সরকার যখন ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 5 August 2011, 03:10 AM
Updated : 21 August 2015, 08:02 PM

সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের নামে মামলা যেভাবে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবেই তার জামিনেরও ব্যবস্থা হয়েছে। আগে যে আচরণই করুক, জামিন হওয়ার দিন পুলিশ তাকে হাতকড়াও পরায়নি। উল্টো কিছু খাতির করেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে মিডিয়ায়। ফেসবুকসহ মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া না হলে প্রবীর সিকদারকে সহজে ছাড়া হত বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের একাংশেও একে অন্যায় বলে অভিহিত করার ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে। ভদ্রলোকের ওপর রেগেমেগে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফেলেছিলেন, তারা সম্ভবত বুঝে উঠতে পারেননি যে, পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়তে পারে।

প্রবীর সিকদার খোলাখুলিভাবেই আওয়ামী লীগ বা সরকারপন্থী লোক। তারপরও তিনি আক্রান্ত হলেন ফরিদপুরের একাধিক ক্ষমতাবান লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয়। সর্বশেষ তাদের দায়ী করে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন, সত্যি বলতে যা বিধিসম্মত হয়নি। ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে থানায় জিডি না নেওয়ার ঘটনা তো এদেশে বিরল নয়। তাই বলে বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ খুলে ফেসবুকের মুক্ত দেয়ালে কারও বিরুদ্ধে কিছু লিখে দেওয়া যায় না। অনেকে এমনটি করে পার পায় অবশ্য। কিন্তু সাক্ষাৎ ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে লিখেছেন বলে প্রবীর সাহেব পাননি।

ফরিদপুরের ক্ষমতাবানদের অবশ্য উচিত ছিল ব্যাপারটা অন্যভাবে 'অ্যাড্রেস' করা। প্রবীর সিকদার সাংবাদিক হলেও তাদের জোরালো সমর্থক বটে। উপযুক্ত লোকজন বুঝিয়ে বললে তিনি হয়তো ওই স্ট্যাটাস ডিলিট করে দিতেন। সে ক্ষেত্রেও কথা উঠত, কেন তিনি ওই রকম একটা বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবু সেটা কি ভালো হত না যা ঘটেছে, তার চেয়ে? এ নিবন্ধ লেখার সময়ও ফেসবুক উত্তপ্ত দেখছি প্রবীর সিকদারের ঘটনা নিয়ে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ আইনবলে রাষ্ট্রক্ষমতার এমন অপব্যবহার স্বভাবতই মেনে নিতে পারছে না লোকজন। আর খুব কম লোকই তো সংযতভাবে মত প্রকাশ করে। অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে যা খুশি লিখছে।

ব্যক্তিবিশেষ অসংযত হলে তবু চলে– রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের তা হলে চলে না। প্রবীর সিকদারের ঘটনায় এটি আবারও প্রমাণ হল। সত্য যে, প্রবীর সাহেব ফেসবুকে রীতিনীতি মেনে সংযতভাবে লিখেননি। যেসব প্রতিবেদন লিখে তিনি নাম করেছিলেন, সেগুলোও (আমার দৃষ্টিতে) যথাযথভাবে লিখিত নয়। তার অর্থ তো এই নয় যে, একেবারে অসত্য বিবরণ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তার ওপর ভয়ানক হামলা হয়েছিল। তাতে পঙ্গু হয়ে পড়েন প্রবীর সিকদার। এর সুবিচার তিনি পাননি। ওই রকম একটা ঘটনার পর আবার তিনি আক্রান্ত হলেন। এমনভাবে হলেন যে, বোঝাই যায় এতে অত্যন্ত প্রভাবশালী কেউ রয়েছেন, প্রবীর তাকে চটিয়েছিলেন এবং সুযোগ করে দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবহারের। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষ সুযোগ করে দিলেই কি রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমনটি করবেন? তিনি ও তারা এটাও বিবেচনা করেননি যে, প্রবীর শহীদ পরিবারের সন্তান। এ কারণেও আওয়ামী লীগার ও তার সহমর্মীদের অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ ঘটনায় পুলিশ ও নিম্ন আদালতকে যেভাবে জড়ানো হল, সেটাও কি সরকারের জন্য ভালো হল?

এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রবীর সিকদারের নামে করা মামলাটিও হয়তো প্রত্যাহার করা হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের যে ধারায় মামলা করা হয়েছিল, তাতে প্রক্রিয়াগত ত্রুটিও নাকি ছিল। আইনের ওই ধারা নিয়ে নতুন করে আলোচনাও শুরু হল প্রবীর সিকদারের ঘটনায়। এর কাম্য সংশোধন হবে কিনা জানি না। তবে এটা বুঝতে পারছি, রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারে উৎসাহী লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তায় আচ্ছন্ন থেকে সরকারের ভালোটা তারা ভেবে উঠতে পারছেন না।

