আত্মপ্রেম, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ‘সেলফি’

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 8 August 2015, 03:19 AM
Updated : 8 August 2015, 03:19 AM

একটি স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট কানেকশন, আর সেলফি– এই হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সার্বক্ষণিক হাতিয়ার বা বাহন। এর মধ্যে 'সেলফি' ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। 'সেলফি', যার অর্থ নিজেই নিজের ছবি তোলা, নানা অঙ্গভঙ্গিমায় নিজের ছবি তুলে মুহূর্তেই তা দেখতে পারার স্বাধীনতা এনে দিয়েছে 'সেলফি'। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর বদৌলতে সেলফি শব্দ ও সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে বহুগুণে। হাটে, মাঠে, ঘাটে, পথে-প্রান্তরে সর্বত্রই আজ 'সেলফি'র জয়জয়কার। দুঃখ, শোকে ম্রিয়মান মানুষও কান্নার মাঝে চট করে ধরে রাখছে তার ওই মুহূর্তের স্মৃতি। আর আনন্দের সময় 'সেলফি' তো এক অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

একথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, মানুষ নিজেকে দেখতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই হয়তো আয়না, স্থিরচিত্রের প্রতি আকর্ষণ কখনও গোপন করতে পারে না। নিজের খুঁটিনাটি বিষয় কিংবা ভঙ্গিমা দেখতে সবার আড়ালে হলেও দাঁড়িয়ে যাই আয়না বা ক্যামেরার সামনে। তবু খুঁতখুঁতানির শেষ নেই। অন্যের সামনে নানা অঙ্গভঙ্গিমায় দাঁড়াতে দ্বিধা কাজ করে অনেকের। এ সমস্যার সমাধান করল একটি নতুন প্রযুক্তি, একটি নতুন শব্দ– 'সেলফি'!

এ অভিনব পদ্ধতি নিজের ছবি তোলার ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাবলম্বী করেছে। এটা এক অর্থে বেশ ভালো ও আনন্দের কথা। ব্যস্ত দুনিয়ায় পরনির্ভরশীলতা যত কম হয় ততই মঙ্গলজনক। কিন্তু সবকিছুতে স্বনির্ভরতা মানুষকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও একা করে তোলে— এ কথাও সত্যি। বিচ্ছিন্নতা মানুষকে করে তোলে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। যূথবদ্ধ হয়ে কাজ করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট করে দেয় এ ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা। বর্তমান বিশ্বের বাজওয়ার্ড– 'সেলফি'– সেলফিশ অর্থাৎ স্বার্থপরের ইংরেজি শব্দের সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায়!

এ আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে তার পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে আলাদা করে দেয়। প্রত্যেক মানুষের চিন্তা-চেতনায় তীব্রভাবে ফুটে ওঠে শুধু ব্যক্তি 'আমি'র প্রতি আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষার জগতে সামগ্রিক বা সামষ্টিকতার যেন ঠাঁই নেই। ফলে একত্র হয়ে কাজ করার মানসিকতাও নষ্ট হতে থাকে। আত্মকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্নভাবে বেঁচে থাকা মানুষ কখনও সমষ্টিগতভাবে কোনো জাতিকে দাঁড় করাতে পারে না। তাই 'সেলফি-ম্যানিয়া'র স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার আগে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবা দরকার। কেননা সামষ্টিকতা ছাড়া ব্যক্তি-মানুষ মূল্যহীন।

অথচ আমরা ইদানিং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি বহুলাংশে। হয়ে পড়ছি অসামাজিক। সমস্ত সামাজিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকছি সব সময়। অনেকটা 'নিজে বাঁচলে বাপের নাম' টাইপের। যার ফলে এখন আর একজনের বিপদে অন্যজন এগিয়ে আসছে না। কিংবা সম্মিলিতভাবে মানুষ এখন আর সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠছে না। এই আত্মকেন্দ্রিকতা, এই অসামাজিকতা আমাদের বিপজ্জনক এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এমনিতেই বর্তমানে আমরা এক অনুদার সংকীর্ণ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করছি। ছোট ছোট ঘর। আকাশ নেই। মাঠ নেই। খোলা জায়গা নেই। মানুষ, বাড়িঘর, আর স্থাপনায় ঠাসাঠাসি এক প্রায়ান্ধকার পরিবেশে আমরা বড় হচ্ছি, বেড়ে উঠছি। আমাদের দৃষ্টিসীমা সংকীর্ণ আর আবদ্ধ নানা স্থাপনায়।

মন বড় হওয়ার জন্য বড় পরিসর চাই। উদার আকাশ, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। বড় বড় বাড়িঘর, উঠোন চাই। চাই বড় মানুষের সান্নিধ্য। কিন্তু এখন সব কিছু ছোট। সারাক্ষণ মোবাইল-ট্যাব-ল্যাপটপ আর পিসির স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা। দৃষ্টিসীমা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ হওয়ায় মনের দিগন্ত কখনও বিস্তৃত হতে পারছে না। ফলে জাতি হিসেবে আমরা রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। শুধু নিজের সুবিধা আদায় করতে গিয়ে যদি অন্য কারও অসুবিধা হয় আমরা তার পরোয়া করছি না।

আমরা ভাগ্যবান যে, একাত্তরে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তখন নিজের চেয়ে দেশের ভাবনা আমাদের কাছে বড় হতে পেরেছিল । যদি এখন মুক্তিযুদ্ধ হত, তাহলে বেশিরভাগ মানুষ হয়তো নিজের কথাই ভাবত!

