আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বিএনপির যোগ দেয়া- না দেয়ার লাভ-ক্ষতির হিসাব

সাজ্জাদ রাহমান
Published : 23 Oct 2016, 06:01 PM
Updated : 23 Oct 2016, 06:01 PM

বাইশ থেকে তেইশ অক্টোবর হয়ে গেলো দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনকে ঘিরে কয়েকদিন আগে থেকে পুরো দেশে উৎসবের আবহ বিরাজ করেছে। রাজধানী ঢাকাকে সাজানো হয় বর্ণীল সাজে। বর্হিরাষ্ট্রের পঞ্চান্ন জন অতিথি ছাড়াও রাজধানী ও অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এবং বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ষাট হাজার ডেলিগেট এই সম্মেলনে যোগ দেন। অভ্যাগতদের আপ্যায়ন, প্রচারণা, সাজসজ্জ্বা প্রভৃতিতে কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হয়, যা ছিলো নজিরবিহিন। যদিও দলের নেতারা দাবী করেছেন খরচটা দলীয় তহবিল থেকে নির্বাহ করা হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার কমতি ছিলোনা। গণমাধ্যমগুলোয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো আওয়ামীলীগের এই সম্মেলন এবং এর নানান দিক। কেউ কেউ বলেছেন দীর্ঘদিন পর এই সম্মেলন ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্যে প্রয়োজন ছিলো। সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এর ভাষায় অনেকে বলেছেন ঠিক এই মূহুর্তে 'আওয়ামীলীগ দেশে সব চেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল'। অন্যদিকে এই দলটি দুই দুইবারের জন্যে দল ক্ষমতায় থাকা এবং দেশের আর্থিক উন্নয়নে একটা উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখায় উৎসবটা তাদের সাজে। আবার প্রতিপক্ষ নিন্দা না করে ছাড়েননি। তাদের ভাষায় সম্মেলনকে ঘিরে আওয়ামীলীগের এটা বাড়াবাড়ি এবং বিপুল পরিমাণ আর্থিক অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। দলীয় তহবিল থেকে ব্যয় নির্বাহ হয়েছে বলা হলেও এ অর্থ এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ হতে নেয়া চাঁদা থেকে। একথার জবাব দিতেও ছাড়েননি  কোনো কোনো সমর্থক সমালোচক। তাদের ভাষায় মার্কিন নির্বাচনে হিলারী আর ট্রাম্প যদি নির্বাচন করার জন্যে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা নিতে পারে, তাহলে আওয়ামীলীগ তাদের সম্মেলনের জন্যে যদি কারো কাছ থেকে নিয়ে তহবিল ভারী করে, তাতে দোষের কিছু নেই।

চায়ের কাপে ঝড় তোলা এই সম্মেলন শেষ হয়েছে। এবারো সভাপতির পদে নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ওবায়দুল কাদের, যিনি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছেন। অত্যন্ত ক্লিন ইমেজের এই বর্ষিয়ান রাজনীতিককে সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব দিয়ে দল অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন অনেকে। সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রী এবং এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বিগত এক এগারোর সঙ্কটে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন- যা পরবর্তিতে তার পুরস্কার হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি সরকার গঠনের দুইবারই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।

কিন্তু নানা কারণে সৈয়দ আশরাফ তাঁর ক্লিন ইমেজ ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। দাপ্তরিক এবং সাংগঠিক কাজে নীর্লিপ্ত আচরণ এবং মাঝেই মাঝেই দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী বক্তব্য দল এবং সরকারকে বিচলিত ও বিব্রত করে। একবার দপ্তর বিহিন মন্ত্রী হওয়ার পর দেন দরবার করে আবারো মন্ত্রীত্ব পাওয়া এই নেতার তখনি অশনী সংকেত জ্বলে ওঠে। কিন্তু নিজেকে শোধরানোর বদলে তিনি বরাবর আগের মতোই আলস্য এবং অতি কথনের দোষে দুষ্টই থেকে যান। যার ফলে ঐকান্তিক বাসনা থাকা সত্বেও পাননি দলীয় গুরুত্বপূর্ণ এই মর্যাদা। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের শুধু দলে নয় বিরোধী শিবিরেও জনপ্রিয়। দুঃসময়ে দলের জন্য ত্যাগ, মার্জিত আচরণ, সাধারণ নেতা কর্মীর সাথে নিরহংকারভাবে মেশা সর্বোপরি নিজেকে সচিবালয়ের টেবিলে সিমাবদ্ধ না রেখে হাটে মাঠে ঘাটে ছুটে গিয়ে তিনি সব শ্রেণী, পেশা ও সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার নির্মোহ বিচারের মানদন্ডে নিজেকে জয়ী করে এনেছেন।