এ ঘটনার ভেতর দিয়ে ফরিদপুর শহরের একটি বিরাট 'হিন্দুবাড়ি' কিনে নেওয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনাও সামনে এসে গেল। বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে নাকি সেটা কিনেছেন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। তিনি সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে বলেছিলেন, ওখান থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা হবে। প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হলেও তাকে এখন মানুষের কাছে প্রমাণ করতে হবে, ওই বাড়ি বা জমি ক্রয়ের ঘটনাটি স্বচ্ছভাবে ঘটেছিল। 'চাপের মুখে' পানির দামে জমিজমা বিক্রি করে ভারতে চলে যাওয়ার ঘটনা যদি এটি হয়ে থাকে তো সেটি হবে খুব দুর্ভাগ্যজনক।

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, বিশেষত হিন্দুরা কিছুটা হলেও আস্থা ফিরে পায় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে। এক শ্রেণির আওয়ামী লীগারের বিরুদ্ধে হিন্দুর জমি দখলের অভিযোগ ব্যাপকভাবে থাকার পরও এটাই বাস্তবতা। এর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এ অবস্থায় ওই দলের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যদি নতুন করে ওঠে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় 'হিন্দুবাড়ি দখলের' অভিযোগ, সেটা সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানটি সঙ্কটে ফেলবে। বিষয়টি হালকাভাবে দেখার নয়।

আগাম কোনো মন্তব্য বা আন্দাজে কিছু বলতে চাইছি না। এটাও বোধগম্য নয় যে, সরকার এখানে কীভাবে কী নিষ্পত্তি টানবে। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পারিবারিক যোগাযোগ এবং এর মধ্যে অতীত ও বর্তমানের কিছু ঘটনার মাঝে (বুঝে বা না বুঝে) দাঁড়িয়ে গেছেন প্রবীর সিকদার। আর তাকে শাস্তি দিতে গিয়ে সরকারের একটি পক্ষ খুব কাঁচা কাজ করে ফেলেছে। এর ফলশ্রুতিতে লোকে এখন কথা তুলছে একাত্তরে কার কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে।

একাত্তর তথা মুক্তিযুদ্ধের কথা সরকারের লোকজনই সবচেয়ে বেশি বলে থাকেন। তার কাছে এ প্রশ্নে যথেষ্ট স্বচ্ছতা দাবি করাটা তাই অযৌক্তিক হবে না। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধরে যে বিচারে সোপর্দ করতে হবে, তা নিশ্চয়ই নয়। স্বজাতির বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ না করলে বিচারের প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের' দল ও সরকারে তাদের নিরুৎসাহিত করার প্রশ্ন ওঠে নিশ্চয়ই।

ফরিদপুরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ। প্রবীর সিকদারই তার ওপর প্রতিবেদন করেছিলেন বেশ ক'বছর আগে। তাতে কতটা সাংবাদিকতা ছিল আর কতটা অ্যাক্টিভিজম, সে প্রশ্নও রয়েছে। তবে অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। লোকে এখন ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, প্রবীর সাহেবের বিরুদ্ধে গৃহীত সাম্প্রতিক প্রশাসনিক পদক্ষেপের নেপথ্যে ওই বিষয়টিও রয়েছে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যখন চলছে, তখন এ ধরনের একটি ঘটনা সরকারের প্রতিপক্ষের হাতে ইস্যু তুলে দেওয়ার মতো। তারা অবশ্য এমন দুর্বল অবস্থায় রয়েছে যে, সরকারকে 'ওয়াক ওভার' দিয়ে বসে আছে। তবে সরকারের ভেতরে-বাইরে যারা মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তার স্বচ্ছ ও সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থান দেখতে চায়, তারা ছেড়ে কথা বলছে না। এদের সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্পর্কের অবনতি কিন্তু দেখতে পাওয়া গেল প্রবীর সিকদারের ঘটনায়।

মামলা প্রত্যাহারই তাই এখানে একমাত্র করণীয় নয়। এটা প্রত্যাহার করে অবশ্য পুরো বিষয়টির এক ধরনের নিষ্পত্তি সম্ভব। সেটা হবে 'এক ধরনের নিষ্পত্তি' আর এতে কিছু প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে না। প্রশ্নগুলো এতটা তীব্রভাবে উঠে আসত না প্রবীর সিকদার ও রকম একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার মতো ভুল না করলে; অতঃপর রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি না ঘটলে।

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েই এখন স্থির হতে হবে, এ ঘটনার কী ধরনের নিষ্পত্তি তার জন্য ভালো। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ভেতর এমনতরো ঘটনায় কোনো বিরক্তি বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই, এটি মনে করা যাবে না। তারা এমনটাও মনে করতে পারেন, দলে বিশেষ প্রভাবশালী গোষ্ঠীর উত্থানে সরকারের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। এর সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে তারা শঙ্কিতও হতে পারেন। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সম্প্রতি এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন একটি দলীয় সমাবেশে।

প্রবীর সিকদারকে ঘিরে যা ঘটে গেল, তার শিক্ষাটি অস্পষ্ট নয়। সরকার ওটা নেবে কিনা কিংবা কতটা নেবে, সেটা অবশ্য তার বিবেচনার বিষয়। পর্যবেক্ষক হিসেবে আমরা শুধু পারি নিজেদের মতামত তুলে ধরতে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।