সমাজে এখন একজন আরেকজনের চোখ উপড়ে নিচ্ছে। খুঁচিয়ে মারছে, পুড়িয়ে মারছে। মানুষ মানুষকে নিপুণ দক্ষতায় হত্যা করছে। একজন আরেক জনের প্রতি চরম নৃশংস আচরণ করছে। আমরা দেখেও দেখছি না। আমাদের আবেগ-অনুভূতিতে এতটুকু সাড়া জাগছে না। একটি শিশুকে গুঁতিয়ে-খুঁচিয়ে মারা হল। কোনো একজন কাজটা করেনি, একদল মানুষ করেছে। একজন আবার এমন নৃশংস দৃশ্য ভিডিও করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোডও করেছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কারও মানবিক অনুভূতিতে এতটুকু করুণার আলোড়ন জাগেনি!

আমরা ক্রমেই যেন ভাবলেশহীন, ভোঁতা, নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছি। ঘটনা ঘটছে, প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছি না। প্রতিরোধ গড়ে তুলছি না। পারলে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। আশ্চর্য এক উদাসীনতা নিয়ে বাঁচতে শিখছি। একজন অন্যায়ভাবে মার খাচ্ছে, কাউকে অপমান করা হচ্ছে, যৌনহয়রানি করা হচ্ছে, কেউ রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে– এমন দৃশ্য দেখেও আমরা চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। প্রত্যেকে আমরা বাঁচি স্রেফ নিজের জন্য, নিজেকে নিয়ে। আমাদের জীবন থেকে 'বহু' হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা সাধনা করছি 'এক'-এর। 'একা', 'আমি', 'আমাকে', 'নিজেকে', 'আমার' জন্য! এখানে 'আমরা' নেই; 'নিজে' ছাড়া 'অপর' নেই। 'সকলে' তো নেই-ই।

অথচ 'সকলে' বা 'আমরা' মিলেই সমাজ। কিন্তু 'আমরা', 'যৌথ' বা 'অনেকের' কথা আর তেমন উচ্চারিত হয় না। সবাই যার যার মতো চলছে, ফিরছে, বাঁচার উপায় করছে। সবাইকে যেন 'আত্মপ্রেম' পেয়ে বসেছে। নিজের সুখ, বিকাশ, প্রকাশ, বিজ্ঞাপন নিয়ে সবাই মেতে উঠছে।

মনে পড়ছে গ্রিক পুরানের কথা। নদীদেবতা সেগিসাস ও জলদেবী লেরিওপের সুদর্শন পুত্রসন্তান নার্সিসাস। অপরূপ তার সৌন্দর্য। নার্সিসাস অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দেবী ইকোর ভালোবাসা। ইকো প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কাছে এই প্রত্যাখ্যানের প্রতিকারের জন্য নালিশ জানান। নেমেসিস নার্সিসাসের ওপর জাদু প্রয়োগ করলে, নার্সিসাস পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, চোখ অন্যদিকে ফেরানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। নিজের প্রেম পড়ে যান তিনি এবং এভাবেই মারা যান।

যেখানে নার্সিসাসের মৃত্যু ঘটে, সেখানে খুব সুন্দর একটি ফুল জন্ম নেয়। ওই ফুল পরিচিত হয় তারই নামে, 'নার্সিসাস'। নার্সিসাস থেকে নার্সিসিজমের ধারণাটি এসেছে। যা মানুষের মধ্যেকার আত্মপ্রেম, আত্মগর্ব ও আত্মশ্লাঘার বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত করে। এই মিথ থেকে ইংরেজি শব্দ 'নার্সিসিজম'এরও জন্ম হয়। এর মানে, নিজের মধ্যে একান্ত অভিনিবিষ্টতা; নিজের সৌন্দর্য ও সক্ষমতার অতিশায়িত অনুভূতি। যা নিজের প্রতি নিমগ্নতা তৈরি করে।

আত্মমগ্নতা আর আত্মপ্রচারণা সেই নার্সিসিজমের নূতন সংস্করণ। রূঢ় হলেও সত্য যে, আধুনিক জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে 'আমি' আর 'আমিত্ব'। এই আমি আর আমিত্ব থেকে চলছে একের সঙ্গে অন্যর অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর অন্তহীন ইঁদুর দৌড়। এই অহংবোধের কারণে মানুষে মানুষে বাড়ছে সীমাহীন দূরত্ব। আর সেটা ঘোচাবার বিকল্প হিসেবে আমরা অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ছি নার্সিসিজমের মায়া-মরীচিকায়। এই অসুস্থতা থেকে যত দ্রুত সম্ভব পরিত্রাণ প্রয়োজন। আত্মমগ্নতায় আচ্ছন্ন নার্সিসাসের প্রতীকী মৃত্যুর মতো মৃত্যু হবে মানবতার; ধ্বংস হবে সভ্যতা।

মোহ কাটিয়ে 'সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে', এই চেতনায় উজ্জীবিত হতে না পারলে সামষ্টিকভাবে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা কিন্তু রয়েই যাবে।