেই মনে করেন সংবাদপত্রের সম্পাদকের ওপর আঘাত 'একটি 'স্বাধীন মিডিয়াকে' ধ্বংসের পাঁয়তারা।
তথ্যমন্ত্রী মি. হক ডেইলী স্টারের বিরুদ্ধে কোন ধরনের হয়রানিমূরক ব্যবস্থার ব্যাপারে অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে যেসমস্ত অভিযোগগুলো করা হচ্ছে সেগুলো কিছু ব্যক্তির দ্বারা করা হচ্ছে সরকার এখানে কোনকিছুই সমন্বয় করছে না। তিনি বলেন, "মামলার মেরিটের ওপর ভিত্তি করে তিনি দোষী কি না সে্টি আদালতের রায় কর্তৃক নির্ধারিত হবে "
কিন্তু মাহফুজ আনামের ওপর আক্রমনের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে মি. বার্গম্যানের কোন সংশয় নেই। তিনি মনে করেন যে, এগুলো একটি স্বাধীন সংবাদপত্রকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা।"
তিনি নিশ্চিত যে সরকারের অনুসারীরা চায় "কোন প্রভাবশালী স্বাধীন সংবাদপত্র বা ভিন্নমত পোষন করা কোন পত্রিকা যা তাঁদের নিয়ন্ত্রনের বাহিরে সেগুলো বন্ধ করে দিতে অথবা অন্ততপক্ষে দমাইয়া রাখতে।"
যা বাংলাদেশের মতো 'ইতোমধ্যেই ভঙ্গুর গনতান্ত্রিক' দেশে একটা অশুভ শক্তির ক্ষমতা দখলকে প্রতিনিধিত্ব করবে।
যেহেতু বাংলাদেশী গনমাধ্যম অনেকটাই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, সুতরাং সময় এসেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গনমাধ্যমের এ বিষয়ে কিছু করার।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট (আইএফজে) এটাকে নিন্দা জানিয়েছে এবং এটা মাহফুজ আনামের ওপর আইনী হয়রানি বলে উল্লেখ করেছে। এখন সরকারগুলোরও একই কাজ করা উচিৎ।
এবং এটা যুক্তরাজ্য সরকার থেকে শুরু করাই শ্রেয়।
কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার এ্যালিসন ব্লেইক, যিনি কমনওয়েলথভুক্ত এই দুই দেশের সম্পর্ককে উদযাপন করছিলেন যেখানে একগুচ্ছ মৌলিক মুল্যবোধ ভাগাভাগি করেছিলেন এবং বলেছিলেন-আমরা সংসদীয় গনতন্ত্র, সহনশীল এবং বহুত্ববাদী পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি এবং আমরা মানবাধিকার রক্ষা এবং সমুন্নত করতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
হতে পারে বাংলাদেশ সরকারকে তার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে চ্যালেন্জ করার সময় এসেছে মিস. ব্লেইকের।
প্রতিবেদক, দ্য ডেইলী স্টার,