হরিষে বিষাদে কৃষ্ণচূড়া আড্ডা

সাজ্জাদ রাহমান
Published : 28 May 2017, 10:09 PM
Updated : 28 May 2017, 10:09 PM

কৃঞ্চচূড়ার রং লাল।  আগুনের রং -ও লাল।  এক লাল হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার করে, আরেক লাল আলো আর উত্তাপ এর পাশাপাশি দহনও করে, কখনো কখনো নিভিয়ে দেয় জীবন প্রদীপ।  এমনি একটি দিনের গল্প বলছি। যেদিন আমরা এই একই রং থেকে কিছু পেয়েছি, আবার এমন কিছু হারিয়েছি, যেটা আর কোনদিন ফিরে পাবোনা।

২০ মে ২০১৭।  বন্ধু শরিফুল ইসলাম সীমান্তের আহবানে আমরা জড়ো হয়েছি রাজধানীর রমনায়।  লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের গালিচায় গোল হয়ে বসেছি আমরা।  আমি পৌঁছুবার পূর্বেই সেখানে জড়ো হয়েছেন  আইরিন সুলতানা, রোদেলা নীলা, খান মুনতাসীর, আশীক আল অনিক, শফিক মিতুল, মাইদুল মিঠুন, ফয়সাল, সোহরাব সুমন, মোঃ গালিব মেহেদী, অভিজিৎ, সোহাগ অতনু, শাহাদাত হোসেন স্বাধীন এবং আমন্ত্রক শরিফুল ইসলাম সীমান্ত।

আমি হেঁটে আসছি আর দূর থেকে দেখছি একটা বৃত্ত, যার মধ্যমনি আইরিন সুলতানা।  তিনি বলছেন, বাকিরা শুনছেন আর এখানে সেখানে বাচ্চা পোলাপানের মতো ছুটে ছুটে ছবি তুলছেন রোদেলা নীলা।  আমাকে দেখে স্বভাব সুলভ গন্ধরাজের হাসিটা হাসলেন আইরিন।  আজ তাকে দারুন লাগছে,  কথাটা শেয়ার করার পর বিনীত ভঙ্গীতে বললেন- 'নির্মাতা হওয়ার কারণেই হয়তো বা এমনটা লাগছে।' আমি মনে মনে বললাম- নির্মাতার চোখে কখনো ভুল করেনা।  শেষবার তাঁকে পেয়েছিলাম ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোরের জন্মদিনে।  তিনি ছিলেন সেই কর্মযজ্ঞের প্রধান নিয়ন্তা, সুতরাং ব্যস্ততার কারণে তেমন কথা হয়নি।  আজ অনেক দিন পর দেখা হলো।  আগের সম্মিলনে অন্য একজন মানুষের সাথেও প্রথম দেখা হয়েছিলো, প্রথম দেখাতেই ভালো লাগা এবং বন্ধুত্ব।  তাঁর কথায় পরে আসছি।

[গাছের উপরে তিন বানর, নীচে বাকিরা।]

[দাঁড়িয়েছি কৃষ্ণচূড়া-সোনালুর তলে।]

সবার সাথে হাত মেলানো এবং পরিচয় পর্বের পর আইরিন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করলেন।  বিষয়টা প্রকৃতি বিরুদ্ধ, মুহূর্তেই নবাব আমলের খোজাদের কথা মনে পড়লো।  খোজা হচ্ছে সেইসব পুরুষ রক্ষী, যাদেরকে রাজা বাদশাহরা তাদের অন্দরমহল নিরাপত্তার কাজে লাগাতেন।  যাদেরকে কাজে নেয়ার আগে লিঙ্গ কেটে নেয়া হতো, যাতে তার দ্বারা অন্দরমহলের নারীরা নিরাপদ থাকে।  শত বছর পরে বিশ্বে একটা নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে, সেটা হচ্ছে খোলা জায়গার বাড়ন্ত গাছগুলোকে বামন বানিয়ে গৃহ অভ্যন্তরে শো-পিস হিসেবে ব্যবহার করা।  এই গাছগুলো দেখেও আমার খোজা গাছ বলে মনে হয়।  এই সুবাদে উইকিপিডিয়া সূত্রে আসুন একবার দৃষ্টি ফেরাই বনসাইয়ের ইতিবৃত্তে।

