রায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় আগুন: আদালতের করনীয় কী?

সাজ্জাদ রাহমান
Published : 2 March 2017, 06:57 PM
Updated : 2 March 2017, 06:57 PM

আমি কোনো আইনের ছাত্র নই। তবে সাধারণ নাগরিক হিসেবে এইটুকু বুঝতে শিখেছি যে, আদালতের কোনো রায় যদি কারো বিপক্ষে যায় বা তার মতের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে তিনি সংক্ষূব্ধ হতেই পারেন। এবং তিনি তার প্রতিবাদ কিংবা আপিল করতেই পারেন, এটা তার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু অবশ্যই সে প্রতিবাদ কিংবা মত প্রকাশের ভাষাটা হবে আইনি পরিভাষায়। কোনো মতেই হরতাল ধর্মঘট করে, রাস্তায় গাড়ি পুড়িয়ে, নৈরাজ্য চালিয়ে, পুলিশের উপর হামলা করে কিংবা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে বাংলাদেশে এই অপসংস্কৃতিটা বহু আগে থেকে চলে আসছে। সরকার অথবা মালিক পক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত যদি পছন্দ না হয় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে জানাতে আমরা অনেক আগে থেকে অতি দুঃসাহসী পরিচয় দিয়ে আসছি। আদালতে যে কোনো ব্যক্তি, কিংবা গোষ্ঠী অথবা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির হুকুম এলেই আমরা রাস্তায় নেমে পড়েছি, কিংবা হরতাল অবরোধ ডেকে মানুষ মেরে, গাড়ি পুড়িয়ে, সম্পদের হানী করে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর জামাত শিবিরের যে তান্ডব আমরা দেখেছি, সেটা মুক্তিযুদ্ধের মতোই আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছে। সে ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুতে দায়েরকৃত মামলা এবং সাভারের খোদেজা নামক একজন নারীকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যাকান্ডের রায়ের পর পরিবহন মালিক, চালক, শ্রমিকরা সারা দেশে যে তান্ডব দেখিয়েছে তা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহিন। নজিরবিহিন এই কারণে যে, আদালত কর্তৃক অপরাধীর পক্ষে এতোটা জ্বালাও পোড়াও আর দেখিনি। সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে, রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে, পুলিশের উপর হামলা করে, সংবাদ কর্মীদের ক্যামেরা ভেঙ্গে খুব সম্ভবতঃ তারা এটাই বোঝাতে চেয়েছে যে-

'আমাদের নূন্যতম বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবহন চালনার যথাযথ  প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স থাকুক বা না থাকুক, আমাদের গাড়ির ফিটনেস থাকুক বা না থাকুক আমরা রাস্তায় ইচ্ছামতো গাড়ি চালাবো, মানুষ মারবো, এক টাকা ভাড়া বাড়লে দশ টাকা আদায় করবো, যাত্রীদের সাথে গালিগালাজ করবো, মারধর করবো, সিটিং বলে ভাড়া আদায় করবো

কিন্তু রড ছাদ কোনোটাই খালি রাখবোনা, তোমরা সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিবাদ করতে পারবেনা। এমনকি দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীকে আমরা থোড়াই কেয়ার করি। আদালতের রায় আমরা মানিনা। আমরা মানুষ মারবো কিন্তু তার কোনো বিচার হতে পারবেনা, বিচারে শাস্তি  ঘোষণা হলেও সেটা আমরা মানবোনা। আমরা আইন  আদালত বুঝিনা, পড়ে দেখতে হবে এজন্যে আমরা পড়ালেখাও শিখিনাই। আমরা যা বলবো সেটাই আইন এবং সেটা রাষ্ট্র, জনগন, সরকার, এবং আদালতকে মেনে চলতে হবে।'

 লক্ষনীয় যে বহুদিন পর নিশ্চুপ থাকার পর আদালত থেকে একটা রুল এসেছে, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল, অবরোধ-ধর্মঘটের মত কর্মসূচি কতটুকু আইনসম্মত তা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন উচ্চ আদালত। একই সঙ্গে রায়ের বিরুদ্ধে কর্মসূচি আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবেনা তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। পরিবহন ধর্মঘটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা এক রিটের প্রেক্ষিতে আদালত এ রুল জারি করেন। রায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি নিয়েও শুনানি হয় হাইকোর্টে।

আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাজপথে গণবিরোধী কর্মসূচি কতটুকু যৌক্তিক? অঘোষিত পরিবহণ ধর্মঘট বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে উঠে আসে এমন প্রশ্ন। রিটকারীর আইনজীবীরা আদালতকে জানান, রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে না গিয়ে ধর্মঘট, হরতাল, অবরোধ কর্মসূচি দেয়া আদালত অবমাননার শামিল। আদালত এ বিষয়টি আমলে নিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দেয়া যেকোনো কর্মসূচি কেন অবৈধ নয় তা সরকারের কাজ জানতে চান। একই সঙ্গে কর্মসূচি আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে কেন  ব্যবস্থা নেয়া হবে তাও জানতে চেয়েছেন, আদালত।

প্রশ্ন উঠেছে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন রাজনৈতিক দল কর্মসূচি দিলে সেক্ষেত্রে কী হবে? যদিও ২০১০ সালে উচ্চ আদালতের দেয়া এ রায়ে বলা হয়, রাজনৈতিক কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, রুল শুনানির সময় এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। আগামী ৪ সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্টদের এ রুলের জবাব দিতে বলেছেন আদালত। একই সঙ্গে বুধবার বিকেলে ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে কিনা তাও জানাতে বলা হয়েছে।

দুই দিনের পরিবহন শ্রমিকদের তান্ডব সারা দেশের মানুষ দেখেছে এবং শুধুমাত্র গাবতলির ঘটনায় পুলিশ ৩টি মামলা করেছে এবং গ্রেফতার করেছে ৭জনকে। আমরা চাইবো শুধু গাবতলী নয়.. দেশের অন্যান্য স্থানে যারা আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কর্ম বিরতির নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। ওদের বোঝা উচিত দেশে আইন আছে আদালত আছে। মন যা চায় তা করা যাবেনা। আদালত থেকে আমরা আরও নিদের্শনা আশা করি একজন পরিবহন শ্রমিক এর বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে। বাসের যাত্রী কতোজন নেয়া যাবে, কোন দূরত্বে কি ভাড়া হবে, এইসব বিষয়েও একটা মিমাংসা হওয়া জরুরি।

সেই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই শিক্ষা নেয়া উচিত আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়তে হবে আদালতে.. এবং সেটা হবে আইনি লড়াই। কিন্তু কোনোমতেই রাজপথে নৈরাজ্য কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কিংবা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নয়। আমরা ভুলে যাইনি কামারুজ্জামান, নিজামী, গোলাম আযম, সাঈদীর বিচার শেষে আদালতের রায়ের পর তারা কিভাবে সমগ্র দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছিলো।  একই ভাবে আমাদের প্রধান বিরোধী দলগুলোও আদালতের বিভিন্ন রায়ের প্রতিক্রীয়া জানিয়েছে হরতাল অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচী দিয়ে। যা সভ্য সমাজে ভাবা যায়না। অন্ততঃ সাম্প্রতিক ঘটনার পর হাইকোর্ট থেকে রুল জারি হওয়ার পর আমরা অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছি। মনে হচ্ছে আমরা ক্রমশঃ সভ্য হতে চলেছি এবং সব কিছুর উর্ধে আমাদের আদালত। জনগণের শেষ ভরসাস্থল আমাদের আদালতের মর্যাদার প্রশ্নে কোনো আপোষ নয়।