এই সম্মেলনকে ঘিরে অন্যান্য প্রসঙ্গকে ছাপিয়ে  যে বিষয়টি ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছিলো- সেটি ছিলো আওয়ামীলীগের সম্মেলনে বিএনপির যাওয়া না যাওয়া। বলা যায় পুরো দেশের রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি মাত্রই এই প্রশ্নে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ি জামায়াত ছাড়া দেশের প্রায় সব ক'টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এই সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সরকারি এবং বিরোধী শিবিরে এক পক্ষ যেমন চেয়েছিলেন বিএনপি যোগ দিক, পক্ষান্তরে একটা শ্রেণী চেয়েছিলো বিএনপি না আসুক।

সরকার দলের একাংশ এবং তার মিত্ররা বিএনপির আগমনকে মনে মনে চাননি। কারণ কাগজে কলমে জাতীয় পার্টির মূল অংশ সংসদে বিরোধী দল হলেও সংসদে না থেকেও বিএনপি জনসমর্থনবলে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। বিএনপির  জামাতপ্রীতি তাকে নিয়ে গেছে আরও দুরবর্তি অবস্থানে। সুতরাং অনুষ্ঠানে বিএনপির উপস্থিতি অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ। অন্যদিকে যারা ছিলো বিএনপির উপস্থিতির পক্ষে- তারা হয়তো মনে করেছিলেন  যে- বিএনপির এই আগমনে তাদের পক্ষে এক ধরণের কুটনৈতিক বিজয় সংগঠিত করতো, যার ফল ছিলো সুদুর প্রসারি। কার্যত বিএনপির নীতি নির্ধারক মহল ছিলো দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। হামলা মামলায় জর্জরিত বিএনপির অনেক নেতা কর্মী মনে করেছেন আওয়ামীলীগের সম্মেলনে যোগ দিলে বিষময় দূরত্বটা কিছুটা হলেও প্রশমিত হতো এবং তাতে করে কিছুটা বেনিফিট পাওয়া যেতেও পারতো। দলের কট্টরপন্থী এবং বিশেষ করে জামাত নিয়ন্ত্রিত নেতারা এই ঘটনাকে তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব বলে বিবেচনা করেছেন। প্রবাসী তারেক জিয়া সহ দলের বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতা সম্মেলনে যোগদানের ঘোর বিরোধি ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

বাংলাদেশের এই দুই বৃহত শক্তির এক মঞ্চে আসার আরেকটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো কিছুদিন পূর্বেকার গুলশানের আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর। বিএনপি তখন দলীয়ভাবে সরকারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো; তাদের ভাষায় 'ঐক্যবদ্ধভাবে সঙ্কট মোকাবেলা'র লক্ষ্যে। ওই ইস্যু নিয়েও পক্ষে বিপক্ষে ঘরে বাইরে তুুমল আলোচনা সমালোচনার জন্ম হয়েছিলো। শেষমেষ বিএনপিকে কাছে ডাকি ডাকি করে আর ডাকা হয়নি। সরকার খুব সাফল্যের সাথে একাই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উত্তরটা দিয়েছে এইরকম যে- 'আমরা একাই পরিস্থিতি সামলাতে পারি, তোমাদের প্রয়োজন নেই।' জাতীয় ঐক্যে সাড়া না দিয়ে আওয়ামীলীগ দেশজুড়ে গণসংযোগ ও গনসচেতনতা সৃষ্টির পক্ষে জোর দিয়েছিলো। পরবর্তিতে আওয়ামীলীগের তরফ থেকে এমনটাই আভাষ দেয়া হয়েছিলো যে-  দেশকে আর্ন্তজাতিকভাবে বেকায়দায় ফেলে ফায়দা হাসিলের পাশাপাশি বর্তমান সরকারের চলমান উন্নয়নে বাধা দানই ছিলো উক্ত হামলার আসল লক্ষ্য। দৃশ্যতঃ অকাট্য প্রমাণের অভাব থাকায় বিএনপি জামায়াতকে উপরোক্ত ঘটনার পেছনে কলকাঠি নাড়ানোর জন্যে দায়ী করা না হলেও কারও কারও সন্দেহের আঙুল ওইদিকেই তুলে ধরা ছিলো এবং এখনও আছে।