 **নামকরণ

প্রাচীন চীনা শব্দ 'পেনজাই' থেকে জাপানী 'বনসাই' শব্দের উৎপত্তি। বনসাই করতে ব্যবহৃত ট্রের মত যে পাত্র ব্যবহার করা হয় তাকেই সাধারণভাবে 'বন' বলা হয়। পাশ্চাত্যে পাত্রে ক্ষর্বাকৃতির গাছ বলতে 'বনসাই' বোঝায়।

**ইতিহাস

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় পাত্রে বা টবে গাছ বা বিভিন্ন ধরণের গাছের চারা উৎপাদনের কথা জানা যায়। ৪০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের রাজনৈতিক নথিপত্র থেকে পাথর কেটে তৈরি করা পাত্রে গাছ চাষের হদিস পাওয়া যায়। প্রচুর মন্দিরে তৃতীয় ফারাও রামেসেস পাত্রে লাগানো জলপাই, খেজুর এবং অন্যান্য গাছের বাগান দান করেছিলেন। প্রাচীন ভারতে ঔষধ আর খাবারের জন্য টবে বা পাত্রে গাছ লাগানোর প্রচলন ছিল।

২৬৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৪২০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী জিন সাম্রাজ্যের সময়ের লেখালেখিতে প্রথম 'পেনজাই' শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে চীন দেশের নানা জায়গায়, জাপানে, কোরিয়াতে, ভিয়েতনামে এবং থাইল্যাণ্ডে ভিন্ন আকারে এর চর্চা বিস্তার লাভ করে। চৈনিক ছং রাজবংশের সময় জাপানে পাত্রে উৎপাদিত গাছের জনপ্রিয়তা পায়। জাপানের সাংস্কৃতিক বিনির্মাণের এই সময়ে তারা বেশ কিছু চীন দেশীয় বৈশিষ্ট্য নিজেদের মত করে আত্মস্থ করে নেয়। পাত্রের ক্ষুদ্র গাছকে এই সময় 'গামলার গাছ'(হাচি-নো-কি) বলা হত। জনৈক জাপানি জেন পুরোহিত, কোকান শিরেন-এর লেখা 'ক্ষুদ্রাকৃতি বৃক্ষরাজির বাগান নিয়ে লেখা গদ্য' বইয়ে 'বনছেকি' বা বনসাই এর নান্দনিক বৈশিষ্ট্য ও বাগান পরিকল্পনার আলোচনা পাওয়া যায়।

প্রথম প্রথম জাপানীরা পাত্রে জন্মানো বামনকৃত গাছ ঘরবাড়ি আর গাছ সাজাতে ব্যবহার করত। টকুযাওয়ার সময়ে বিস্তৃর্ণ বাগান তৈরি বিশেষ গুরুত্ব পায়। ধনীদের অবসরে বিনোদনের মাধ্যম হয়ে ওঠে আজালিয়া এবং ম্যাপলের মত গাছ পালন করা। বামনকৃত গাছ পাত্রে পালন করাও জনপ্রিয় ছিল। মোটামুটি ১৮০০ সালের দিকে জাপানিরা তুলনামূলকভাবে কম গভীর পাত্রে ক্ষুদ্র গাছ পরিচর্যা করার সাথে সাথে চৈনিক 'পেনজাই' শব্দের উচ্চারণ পরিবর্তন করে ফেলে।  টকিয়োর রাজশিক প্রাসাদে থাকা অনেক পুরানো জীবিত একটি বনসাইকে জাপানের জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশে বামন বৃক্ষ সভ্যতা কবে শুরু হয়েছে তা বলা না গেলেও বিষয়টি নিয়ে অনেক বনসাই পন্ডিত, গবেষক, এক্সপার্ট এমনকি বনসাই ক্লাব পর্যন্ত হয়েছে। সবাই বিষয়টি নিয়ে অতি উৎসাহী এবং বাসায় একটা বনসাই পুষতে পারলে যেন বিরাট কিছু করে ফেলেছেন।  বনসাই নিয়ে কতো গবেষণাপত্র, টিপস, বাজার।  অথচ পুরো কাজটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশ বিরুদ্ধ একটি অপকর্ম ছাড়া কিছুই নয়। বিষয়টি আইরিন সুলতানার দৃষ্টি আকর্ষণের আগ পর্যন্ত অন্তত কাউকে বলতে শুনিনি।  যাই হোক, বিষয়টি নিয়ে উপস্থিত সবাই খোলামেলা আলোচনায় অংশ নিলেন এবং লক্ষ্য করলাম সবাই একবাক্যে এই বৃক্ষ বিকৃতির বিরুদ্ধে।  বলা যায় কৃতিত্বটা আইরিনের। ততক্ষণে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন আসিফ মাহবুব।

