ঢাকা সিটি বিভক্ত করার সহজ উপায়…

শফিক রেহমান
Published : 3 Dec 2011, 03:48 PM
Updated : 3 Dec 2011, 03:48 PM

স্থান : উত্তরা সেক্টর ওয়ান গোল চত্বরের কাছাকাছি সিএনজি স্ট্যান্ড।
কাল : সকাল বেলা ২৯ নভেম্বর ২০১২
পাত্র : একজন সাধারণ ব্যক্তি, সিএনজি ড্রাইভার, ব্যাংক ম্যানেজার ও বিজনেসম্যান।

প্রথম দৃশ্য

ব্যক্তি (একটি সিএনজি থৃ হুইলারের সামনে গিয়ে ড্রাইভারকে ) : যাবেন নাকি?
সিএনজি ড্রাইভার : কোথায় স্যার?
ব্যক্তি  : কাকরাইলে।
ড্রাইভার : কাকরাইল কোথায় স্যার? উত্তর ঢাকায়? নাকি দক্ষিণ ঢাকায়?
ব্যক্তি  (বিরক্ত স্বরে) : কাকরাইল কাকরাইলে। রমনা থানার মধ্যে।
ড্রাইভার : সেটা জানি স্যার। কিন্তু উত্তর না দক্ষিণ ঢাকায়?
ব্যক্তি  : আমি জানি না। হতে পারে দক্ষিণ ঢাকায়।
ড্রাইভার : বেয়াদবি মাফ করবেন স্যার। আজ রাজধানী ঢাকা শহর বিভক্তির এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উৎসব আয়োজনের ব্যবস্থা করেছে। (উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার মধ্যে কাটাতারের বেড়াসহ একটি ম্যাপ দেখিয়ে) ওই যে দেখুন স্যার, পোস্টারে পোস্টারে দেয়াল ছেয়ে গেছে। লক্ষ্য করুন পোস্টারের স্লোগান, হাসো বাঙালি হাসো। রাজধানীর নাগরিকদের উন্নততর সেবা দানের লক্ষ্যে গত বছর এই দিনে ঢাকা সিটি দুই ভাগ করা হয়েছিল। আজ তারই বর্ষপূর্তি। আওয়ামী লীগ সরকার মনে করছে ঢাকা শহর বিভক্তিতে নগরবাসী গত এক বছর খুব ভালো সেবা পেয়েছে। তাই তাদের হাসতে বলা হয়েছে ওই পোস্টারে। (স্বরটা একটু নিচু করে) আসি স্যার গত চার বছর যাবৎ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, কাদো বাঙালি কাদো স্লোগানে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আজ সকাল বেলায় এসব পোস্টার দেখে হাসতে চেষ্টা করেছি। পারিনি।
ব্যক্তি  (কাষ্ঠহাসি মুখে) : কেন পারেন নি?
ড্রাইভার : কারণ স্যার গত এক বছর অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। সেবার বদলে, আমরা, বিশেষত সিএনজি ড্রাইভার, ট্যাক্সি ড্রাইভার, ক্যাব ড্রাইভার, ট্রাক ড্রাইভাররা অনেক কষ্ট পেয়েছি।
ব্যক্তি  : কী কষ্ট?
ড্রাইভার : গত বছর ঢাকা সিটি বিভক্তির আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই পহেলা ডিসেম্বরে নগর ভবনে সহিংস সংঘর্ষের পর থেকে  বহু সমস্যায় পড়েছি আমরা।
ব্যক্তি  : ৪ ডিসেম্বরে বিএনপির হরতাল, তারপর সব বিরোধী দলগুলোর লাগাতার আন্দোলন, সুশীল সমাজের সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, এসবের জন্য আপনি সমস্যায় পড়েছেন?
