গ্যাস-তেলের বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ

সাজ্জাদ রাহমান
Published : 29 Feb 2016, 07:42 AM
Updated : 29 Feb 2016, 07:42 AM

একথা অনেকেই জানেন যে, বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি গভীর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তির সাথে বাংলাদেশের ঠান্ডা লড়াই এখন স্পস্ট। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার বর্তমান  সরকারের সাথে অতীতে আওয়ামীলীগের মিত্রতা থাকলেও নানা কারণে নিকট ইতিহাসে সেটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বিশেষ করে বিগত সময়ে বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাস ক্ষেত্র ইজারাদান প্রশ্নে ক্লিন্টন প্রশাসনের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের মত পার্থক্য এই বিরোধের বিষয়টিকে স্পস্ট করেছিলো। যার ফলশ্রুতিতে সেবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। সুবিধা নিয়েছিলো বিএনপি। তারা পশ্চিমা তেল কোম্পানী গুলোর সাথে আঁতাত করে, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে, নির্বাচন কমিশনে একটি মাত্র মিডিয়া সেন্টার খুলে ফলাফল তাদের দিকে নিয়ে গিয়েছিলো।

এরপর ক্ষমতা বিচ্ছিন্ন আওয়ামীলীগ পরবর্তী নির্বাচনে যখন জয়লাভের প্রশ্নে জনমত সংগ্রহে প্রায় সফল হয়েছিলো। সুস্থ নির্বাচন হলে তারা জিতে আসতে পারতো। তখন ওয়ান ইলিভেন এর মতো ঘটনার সূত্রপাত করে ২ বছর এ দেশে কার্যত সেনা শাসন চালু ছিলো। এরপরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ দেশীয় এবং বিশ্ব রাজনীতিতে সফলতা দেখিয়ে ক্ষমতায় আসে।  এর পরের ঘটনাবলী আমরা জানি। পশ্চিমা শক্তি বিএনপি জামাতকে সাপোর্ট করেছে, শিবিরকে মাঠে নামিয়ে অগ্নী সন্ত্রাস করে শেখ হাসিনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিতে চেয়েছিলো। এবং এও সঠিক দেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী সেই সঙ্কটে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু এক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ধৈর্য্য এবং কুটনৈতিক সাফল্য দেখিয়ে সরকার গঠন করে। দেশে শান্তি ফিরে আসে।

লক্ষ্যনীয় ছিলো যে- নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সারা দেশে যারা জ্বালাও পোড়াও করেছিলো, নির্বাচনের পর পরই তারা হাওয়া। এটা কেন, কি কারণে ঘটেছিলো- সেটা বোঝা মুশকিল। এরপরের ঘটনাবলী আমরা সকলেই জানি, একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক রায় কার্যকরের ফলে বিরোধী শিবিরে চরম মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়। যা এখন পর্যন্ত চলমান আছে। আন্দোলনে ব্যর্থতা, বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে, জেলের ঘানি টানতে টানতে এখন বিএনপি কার্যতঃ রাজনীতি বিমুখ বলা চলে। কিছুদিন আগের পৌরসভা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনলেও কেন্দ্র ঘেরাও কিংবা ১ দিনের হরতাল ডাকার সাহসও তারা দেখাতে পারেনি।

বিএনপি জামাত জোট বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে পর্যদুস্ত হয়ে এখন অনেকটাই বিদেশ নির্ভর। তারা বিভিন্ন লবিস্ট নিয়োগ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করছে। একই সাথে দেশের জঙ্গীগোষ্ঠিকে অর্থায়নের অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে। এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো- যারা শেখ হাসিনার সাথে তেল-গ্যাস প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌছাতে পারেনি, বা আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশকে পাশে পায়নি।

