সর্বোচ্চ আদালতকে ঘুরে আবারও ‘হাইকোর্ট’ দেখানো হলো!

এম.এ.সাঈদ শুভ
Published : 3 April 2017, 01:01 PM
Updated : 3 April 2017, 01:01 PM

সরাসরি জনগণের ম্যান্ডেটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো নোংরা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা। সত্যিকার গণতান্ত্রিক স্পিরিটকে বিশ্বাস করলে এমনটা হবার কথা নয়। সেই আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই গতকাল আবারো বরখাস্ত করা হলো সিলেটের মেয়র আরিফুল হক এবং রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে। যে অভিযোগে নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হলো, সেই অভিযোগে করা বরখাস্তের আদেশকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করা হলো; কর্তৃত্ব বহির্ভূত (আলট্রাভায়ার্স) ঘোষণা করা হলো। সেই একই অভিযোগে তাঁরা চেয়ারে বসতে না বসতেই আবারো বরখাস্ত করা হলো। এই ঘটনাকে আদালতের আদেশের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন বললে কি খুব বেশি ভুল হবে?

প্রথমত, জনগণের ম্যান্ডেটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং দ্বিতীয়ত দেশের সর্বোচ্চ আদলত সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগকে ঘুরে আবারো 'হাইকোর্ট' দেখানো হলো। আগে শুনতাম অন্ধ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট দেখানোর কথা। এখন দেখি হাইকোর্টেরও উচ্চ আদালত আপিলকোর্টকে ঘুরে আবার হাহকোর্ট দেখানো হলো। এটি অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ বলে প্রতীয়মান হয়েছে মানুষের কাছে। এগুলো গণতান্ত্রিক স্পিরিটে বিশ্বাসী শান্তিপূর্ণ জনগণের হৃদয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষত সৃষ্টি করবে। আমার বিশ্বাস, অনেক আওয়ামীলীগের নেতা আছেন যাঁরা 'রুটি-রুজির' ভাগ খোঁজেন না তারাও এই বরখাস্তের আদেশে কষ্ট পেয়েছেন নিশ্চয়ই। গতকাল আওয়ামীলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো। উনিও রীতিমত হতবাক।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, বর্তমান সময়ের 'সুবিধাবাদী আমলাতন্ত্র' রাজনৈতিক সরকার আওয়ামীলীগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আওয়ামীলীগকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তার খোঁজ কি রাখছে আওয়ামীলীগ? আমার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই সিদ্ধান্তে কষ্ট পেয়েছেন। কারণটা হলো, ২০১৪ সালের সাংবিধানিক শূন্যতার হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য বাধ্যবাধকতা পুরণের নির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামীলীগের উপর যে কালিমা লেগেছে তাতে উনি বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছেন, যা ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।

যদিও বিএনপি-জামায়াতের লাগাতার মানুষ হত্যা আর আগুন সন্ত্রাসের নোংরা এক রাজনৈতিক খেলা বন্ধ করতে গিয়ে ভিন্নভাবে পথ হাটতে হয়েছে, তবুও প্রধানমন্ত্রী চান আওয়ামীলীগের ক্ষমতার ভিত্তি হবে জনগণের ম্যান্ডেট। কিন্তু এরই মধ্যে আমলাতন্ত্র বর্তমান রাজনৈতিক সরকারকে জিম্মি করে বিভিন্নভাবে ফায়দা লুটছে আর আওয়ামীলীগকে তলানীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে, জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটকে ক্ষত-বিক্ষত করে আদর্শিক রাজনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোন পথে হাঁটতে চাইছে আওয়ামীলীগ? প্রশ্নটির উত্তর কি আওয়ামীলীগের কোন নেতার জানা আছে?

সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট বলেছেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ আইন ২০০৯ (২০০৯ সনের ৬০ নম্বর আইন)- এর ১২ উপধারা (১) এর অপপ্রয়োগ হয়েছে। যে আইনের দোহাই দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার ধুম পড়েছে, রায়ে আদালত সেই আইনের লিগ্যালিটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আইনের এ সমস্ত বিধান সাংবিধানিক স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক। আইনের চিরায়ত নীতি হলো একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত সাংবিধানিক আদালত কর্তৃক চূড়ান্তভাবে দোষী প্রমাণিত না হবে আইন ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ ব্যক্তিকে নির্দোষ মনে করবে। কিন্তু এসব বিধান কোনো ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না।

বরখাস্তের বাইরেও মিডিয়ার কল্যাণে গতকাল আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করলো দেশের মানুষ। গতকাল উচ্চ আদালতের রায় ও মন্ত্রনালয়ের অনুমতি নিয়েই রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল অফিস করতে এসেছিলেন। তাঁকে মেয়রের চেয়ারে বসতে দেয়া হচ্ছিলো না। জোর জবরদস্তি চলছিলো। জোর করে এই চেয়ার আটকে রাখার প্রচেষ্টা চলছিলো বলেই মনে হচ্ছিলো। যদিও শেষ পর্যন্ত চেয়ার পেলেন। আবার আট মিনিটের মাথায় বরখাস্তের চিঠি। এগুলো কিসের ইঙ্গিত বহন করে?

এম.এ. সাঈদ শুভ

পিএইচডি গবেষক

ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস)

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: sayeedlaw@gmail.com