ড্রাইভার : না স্যার। আমি বলছি চাঁদাবাজির কথা। ঢাকা সিটি বিভক্তির পর থেকে আমরা ড্রাইভাররা চাঁদাবাজিতে অস্থির হয়ে গিয়েছি। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে গত বছরে নভেম্বরে ঈদ-উল আজহার সময়ে ঢাকায় পশুর হাটে কোরবানীর পশু প্রায় ছিলই না। এর একটা কারণ ছিল ইনডিয়া থেকে ঢাকায় গরু-ছাগল নিয়ে আসার সময়ে মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজি। ঢাকা সিটি ভাগ হয়ে যাবার পর সেই চাঁদাবাজরা আরো বেশি সুযোগ পায়। তারা শুধু এক জেলা থেকে এক জেলায় পশু ও মালামাল পরিবহনে চাঁদা আদায় নয়, উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার মধ্যে সব চলাচলের ওপর চাঁদাবাজি শুরু করে দেয়। আপনি জানেন স্যার, তারপর আওয়ামী সরকার এই চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার মধ্যে কাটাতারের বেড়া দিয়ে সীমানার কয়েকটি স্থানে টোল গেইট বসানোর কাজ শুরু করেছিল। গতকাল সেসব কাজ শেষ হয়েছে। আজ থেকে শুধু নির্দিষ্ট টোল গেইটের মধ্য দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার মধ্যে চলাচল সম্ভব হবে। আজকের সব দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়ে পূর্ণ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। ওই বিজ্ঞাপনে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবিসহ ঢাকার দুই মেয়রেরও ছবি ছাপা হয়েছে। আপনি দেখেন নি স্যার?
ব্যক্তি  : (বিব্রত স্বরে) : না। আজকের পত্রিকা এখনো দেখা হয়নি।
ড্রাইভার : সরকার মনে করছে এই কাটাতারের বেড়া এবং টোল গেইটের ফলে একদিকে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে আর অন্য দিকে সরকারের আয় হবে। কাটাতারের বেড়ার আইডিয়াটা বোধহয় ইনডিয়া থেকে নিয়েছে আওয়ামী সরকার।
ব্যক্তি  : হতে পারে। কিন্তু, আপনি এখনো বলেন নি, কেন জানতে চাইছিলেন আমি উত্তর ঢাকায়, নাকি দক্ষিণ ঢাকায় যাবো?
ড্রাইভার : যদি আপনি বর্ডার ক্রস করেন স্যার, তাহলে টোল গেইট ফি আপনাকে দিতে হবে। তাছাড়া আমরা এত বছর সিএনজি চালিয়েও বুঝতে পারছি না শহরের কোন রাস্তা কোন ভাগে অবস্থিত। সাদেক হোসেন খোকা সাহেব তো মৃত ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, যেমন জিয়া ও সিআর দত্ত, জীবিত পলিটিশিয়ান যেমন, রাশেদ খান মেনন, জীবিত সাংবাদিক যেমন, এ বি এম মূসার নামে রাস্তার নাম দিয়ে গিয়েছিলেন। তেমনি যদি সরকার এখন প্রতিটি রাস্তার নামের পেছনে উ: ঢাকা অথবা দ: ঢাকা লিখে দিত তাহলে আমাদের কাজে সুবিধা হতো। এতে সাইনবোর্ড লেখার ব্যবসায়ে প্রচুর কর্মসংস্থান হতো। একই সঙ্গে সরকার সকল ড্রাইভারকে একটা কম্পাস ও একটা ম্যাপ ফৃ সাপ্লাই দিলে কাস্টমারদের সঙ্গে তর্কাতর্কি বন্ধ হতো। সবসময় সূর্য দেখে তো দিক বোঝা সম্ভব নয়। এ বছর বর্ষাকালে একটানা দুই সপ্তাহ সূর্য আমরা দেখিনি। তখন বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল আমরা কোন দিকে যাচ্ছি। কম্পাস আর ম্যাপ থাকলে সেবা দেয়া সুবিধাজনক হতো। প্যাসেঞ্জাররা তর্ক করতে পারতেন না, কোন রাস্তার কোন ঢাকায়?

