অজিত রায়: আমার জানলা দিয়ে দেখা আকাশ

শনিবারের চিঠি
Published : 5 Sept 2011, 03:46 AM
Updated : 5 Sept 2011, 03:46 AM

উপসংহার

.. ..আশি, উনআশি, আটাশি, সাতাশি.. ..পঞ্চান্ন, চুয়ান্ন.. ..সাতচল্লিশ.. ..বাইশ, একুশ, কুড়ি, ঊনিশ, আঠারো.. ..সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক। এক। এক।.. ..এক।

ছায়াপিণ্ড উত্তর দিলো- এক নয়; শূন্য।

লাইফ সার্পোট সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

কথাটির পুনরাবৃত্তি করলো আরও কয়েকজন।' লাইফ সার্পোট'।

দুইটি দীর্ঘশ্বাস। একটি দীর্ঘ; অন্যটি ছোটো- অতো দীর্ঘ নয়।

হি ইজ নো মোর- গোছানো ইংরেজী বক্তব্য।

ইয়েস- রিয়েলি আনফরচুনেট- নির্লিপ্ত স্বীকারোক্তি।

লেটস মিট দ্যা প্রেস- সবশেষে চিরায়ত সিদ্ধান্ত।

ক্ল্যামোফেজ

ভিড় বাড়ছে। পরিচিত, শুভানুধ্যায়ীদের ভিড়। নানান রঙে সবার মাঝেই বিষাদ নিবিড় আলিঙ্গনে ছেয়ে আছে। কথোপকথন চলছে; কিন্তু মৃদু। কেউ কেউ উচ্চস্বরে কাঁদছেন। কারও কারও চোখে 'কনট্রোল্ড' জল। বাদবাকিদের সয়ে গেছে।

এতো বেশি চলে যাবার মিছিল, সবার জন্যে কাঁদতে গেলে চোখের জল শুকিয়ে যাবে।

এক ফটোজার্নালিস্ট একটার পর একটা ছবি তুলে যাচ্ছেন। আজকাল কারো মৃত্যু হলে ভালোই হয়; একসাথে সব সেলিব্রেটিদের পাওয়া যায়। শোকের একটা মেক-আপ নেয়া থাকে। শোনা যায়- আজকাল নাকি বিউটি পার্লারগুলোতে শোকের মেক-আপ নেয়ার একটা প্যাকেজ থাকে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।

'রাষ্ট্রীয় মর্যাদা'য় সমাহিত করতে হবে। উনি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা। কথাটি বলার সাথে সাথেই 'রাষ্ট্রীয় মর্যাদা' এসে হাজির। পিটি-প্যারেড করে সে তার শরীরের জড়তা কাটিয়ে নিলো।

ঘটনার দিনের টেলিভিশন সংবাদ ভাষ্য

বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী অজিত রায় আর নেই। আজ রোববার (০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১) বেলা একটা পাঁচ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনকভাবে খারাপ হওয়ায় তাঁকে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়। আইসিইউ'র প্রধান ওমর ফারুক জানান, অজিত রায় পরলোকগমন করেছেন। কাল সোমবার (০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অজিত রায়ের মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহিদ মিনারে রাখা হবে।

ঘটনার পরের দিনের সংবাদপত্রের ভাষ্য

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী এবং বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধক অজিত রায় আর নেই। গতকাল রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ বেলা দশটায় তাঁর মরদেহ শহিদ মিনার চত্বরে রাখা হবে। তাঁর বাড়ি রংপুরে।

গতকাল শনিবার থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন ছিলো। অজিত রায়কে বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছিলো। আজ সকালে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর হূদযন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে না। পাশাপাশি আরও কিছু শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়েছে।

এর আগে অজিত রায়ের মেয়ে শ্রেয়সী রায় জানিয়েছিলেন, গতকাল তাঁর ব্রঙ্কোস্কোপি করা হয়েছে। অজিত রায় দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছেন। কোলকাতায় তাঁর ফুসফুসে দুবার অস্ত্রোপচার করা হয়।

বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী অজিত রায় অসংখ্য গানের সুর করেছেন। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শিল্পী ও সুরকার।

ঘটনার পরের সপ্তাহে সংবাদপত্রের ফিচার পাতাগুলোর ভাষ্য

শ্রী অজিত রায় ১৯৩৮ সালের ২৯শে জুন রংপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াশুনা করেন। অজিত রায়ের সঙ্গীত জীবনে সাফল্যের পেছনে তাঁর মা কণিকা রায় অপরিমেয় প্রভাব রেখেছেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি তবলা বাজানো এবং নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে সুর ও স্বরের সাধনা শুরু করেন।

কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়নের সময় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় তিনি সঙ্গীত বিভাগে তিনটি বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। গান শেখার প্রেরণা ছিলো ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন। ষাট দশকের মাঝামাঝি হতে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করে একটি করে নূতন গান করে আসছেন তিনি। এই রকমই একটি গান ছিলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিদ্রোহী কবিতায় আলতাফ মাহমুদের সুর করা গান।

রংপুরে থাকাকালীন ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শত বার্ষিকী অনুষ্ঠানে 'চন্ডালিকা' গীতিনাট্যে 'আনন্দ' এর ভূমিকায় অংশগ্রহণ করে তিনি ভূয়ষী প্রশংসা অর্জন করেন। তখন থেকেই তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত সাধনায় ব্রতী হন।