এ লেখা শেষ করার আগ পর্যন্ত আওয়ামীলীগের সম্মেলন শেষ হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক সহ বেশ কটি পদে রদবদল ছাড়াও কমিটির ব্যাপ্তি বর্ধিত হয়েছে। লক্ষণীয় ছিলো যে- সম্মেলন শেষ হওয়ার মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল এই নবগঠিত কমিটিকে স্বাগতঃ জানিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এমনটাই বলেছেন যে- ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ভদ্র, মার্জিত প্রতিহিংসা পরায়ন নন এমন উদার মনোভাবাপন্ন ওবায়দুল কাদের তাদের জন্যে মঙ্গলজনক হবে বলে মনে করছে বিএনপি। বাহ্যিক ভাবে যদিও এটি ছিলো সাধারণ সৌজন্যতা, কিন্তু আওয়ামীলীগের সম্মেলনে যোগ দিয়ে বিএনপি এক ধরণের শিষ্টাচারের সংস্কৃতি চালু করতে পারতো, যেটা বিএনপির সম্মেলনে আওয়ামীলীগ যোগ না দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।

ভোটের সময় এদেশের মানুষ নির্দিষ্ট একটি প্রতীকে ভোট দেয় এটা সত্যি, কিন্তু সবাই যে মনে প্রাণে কোন কোন রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থক, তা কিন্তু নয়। তাদের চোখে রাজনৈতিক মত পার্থক্যের উর্দ্ধে দেশ, এবং নাগরিক হিসেবে তাদের ভালো থাকা, অন্ততঃ শান্তিতে থাকা। কেননা, দেশের ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেনো, পরিবারের রুটি রোজগারে জন্য কষ্টটা তাদেরই করতে হয়।  কোন রাজনৈতিক দল তাদের ছেলেমেয়েদের টিউশন ফি, খাবার কিংবা পোশাক কিনে দেয়না, কিংবা রোগে ভুগলে চিকিৎসা খরচ অথবা বাড়ি ভাড়া দেয়না।  নীরিহ এই শ্রেণীটা রাজনীতির নামে হানাহানি, রেষারেষি মোটেও পছন্দ করেনা। তারা চায় সবাই মিলেমিশে থাকুক এবং দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হোক। তারা চায় যাতে করে ভীতিশূন্যভাবে তাদের ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজে যেতে পারে এবং নিজের কর্মস্থলটাও নিরাপদ থাকুক। তাদের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই থাকুক, সব দলের সার্বজনীন অনুষ্ঠানে সবাই অংশ নিবে এটাই রাজনৈতিক শিষ্টাচার। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- জাতীয় সম্মেলন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়, এটি একটি বড় ধরণের অনুষ্ঠান মাত্র। বিএনপির বিগত একই ধরণের অনুষ্ঠানে আওয়ামীলীগ যোগ না দেয়াটা তাদের চোখে এক ধরণের ভুল ছিলো এবং বিএনপি ওই ভুলটি না করে দেশে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সংস্কৃতির অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতো।

সাজ্জাদ রাহমান- গণমাধ্যমকর্মী, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

                  email: sazzadrahman04@gmail.com

                  Facebook:https://www.facebook.com/kalerkantha