ব্যক্তি : নাম বদলে আগ্রহী ও পারদর্শী এই সরকারের অবশ্যই এটা বিবেচনা করা উচিত ছিল। যাই হোক, আমার ধারণা কাকরাইল পড়েছে দক্ষিণ ঢাকায়।

ড্রাইভার (সিএনজির দরজা খুলে দিয়ে) : ওঠেন স্যার।

ব্যক্তি পেছনের সিটে গিয়ে বসলো।
সিএনজিতে স্টার্ট দিল ড্রাইভার।
ওরা উত্তর শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট পেরিয়ে গেল।

দ্বিতীয় দৃশ্য

উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার সীমান্তে টোল গেইটের সামনে।
সেখানে ছিল শত শত সিএনজি, প্রাইভেট কার, কোচ ও ট্রাকের লম্বা লাইন।

ব্যক্তি (চিন্তিত স্বরে) : এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?
ড্রাইভার : বলা মুশকিল স্যার। টোল গেইটের অপর দিকে দেখছি দক্ষিণ ঢাকা পুলিশ বাহিনীর পাইলট কার। মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী আজ এখন ফিরছেন। তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। উত্তর শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে উত্তর ঢাকা পুলিশ বাহিনীর পাইলট কার তাকে এখানে পৌছে দেবে। টোল গেইটের অপর দিক থেকে দক্ষিণ ঢাকা পুলিশ বাহিনীর পাইলট কার তখন প্রধানমন্ত্রীকে তার বাসভবনে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব নেবে। প্রধানমন্ত্রীর কনভয় চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সবাইকে এখানে আটকে থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু ১ টোল গেইট এয়ারপোর্টের কাছে। তাই এখানে বেশি জ্যাম হয়। বঙ্গবন্ধু ২, ৩, ৪, ৫ ইত্যাদি অন্য সব টোল গেইটে একটু কম জ্যাম হয়।
ব্যক্তি : দেখছি দক্ষিণ ঢাকা পুলিশ বাহিনীর পাইলট কারের হতশ্রী অবস্থা।
ড্রাইভার : উত্তর ঢাকা পুলিশ বাহিনীর গাড়িগুলো সব নতুন, চকচকে। উত্তর ঢাকার আর্থিক অবস্থা তো ভালো। তাই উত্তর ঢাকা পুলিশ বাহিনীর গাড়িও ভালো।
ব্যক্তি : হুম। এজন্যই গত কয়েক মাস যাবৎ দক্ষিণ ঢাকায় খুব অস্থিরতা চলছে। এই বিসদৃশ বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ ঢাকায় দক্ষিণ শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন।
ড্রাইভার : একটা প্রশ্ন করবো স্যার?
ব্যক্তি : করুন।
ড্রাইভার : বিদেশে কারো জীবিত অবস্থাতে তার নামে কি কোনো রাস্তা হয়?
ব্যক্তি : যতো দূর জানি, হয় না। কারণ কোনো ব্যক্তির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়, চূড়ান্ত বিচারে ওই ব্যক্তিটি শ্রদ্ধাভাজন হবেন কিনা, যে তার নামে একটি রাস্তা হতে পারে। দেখুন, মেনন সাহেবের নামে যখন রাস্তাটি হয়েছিল তখন হয়তো তিনি কারো কারো কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভিকারুন নিসা গার্লস স্কুলে ভর্তি বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ওঠে। এই অভিযোগ সত্য হোক মিথ্যা হোক এটা মানতে হবে যে মেননের প্রতি শ্রদ্ধা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আর এ জন্যই কোনো জীবিত ব্যক্তির নামে কোনো রাস্তা হওয়া উচিত নয়। আমার এক বস ছিলেন যিনি কোনো ব্যক্তিকেই ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দিতেন না। তার যুক্তি ছিল, আজ যে ব্যক্তি ভালো, আগামীকাল সেই ব্যক্তি খারাপ রূপে প্রতিভাত হতে পারে। তখন ক্যারেকটার সার্টিফিকেটের অপব্যবহার হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর বিরাট কনভয় এল এবং টোল গেইট পেরিয়ে গেল।
উত্তর ঢাকা পুলিশ বাহিনীর চকচকে দামি গাড়িগুলো ফিরে গেল।
দক্ষিণ ঢাকা পুলিশ বাহিনীর হতশ্রী গাড়িগুলোর পাহারাধীনে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় চলে গেল।
অপেক্ষমাণ সব সিএনজি, কার, কোচ ও ট্রাকগুলো সশব্দে স্টার্ট দিল।

তৃতীয় দৃশ্য

কাকরাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজারের রুম।

ব্যাংক ম্যানেজার (স্মিত মুখে প্রবেশমান ব্যক্তির প্রতি) : আসুন। আসুন। বসুন স্যার। আজ ব্যাংকে খুব ভিড়। ঢাকা সিটি বিভক্তিকরণের প্রথম বছর পূর্তি উপলক্ষে অনেক ক্লায়েন্ট এসেছেন। একটু ধৈর্য ধরতে হবে স্যার আপনাকে। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড স্যার।
ব্যক্তি (চেয়ারে বসে) : না। না। মাইন্ড করার কি আছে। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ। এটাই তো হওয়া উচিত। আমি পরে এসেছি, আমাকে পরে সার্ভ করবেন।
বিজনেসম্যান ক্লায়েন্ট : আপনার মতো সবাই যদি ভদ্র আর জেন্টলম্যান হতো তাহলে দেশটা অন্য খানে আজ থাকতো। (গলার স্বর নামিয়ে এনে, প্রায় ফিশ ফিশ করে) ওই যে দেখছেন বঙ্গবন্ধু কোট পরা আওয়ামী নেতাকে। উনি আসার পর গোটা ব্যাংকই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে ওনাকে আগে সার্ভ করতে। দেখবেন ম্যানেজার সাহেব তাকে কীভাবে খুশি রাখার চেষ্টা করছেন।
ব্যক্তি : (বিস্মিতভাবে) : আরে! উনি তো শুধু আওয়ামী নেতাই নন, মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বটে। উনি গত বছর ঢাকা সিটি বিভক্তির পর টিভি টক শোতে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, "ঢাকাকে বিভক্ত করা হয়নি। জনগণের সেবা বাড়ানোর জন্যই ঢাকা সিটি কর্পরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।… লন্ডন শহর ৩৬ ভাগে বিভক্ত। নিউ ইয়র্ককে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।… যারা টেলিভিশনের বিভিন্ন টক শোতে ঢাকা সিটি কর্পরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করার কথা বলছেন, তারা জ্ঞানপাপী। তারা এসব নগরের ইতিহাস জানেন না, বিশ্বের ইতিহাস জানেন না।… তাদের সঙ্গে আমরা এসব বিষয়ে বিতর্ক করতে প্রস্তুত আছি।" তার এই কুখ্যাত উক্তির পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি জ্ঞানপাপী নন, তিনি অজ্ঞানপাপী!
বিজনেসম্যান : মানে?
ব্যক্তি : তিনি সর্বসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি অজ্ঞ। শুনুন তাহলে।