একজন প্রস্তাব করলেন জায়গাটি অনেক গরম হয়ে গেছে, সুতরাং অধিকতর ঠান্ডা কোথাও যাওয়া হোক।  সবাই লেকের পাড় ঘেঁষে হাটতে শুরু করলাম।  আয়োজকদের দেখলাম একটি কৃষ্ণচূড়া এবং একটি রাধাচূড়ার বিশাল চারা বয়ে বেড়াতে।  কে জানতো, তার একটি কিছু সময় পরে আমার ঘাড়েই চাপবে।

যেতে যেতে একটি ব্রিজের উপরে দাঁড়ালাম।  চললো ছবি তোলা। কে যেন বললেন- চলুন কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে গিয়ে ছবি তুলি।  কিন্তু পথিমধ্যেই একটা সোনালু গাছ চোখে পড়লো।  রোদেলা নীলা আবদার করলেন তিনি ওই গাছের ডালে উঠবেন।  আইরিন সুলতানা অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে তাকে উঠালেন।  সেই সাথে উঠলেন আরও দুটো ছেলে বানর।  কিন্তু কিছুক্ষণ পর ছেলে বানরগুলো নেমে গেলেও নারী কবি বানরতো আর নামতে পারছেন না।  বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনেক গবেষণা শেষে কয়েকজনে মিলে এই সুন্দরী বানরকে গাছ থেকে নামানো গেল।

এবার আমরা লেকের উত্তর পাড়ে অপেক্ষাকৃত বড়ো এবং গাঢ় সবুজ ঘাষের উপর আরেকদফা গোল হয়ে বসেছি।  এখানে এসে যোগ দিলেন আরেক বন্ধু নাজমুস সাকিব। আয়োজন করা হলো লটারির।  কে ওই দুই প্রজাতির গাছের চারাদুটি পাবেন। এমা! আমাকে অবাক করে দিয়ে লটারিতে কিনা আমারই নাম উঠেছে।  বললাম, আমার বিগত জীবনে অনেকগুলো লটারিতে অংশ নিয়েছি, কিন্তু আজই প্রথম পুরস্কার জিতলুম, তাও গাছ।  আইরিন সুলতানা তাঁর স্বভাবসুলভ হাসির দ্যুতি ছড়িয়ে বললেন- মনে করুন এখন থেকে আপনার সৌভাগ্যযাত্রা শুরু হলো। আমারও তাঁর কথাটা বিশ্বাস করতে ভীষণ ইচ্ছে হলো। এবার কবিতা পাঠ।

কবি সোহরাব সুমন শুরু করলেন, রোদেলা নীলা পড়বেন, ঠিক এই সময়েই দুঃসংবাদটা এলো।  এতোক্ষণ ধরে চলতে থাকা উৎসবের আলোটা হঠাৎ করেই যেন নিভে গেলো।  কৃষ্ণচূড়ার লাল আভায় উদ্ভাসিত ছিলাম আমরা, আগুনের লেলিহান শিখায় এখন তার পাপড়ীগুলো পুড়ে অঙ্গার হতে চলেছে।  আইরিন সুলতানাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভারী গলায় দুঃসংবাদটা দিলেন। ৩০ এ্প্রিল দগ্ধ আমাদের বন্ধু উৎপল চক্রবর্তী আর নেই।

