নির্বাচন ব্রিটেনে আর উত্তেজনাটা হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে। কারণ একটাই, সেই নির্বাচনে লড়াই করছেন বাংলার তিন অনন্যা নারী। একজন জাতির জনক ব্ঙ্গবন্ধুর নাতনী টিউলিপ, অন্য দু 'জন রুশনারা আলী এবং রূপা হক। তিনজনই বাঙালি, যে কারণে ব্রিটেনতো বটেই, বরং বাংলাদেশের সচেতন মানুষ মাত্রেরই চোখ ছিলো ব্রিটেনের ওই নির্বাচনের দিকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই তিন কন্যাই জিতে গেলেন বিপুল ভোটে। এদের মধ্যে টিউলিপ এর আগের নির্বাচনেও জয়ী হয়েছিলেনে, এ নিয়ে তার দ্বিতীয় জয়, অপরদিকে রুশনারা আলী তৃতীয় বারের মতো জয় লাভ করলেন। রুপা হক এ নিয়ে দ্বিতীয়বার যাচ্ছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এ। আসুন জেনে নেই তিন কন্যার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
টিউলিপ সিদ্দিকী
টিউলিপ স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে, জন্মগ্রহণ করেন লন্ডনের মিচামে। টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। এছাড়াও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। টিউলিপ মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এই অসামান্যা নারী। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে স্থানীয় পার্টির সদস্যদের ভোটে টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার টিকেট পান। ২০১৫ সালের তাঁর প্রথম নির্বাচনে রক্ষণশীলদের শক্তিশালী প্রার্থীকে ১ হাজার ১৩৮ ভোটে হারিয়েছিলেন তিনি। একসময় নির্বাচিত হন বিরোধী দলনেতা জেরমি করবিনের ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিগত নির্বাচনে টিউলিপ পেয়েছিলেন ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট; তার প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল দলের প্রার্থী পান ২২ হাজার ৮৩৯ ভোট। সফল বিশ্বরাজনীতিক শেখ হাসিনার ভাগনী এবং রাজনীতি না করলেও রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ এবারের নির্বাচনে ৩৪ হাজার ৪৬৪টি ভোট পেয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
রুশনারা আলী
রুশনারা আলীর জন্ম সিলেটের বিশ্বনাথে ১৯৭৫ সালে। সাত বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে চলে যান লন্ডনে। দর্শন, রাজনীতি ছাড়াও তিনি ডিগ্রি নেন অর্থনীতিতে। রুশনারা পরামর্শক সংস্থা ইয়ং ফাউন্ডেশনের সহযোগী পরিচালক। রুশনারা আলী লেখাপড়া করেছেন অক্সফোর্ডে ফিলসফি, পলিটিক্স ও ইকোনমিক্স (পিপিই) বিষয়ে। লেবার পার্টির ছায়া সরকারে শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একসময়। রুশনারা আলীর এটি তৃতীয় জয়। জিতেছেন বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রিন ও বো আসন থেকে। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৪২ হাজার ৯৬৯। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল দলের প্রার্থী পেয়েছেন ৭ হাজারের কিছু বেশি ভোট। সর্বশেষ নির্বাচনে প্রায় ২৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশি নারী রুশনারা, ব্যবধানটা এবার বাড়লো আগের চেয়ে।
রূপা হক
বাঙালি মেয়ে রূপা হক এর জন্ম ১৯৭২ সালে ইলিংয়ে, যিনি ১৯৯১ সালে লেবার পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। রূপা কেমব্রিজ থেকে পড়েছেন রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান এবং আইন বিষয়ে। শিক্ষক রুপা কিংস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের মতো বিষয়। পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার আগে তিনি ডেপুটি মেয়র হিসাবে স্থানীয় কাউন্সিলেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রার্থী হয়েছিলেন রূপা। এছাড়া ২০০৫ সালে চেশাম ও এমারশাম আসন থেকে তিনি লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হতে পারেননি। লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসন থেকে প্রার্থী হয়ে গতবার মাত্র ২৭৪ ভোটে জেতা টিউলিপের মতোই প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য হয়েছিলেন কেমব্রিজের ডিগ্রিধারী রূপা। দুই বছরের ব্যবধানে এবার ১৩ হাজার ভোটে জিতেছেন রূপা। এবারের নির্বাচনে তিনি পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৩৭ ভোট; তার প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল দলের প্রার্থী পান ১৯ হাজার ২৭২ ভোট।
বিপুল ভোটে এই তিন নারীর জয়লাভের পেছনে কাজ করেছে মূলতঃ বাঙালি সেন্টিমেন্ট। লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশীরা এদেশের রাজনৈতিক বিভাজন মাথায় রাখেননি। দলমত নির্বিশেষে সকলে কাজ করেছেন, যার ফলে এসেছে এই বিপুল ব্যবধানের জয়। টিউলিপ তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন 'ব্রিটেনের বাংলাদেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু এই নির্বাচনে সবাই জাতি ধর্ম সব ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। ' মনে রাখা দরকার শুধু বাঙালি কমিউনিটির ভোটেই নয়, এই তিন নারী জিতেছেন অন্যান্য ব্রিটিশ নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটেও যা বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্বিত করে।
৩ বাঙালি কন্যার অসামান্য জয়লাভের সংবাদে যখন সেদেশে অবস্থানরত বাঙালি সমর্থকদের পাশাপাশি সাদা চামড়ার মানুষেরাও উল্লাসে ফেটে পড়েন, আনন্দে কেঁদে ফ্যালেন, তখন আমাদের আবেগ ধরে রাখা নিশ্চয়ই কঠিন হয়ে পড়ে। যখন ভাবি ওরা আমাদেরই মাটির সন্তান তখন বুকটা ফুলে উঠে গর্বে।
অভিবাদন টিউলিপ, রূপা আর রুশনারাকে; যাঁরা পৃথিবীর বুকে বাঙালিকে এনে দিয়েছেন সম্মানের সোনালী মুকুট, ভাসিয়েছেন উচ্ছাসের বন্যায়, রাঙিয়েছেন উৎসবের রঙে, ভিজিয়েছেন আনন্দের নোনা জলে।
লেখকঃ গণমাধ্যমকর্মী, ডিবিসি নিউজ এ কর্মরত।