আফগানিস্তান ছিলো তেল আর হিরক সমৃদ্ধ একটি দেশ। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে ছিলো আফগানিস্তান। তাদের হঠাতে আমেরিকা তালেবান নামে একটি উগ্রপন্থী ইসলামী দলের জন্ম দেয়। সোভিয়েত সৈন্যরা তালেবানদের হাতে মার খেয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেলে, তালেবানদেরও সহ্য করতে পারেনি আমেরিকা। কারণ তারা আফগানিস্তানে আমেরিকার স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে সার্বভৌম ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে চেয়েছিলো। এটা আমেরিকা সহ্য করবে কেন? পুরো আফগানিস্তানকে বধ্যভূমি বানিয়ে তালেবানকে দমন করলো, করায়ত্বে এলো আফগানিস্তান। এরও আগে ইরাক দখল, আফগানিস্তানের পর লিবিয়া। সর্বশেষ মিশর। এর পর তাদের টার্গেটে পরিণতঃ হয় সিরিয়া। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ রাশিয়ার সহায়তায় অদ্যাবধি টিকে থাকলেও সে দেশও এখন আরেক বধ্যভূমি। এই ফাঁকে ইসলামের চরম শত্রু ইসরাইল এবং পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবসায়ীরা মিলে আই এস এর মতো ভয়াবহ এক জঙ্গী গোষ্ঠীর জন্ম দেয়। নেপথ্যে ছিলো কিন্তু সেই পশ্চিমা শক্তি।  পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। আমেরিকা এখন আইএস জুজুর ভয় দেখিয়ে সৌদি আরব, কুয়েত এর মতো কয়েকটি রাষ্ট্রে ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, যুদ্ধ বিমান প্রভৃতি রফতানী করছে। ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সাথে কম দামে তেল বিক্রীর গোপন চুক্তি করে আপাতঃ দৃষ্টিতে রক্ষা পেয়েছে ইরান। এই হলো বিশ্ব রাজনীতি।

সম্প্রতি বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশও আজ অশুভ চক্রান্তের শিকার।  এর পেছনেও এদেশের তেল গ্যাস একক ভাবে করায়ত্ব করার হীন চক্রান্ত। ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত, বেকার জঙ্গী গোষ্ঠীকে অর্থ এবং মদদ দিয়ে দেশী এবং বিদেশী ষড়যন্ত্র আজ দৃশ্যমান। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এইসব ঘটনার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গী গোষ্ঠী আই এস এর সংস্লিস্টতা প্রমাণ করার  চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছে আমেরিকা। উদ্দেশ্য, বর্তমান সরকারকে দূর্বল করা। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকার যথেষ্ঠ সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। খুনীদের গ্রেফতার এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসা সব চেয়ে বড় সফলতা। কিন্তু কথা হচ্ছে এইভাবে কতকাল শেখ হাসিনা একক ভাবে লড়াই করবে। মিত্র ভারত এবং রাশিয়া তাকে আদৌ সুরক্ষা দিতে পারবে কিনা। পশ্চিমাদের রোষানল থেকে দেশ এবং নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি সাদ্দাম হোসেন, কর্ণেল গাদ্দাফি, হোসনে মোবারক। শেখ হাসিনা কতদিন নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন?

ইরাক, লিবিয়া, মিশর, সিরিয়ার মতো দেশে বিরোধী দলগুলো ক্ষমতার লোভে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আঁতাত করেছে। আমাদের ইতিহাসে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো মিরজাফর। এদেশে এখনও মিরজাফরের বংশধররা রয়ে গেছে। তারা ক্ষমতায় যেতে দেশকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে এতটুকু দ্বিধা করবেনা। বিগত নির্বাচন পূর্ববর্তি সহিংসতায় শেখ হাসিনাকে তারা ক্ষমতা থেকে নামাতে পারেনি সত্যি, কিন্তু দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। অগণিত নিরীহ মানুষ আগুনে ঝলসে মৃত্যুবরণ করেছে, অনেকে হয়েছে সারাজীবনের জন্যে পঙ্গু। সাধারণ মানুষ বিরোধীদলের কাছ থেকে একটুও অনুকম্পা পায়নি। যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওযার জন্যে তারা বদ্ধপরিকর ছিলো। এখনও তারা একই অবস্থানে। সুতরাং সৃষ্ট সঙ্কট-ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় শাসক গোষ্ঠীকে টেকসই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তার সাথে প্রয়োজন এসকল প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি। প্রয়োজন জনসচেতনতা এবং দেশ প্রেম। তেল-গ্যাস এর ঘৃণ্য বিশ্ব রাজনীতি থেকে দেশকে বাঁচাতে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার এখনই সময়।