১৮৮৯ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত লন্ডন কাউন্টি প্রশাসনের দায়িত্বে ছিল লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল, সংক্ষেপে এলসিসি (LCC) । সেই সময়ে সেটাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চাভিলাষী মিউনিসিপাল অথরিটি। বর্তমানে লন্ডন শহরের যে কেন্দ্রীয় এলাকাটি ইনার লন্ডন (Inner London) নামে পরিচিত, মূলত: সেই স্থানটিকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল এলসিসি।
কালক্রমে যখন লন্ডনের জনসংখ্যা ও পরিধি চারদিকে আরো বেড়ে যায় তখন লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল বা এলসিসি বিলুপ্ত করে ১৯৬৫-তে গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিল, সংক্ষেপে জিএলসি (GLC) সৃষ্টি করা হয়। জিএলসির প্রশাসনিক আওতায় নিয়ে আসা হয় ইনার লন্ডন এবং আউটার লন্ডনকে (Outer London)। লোকাল গভর্নমেন্ট আইন ১৯৮৫-তে জিএলসিকে বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৮৬-তে জিএলসি-র সব ক্ষমতা দেয়া হয় লন্ডনের ৩২টি বিভিন্ন বরোকে (Borough)। অর্থাৎ বলা যায় তখন লন্ডন ভাগ হয়ে যায় ৩২ ভাগে। এর কারণ ছিল তদানীন্তন টোরি প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের তীব্র জিএলসি বিদ্বেষ। তখন জিএলসি পরিচালিত হচ্ছিল বিরোধী লেবার পার্টির শক্তিশালী ও জনপ্রিয় মেয়র কেন লিভিংস্টোন দ্বারা। মার্গারেট থ্যাচার ভেবেছিলেন জিএলসি বিভক্ত করলে রাজধানী লন্ডনে বিরোধী লেবার পার্টির দুর্গও ভেঙে যাবে।

জিএলসি বিলুপ্তকরণ এবং লন্ডন বহু ভাগে বিভক্তকরণ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ১৯৮৫-তে তীব্র সমালোচনা হয়। কিন্তু খুব অল্প ভোটের ব্যাবধানে লোকাল গভর্নমেন্ট আইন ১৯৮৫ পাস হয়। মার্গারেট থ্যাচারের জিএলসি বিদ্বেষ সেখানেই থেমে থাকেনি। তিনি জিএলসি-র কেন্দ্রীয় দফতর কাউন্টি হল বা নগর ভবনটিও বিক্রি করে দেন একটি জাপানিজ এনটারটেইনমেন্ট কম্পানির কাছে।
কিন্তু লন্ডন বিভক্ত হয়ে যাবার পরপরই বিভিন্ন অভাবিত সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, ফায়ার সার্ভিসের পরিচালনায় কোন বরো থাকবে? এসব প্রশাসনিক দায়িত্ব নির্বাহ করতে প্রায় ১০০টি সার্ভিস সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
লন্ডন প্রশাসন ঝুলে পড়ে।

বিরোধী লেবার পার্টি প্রতিশ্রুতি দেয় তারা বিজয়ী হলে লন্ডনকে কেন্দ্রীয়ভাবে মাত্র একটি অথরিটির অধীনে পরিচালনা করবে। ১৯৯৭-এ টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে লেবার পার্টি বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। লন্ডন কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে লেবার পার্টি পার্লামেন্টে বিল এনে এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং তারা জনমত যাচাইয়ের জন্য ১৯৯৯-এ একটি গণভোটের আয়োজন করে। এই গণভোটে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পড়ে লন্ডনে একটি নতুন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পক্ষে।