শ্রী অজিত রায় ১৯৬২ সালে ঢাকায় আসেন। ১৯৬৩ সালে রেডিওতে ও পরবর্তীতে টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শ্রী রায় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে সুপরিচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময় শ্রী অজিত রায় কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় ও সংগ্রামী গান গেয়ে সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য জনগণকে উজ্জীবিত করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে যেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রী অজিত রায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতারে চাকুরি গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৫ সালের ৯ অক্টোবর চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সঙ্গীত শিল্পী শ্রী অজিত রায় ১৯৭২ সালে বাঙলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে ভারত এবং ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন।

শ্রী অজিত রায় বিভিন্ন সময় বুলবুল ললিতকলা একডেমী, ছায়ানট, সংগীত মহাবিদ্যালয় ও উদীচি-তে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে সুখেন্দু চক্রবর্তীর সঙ্গীত পরিচালনায় 'রিপোর্টার' ছায়াছবিতে তিনি প্রথম কন্ঠদান করেন ৷ এছাড়াও 'জীবন থেকে নেয়া' , 'কোথায় যেন দেখেছি' , 'যে আগুনে পুড়ি' , 'আমার জন্মভূমি' , 'কসাই' প্রভৃতি ছায়াছবিতেও তিনি কন্ঠদান করেছেন।

গত ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১ সালে দুপুরে তিনি বারডেম হাসপাতালে পরলোকগমন করেন।

ঘটনার পরের বছরগুলোতে সংবাদপত্রের ভাষ্য

২০১২: সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় ছবিসহ এক কলামের খবরে প্রকাশ "রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী অজিত রায়ের প্রথম প্রয়াণ দিবস আজ। গত বছরের এই দিনে বারডেম হাসপাতালে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।"

২০১৩: সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় ছবিসহ এক কলামের খবরে প্রকাশ "রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী অজিত রায়ের প্রয়াণ দিবস আজ। ২০১১ সালের এই দিনে বারডেম হাসপাতালে তিনি পরলোকগমন করেন।
.. ..
.. ..
২০২০: সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠায় ছবি ছাড়া এক কলামের খবরে প্রকাশ "রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী অজিত রায়ের প্রথম প্রয়ান দিবস আজ"।
.. ..
.. ..
২০৩০: সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠায় ছবি ছাড়া এক কলামের খবরে প্রকাশ "রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী অজিত রায়ের প্রথম প্রয়ান দিবস আজ"।
.. ..
.. ..
২০৪০: সংবাদপত্রের কোনো এক না-দেখা কোণায় খবরে প্রকাশ "আজ অজিত রায়ের মৃত্যুদিন"।
.. ..
.. ..
২০৪৫: অজিত রায়ের প্রয়ান দিবসের কোনো খবর বাঙলা কিংবা ইংরেজী দৈনিকে প্রকাশিত হবে না।

অতঃপর ২১৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের এক বিকেলের গল্প

বাঙালির বিজয় অর্জনের দুইশত বছর উদযাপন। সারা বাঙলায় মহোৎসব। পৃথিবী তাকিয়ে থাকবে এই উৎসবের দিকে। সারা বাঙলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় বিদেশী সাংবাদিকদের ক্যামেরা ঝোলানো অচেনা গড়ন। রাস্তাঘাট, পার্ক, ময়দান সবখানে উড়ছে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। সারা পৃথিবী জুড়ে বাঙলাদেশ তখন এক নান্দনিক কবিতার নাম। ইতোমধ্যেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হচ্ছে। উন্নিশো একাত্তরকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশ্বমানের তথ্যচিত্র। সেদিন এই তথ্যচিত্রগুলো দেখানো হবে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। পৃথিবীর কাছে বাঙালি মানেই এক দুর্বার সংগ্রামের নাম, বাঙালি মানেই এক অবিনাশী কণ্ঠস্বর; ৭ই মার্চ সারা পৃথিবীর মানুষের দুর্বার মুক্তির সনদ।

তাই ২১৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর কেবল বাঙালির নয়, সে-ই দিন হবে সারা পৃথিবীর মানুষের। ঘরে ঘরে থাকবে জাতীয় পতাকা, উড়বে আকাশে। সে-ই দিন কোনো এক বাড়ির ছাদে বসে গল্প করবেন এক মা ও তাঁর শিশু। মায়ের কোলে বসে শিশু শুনবে একাত্তরের গল্প। অবাক বিস্ময়ে শিশু জানতে চাইবে- মা এতো কিছু তুমি কীভাবে জানলে?

মা হেসে উত্তর দেবেন- কেনো? আমার মায়ের কাছ থেকে।

শিশু আবার জানতে চাইবে- তোমার মা কোত্থেকে জানলো?

মা তখন শিশুকে নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে বলবেন- তিনি জেনেছিলেন একটি গান থেকে। দেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম যে গানটি লেখা হয়েছিলো, সেইটার সাথেই জড়িয়ে আছেন এক মানুষ। শহীদুল ইসলাম লিখেছিলেন 'বিজয় নিশান উড়ছে ওই' গানটি। সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। আর গেয়েছিলেন ১০-১৫ জন শিল্পী। গানটির লিড ধরেছিলেন অজিত রায়। সেই গানটিই আমার মাকে শিখিয়েছিলো একাত্তরের ইতিহাস।

তারপর মা কাজে চলে গেলেন। শিশু বসে রইলো ছাদে। বাতাসে উড়ছে পতাকা। নিবিড় উড়ছে পতাকা। পতাকার উপরে নীল আকাশ।

শিশুর কণ্ঠে তখন গান- 'বিজয় নিশান উড়ছে ওই' । বিজয়ের দুইশ বছরেও অজিত রায় এসেই লিড ধরলেন শিশুটির সাথে।

১২ ভাদ্র, ১৪১৮