নিন্দা আর উদ্বেগ নয়, চাই কার্যকর হস্তক্ষেপ

সাজ্জাদ রাহমান
Published : 15 Sept 2017, 05:21 PM
Updated : 15 Sept 2017, 05:21 PM

বাস্তুহারা, স্বজন হারা, অসহায় নিরন্ন ১০ লাখ রোহিঙ্গার আহাজারিতে যখন আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত, যখন সমগ্র বিশ্বের মানুষ যখন রোহিঙ্গা নিধনের নিন্দা জানাচ্ছে, বর্মি মগ দস্যু সেনা সরকারের কোনো বিকার নেই।  অন্যদিকে অন সাং সুচি চাইলেও যে কিছু করতে পারবেনা, সেটা এখন বেশ পরিস্কার।  মগরাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনের মূলে সেদেশের সেনা সরকার। সবচাইতে মর্মপীড়াদায়ক বিষয় এখন এই যে- অসহায় রোহিঙ্গারা এতোদিন ধরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে পারলেও এখন সেটাও দিচ্ছেনা।  যাকে যেখানে পাচ্ছে গুলি, জবাই আর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের। কারণ ওরা মগজান্তার গণহত্যার স্বাক্ষী, বাংলাদেশে আসার পর ওরা যাতে গণমাধ্যমে কথা বলতে না পারে, কিংবা আবার ফিরে যেতে না পারে, সে কারণে এভাবেই তাদের কচুকাটা করা হচ্ছে।

সুতরাং বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখন শুধু উদ্বেগ, নিন্দা জানিয়ে থেমে থাকলে চলবেনা, প্রয়োজন দেখা দিয়েছে শক্ত হস্তক্ষেপের। শুরুতে জাতিসংঘের সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্তৃক প্রস্তাবিত একটি সেইফজোন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে হবে। এই গোঁয়ার মগ দস্যুদের চুড়ান্তভাবে নতজানু না করা পর্যন্ত তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিবেনা। আর অবরোধ আরোপ করলে যদি সেখানকার সামরিক সরকার সু চিকে হটিয়ে আবারো সামরিক শাসন জারি করে, তাহলেও উদ্বেগের কিছু নাই। কারণ সেখানে নামে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, কার্যত উর্দি শাসন এখনও বলবৎ আছে। এবং গণতন্ত্রের প্রকৃত চেহারা অবশ্যই এমন হতে পারেনা। সুতরাং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের প্রতি যতোটুকু কঠোর হওয়া দরকার, ঠিক ততোটুকুই হতে হবে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশের ১০ লাখ রোহিঙ্গার ১ লাখও যদি আমাদের  নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, সেটা বাংলাদেশ এবং ভারত কোন দেশের জন্যেই মঙ্গলজনক হবে না। বিশেষ করে পাকিস্তানসহ কিছু অপশক্তি মুখিয়ে আছে এখানে অস্থিতিশীলতা তৈরী করতে। ভারতকে বুঝতে হবে মিয়ানমারে তাদের সামান্য ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা চিন্তা করে সু চি সরকারকে ছাড় দিলে তারা মস্তবড় ভুল করবে। কারণ মগ রাষ্ট্রটি কার্যতঃ চীনেরই আজ্ঞাবহ দাস। ভারত যদি মনে করে যে কোনো কারণে আমাদের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে মিয়ানমারকে কাছে টেনে নিতে হবে, তাহলে এটি হবে বড়ো মুর্খামি।  কারণ আমরাই হচ্ছি ভারতের পরিক্ষিত বন্ধু, আর বার্মা চীনের সিমানা টানা একটি অঙ্গরাজ্য মাত্র।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই, বাংলাদেশের এক ইঞ্চি মাটিও ভারতের বিপক্ষে ব্যবহৃত হয়না।  এমন যদি হয়, বার্মা সরকারকে শায়েস্তা করার কথা বলে কোনো পক্ষ রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলো, তাহলে তাদের বন্দুকের নল কখন কোনদিকে ঘুরে যাবে, নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। যেটা উভয় দেশেই অস্থিতিশীলতা তৈরীর জন্যে যথেষ্ট।

আর চীনেরও বোঝা উচিত, বাংলাদেশ চীনের শত্রুরাজ্য নয়, বরং বন্ধু রাষ্ট্র।  আমাদের দেশে রয়েছে তাদের পণ্যের অনেক বড় বাজার।  আমাদের অসংখ্য বৃহদাকার প্রকল্পে তাদের বিনিয়োগ এখনও চালু রয়েছে।  সুতরাং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা চাইলেই কিন্তু চীনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি।  কারও প্রতি বৈরীতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, এই পররাষ্ট্র নীতির কারণেই কিন্তু চীনের সাথে বন্ধুত্ব, বাণিজ্য, সব কিছু।  আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অকৃত্রিম সহযোগিতা এবং চীনের বৈরীতা সত্ত্বেও আমরা ন্যায্যতার বিচারে অনেক ক্ষেত্রে ভারতের বদলে চীনের বিনিয়োগ কাজে লাগাচ্ছি।

এতদসত্বেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের এই নীরবতা আমাদের বিস্মিত করে। চীন কেন বোঝেনা রোহিঙ্গাদের প্রতি মগ সরকারের এই এক চোখা নীতি অমানবিক এবং আন্তর্জাতিক নীতি বিরুদ্ধ। মিয়ানমারের ভূখন্ড রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস এবং তারা সে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। ২০ লাখ রোহিঙ্গাকে নাগরিকত্ব দিলে মিয়ানমারের কিচ্ছু আসবে যাবেনা। রাখাইনে চীনা বিনিয়োগ নিরাপদ করতেই সেখানে স্থিতিশীলতা দরকার।  শুধুমাত্র ব্যবসায়িক কারণে একটি জাতি গোষ্ঠীকে নির্মুল করে দেয়াটা কোনোভাবেই সভ্যচিন্তার আওতায় পড়েনা।

অন্যদিকে কতিপয় বিপথগামির জন্যে তো পুরো রোহিঙ্গা সম্প্রদায় সাফার করতে পারেনা। এবং আরাস স্পস্টতই বলেছে তাদের এই অস্ত্র হাতে নেয়া বার্মায় তাদের নিপীড়ন বন্ধ এবং সেখানে তাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। তারাতো আর স্বাধীনতার ডাক দেয়নি। যুগের পর যুগ সামরিক জান্তার বিরামহীন নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির দেয়ালে পীঠ ঠেকে যাওয়ার কারণেই হয়তোবা ওদের মধ্যকার মুষ্ঠিমেয় অংশ অস্ত্র হাতে নিয়েছে এবং সেটা ব্যাপকতর শক্তিশালী কিছু নয়। যদিও তারা অধিকার আদায়ে রাজনৈতিক এবং কুটনৈতিক ভাবেও চেষ্টা করতে পারতো। কিন্তু দূর্ভাগ্য তাদের, কারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে তেমন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি।

অবশ্যই বাংলাদেশ কোনো হিংসাত্মক কর্মকান্ডকে সমর্থন করেনা। বিশ্বে অন্তত এই একটি রাষ্ট্র আছে, যেটি সব সময় শান্তিতে বিশ্বাসী।

এমতাবস্থায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে কেবল চীনই পারে মগ সরকারকে বুঝিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মগদের হুমকী ধামকি না দিয়ে বোঝানো উচিত চীনকে। সু চি কেও বলে লাভ নেই, কারণ মগ রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা সেনাদের হাতে, আর সু চি সেখানে হাতের পুতুল মাত্র।