মনে পড়লো, ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্মদিন ও নতুন লোগো উন্মোচনের দিন তাঁর সাথে প্রথম দেখা এবং সেদিন থেকেই আমরা অভিন্ন হৃদয়। সবসময় হাসিখুশী উচ্ছাস মূখর এই মানুষটি কদিন আগে অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল আমার ফেসবুকের পোস্টে লিখেছেন।  তারও আগে নিতাই দা প্রসঙ্গে এক আলোচনায় তাঁকে ফোন করার পর ভীষণ উৎসাহিত করলেন এবং বললেন আমার যে কোনো উদ্যোগের সাথে তিনি আছেন।  ৩০ এপ্রিল ২০১৭ অগ্নীদগ্ধ হয়েছেন, ২০ মে ২০১৭ চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, আমাদের একা করে দিয়ে।

আইরিন সুলতানা হঠাৎ করেই কেঁদে উঠলেন, হয়তো নিজেকে সামলাতে পারেননি।  বাকিদের চোখও অশ্রুসিক্ত।  হাসপাতালে যাবার জন্যে তোড়জোড় করছে সবাই।  কিন্তু হাসপাতালে যেতে আমার মন সায় দিচ্ছিল না।  কারণ ওখানে গেলেই প্রিয় বন্ধুর মৃত মুখটা দেখতে হতে পারে।  কি করে বইবো সেই স্মৃতি!  তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটাতো এখনো স্মৃতিপটে আাঁকা আাছে। ওটাই বরং থেকে যাক না।  ভেতরটা খুব পুড়ছিলো, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছিলামনা।  দেখলাম একটি সিএনজি অটোরিক্সা ডাকা হয়েছে, সেখানে চাপলেন শফিক ‍মিতুল, অনিক।  শফিক মিতুল নেমে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যাবো কীনা? আমি একটা মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করালাম।  বললাম- এই গাছ নিয়ে কি করে যাবো? বলা বাহুল্য লটারীতে জেতা রাধাচূড়া গাছটা সাইজে অনেক বড়ো ছিলো।  মিতুল বললো- সমস্যা হবেনা।  সিএনজিতে এঁটে যাবে।  ওদিকে  উৎপলের আত্মা যেন ফিসফিস করে বলছে- 'কই সাজ্জাদ ভাই, আমাকে তো একবার দেখতে আসলেনা। ' আমি  কি করে বোঝাই, হাসপাতাল আমার অত্যন্ত অপ্রিয় একটা জায়গা।  যেখানে আমার দুই সহদোরকে হারিয়েছি।  আমার মেজ চাচা, মামা, মামি, নানা, নানী, বড় চাচা, বড় চাচি, দাদা-দাদী- সবাইকে গিলে খেয়েছে ওই নিষ্ঠুর হাসপাতাল।  এখন আবার উৎপল!ওখানে কী করে সামলাবো নিজেকে? আমাকে ভাববার সুযোগ না দিয়ে  আরেকটা সিএনজি এসে গেলো।  নতুন বন্ধু, সোহরাব সুমনসহ উঠে বসলাম।

ছুটছি, কিন্তু মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, উৎপল নেই।  মনে পড়লো আজ বিকেলে যখন এখানে আসছিলাম, বন্ধু জুলফিকার জোবায়ের বলছিলেন উৎপল দা কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছেন।  কয়েক ঘন্টা ব্যবধানে এটা কি ধরণের সংবাদ!  আহারে, আমরা যাচিছ ঠিকই, কিন্তু জীবিত উৎপলকে সাথে নিয়ে উদযাপনের জন্যে নয়।  যাচ্ছি তাকে শেষ বারের মতো বিদায় জানাতে।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিজের অজান্তেই উৎপলের নাম্বারে কল করলাম।  মন বলছে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে উৎপল ফোন ধরে বলবে।  'আরে দুর মিয়া, মজা নিতেছিলাম।' কিন্তু নাহ, ফোনটা বন্ধ।  উৎপল এক জীবনে আর কোনদিনই আমার ফোন ধরবে না!

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।  ডিবিসি নিউজ এ কর্মরত।