এরই পরিণতিতে গ্রেটার লন্ডন অথরিটি সংক্ষেপে জিএলএ (GLA) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। তবে জিএলসির সঙ্গে জিএলএ-র কিছু তফাৎ হয়। জিএলএ-তে মেয়র নির্বাচিত হন সরাসরি ভোটে। কেন লিভিংস্টোন আবারও মেয়র নির্বাচিত হন।
বর্তমানে লন্ডন প্রশাসনের দায়িত্বে রয়েছে গ্রেটার লন্ডন অথরিটি, সংক্ষেপে জিএলএ (GLA)। পার্লামেন্টে জিএলএ আইন ১৯৯৯ পাস হবার পর এটি কার্যকর হয় ৩ জুলাই ২০০০ থেকে।
পরবর্তীকালে জিএলএ আইন ২০০৭ পাস হবার পর লন্ডনের মেয়র এবং লন্ডন অ্যাসেম্বলিকে আরো বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়; বিশেষত, আবাসন বা হাউজিং প্ল্যানিং, ক্লাইমেট চেঞ্জ, বর্জ্য পদার্থ, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে। london.gov.uk ওয়েবসাইটে গেলেই আরো জানা যাবে, লন্ডন প্রশাসনের জন্য জিএলএ আরো অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হবার সুযোগের প্রতি ফোকাস রেখেছে। বৃহত্তর জিএলএ গ্রুপ, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকার, দাতব্য সংস্থা থেকে শুরু করে প্রাইভেট সেক্টর কম্পানিগুলোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জিএলএ কাজ করছে ( We focus on the opportunities a joined-up approach to governing London bring to our great city. We also work with other organisations including the wider GLA group, local and central government and a range of other bodies from charities to private sector companies ).

পরবর্তীকালে জিএলএ-র মেয়র নির্বাচনে হেরে যান কেন লিভিংস্টোন। বর্তমান মেয়র টোরি পার্টির বরিস জনসন যিনি আগে সাংবাদিক ছিলেন।

লন্ডন শহর অতীতে কীভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং বর্তমানে কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেটা পর্যালোচনা করলে জানা যাবে :
এক. ১৯৮৯ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত এটি পরিচালিত হয়েছে এলসিসি দ্বারা।
দুই. শহরের পরিধি বেড়ে যাবার পর লন্ডনকে ভেঙে দুই ভাগ করা হয়নি। বরং জিএলসি তৈরি করে প্রশাসনের প্রসার ঘটানো হয়েছিল।
তিন. মার্গারেট থ্যাচারের বিরোধী দলের প্রতি তীব্র বিদ্বেষের ফলে রাজনৈতিক কারণে জিএলসি ভেঙে ৩২টি বরো-কে লন্ডন চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু থ্যাচার ও টোরি পার্টির এই রাজনৈতিক চাল প্রশাসনিক সমস্যায় জর্জরিত হয়। ১৯৯৭-এর নির্বাচনে টোরি পার্টির শোচনীয় পরাজয় হয়।
চার. লন্ডনে ফিরে আসে একটি মাত্র মেয়রের অধীনে একটি মাত্র প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ জিএলএ।
তবে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী লন্ডনকে তাদের দাফতরিক কাজে বিভক্ত করেছে। যেমন টেলিফোন কম্পানিগুলো ইনার লন্ডনের কোড নাম্বার শুরু করেছে সাত (৭) এবং আউটার লন্ডনের কোড নাম্বার শুরু করেছে আট (৮) দিয়ে। আবার লন্ডনের পাতাল রেল বা আন্ডার গ্রাউন্ড টিউব কর্তৃপক্ষ লন্ডনকে ছয়টি জোনে বিভক্ত করেছে। জোন ওয়ান-এর মধ্যে বা সেন্ট্রাল লন্ডনে চলাচলের ভাড়া সবচেয়ে কম। আর জোন ওয়ান থেকে জোন সিক্স-এ যাওয়ার ভাড়া সবচেয়ে বেশি।

মোটকথা, লন্ডন যে এখন একটাই মেয়র এবং একটাই প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা শাসিত হচ্ছে তা এই অজ্ঞানপাপী জানেন না। নিউ ইয়র্ক বিষয়ে তাকে জ্ঞান দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। তাদের জ্ঞান দিয়ে কোনো লাভ নেই। তারা যা বিশ্বাস করতে চায় সেটাই তারা করে।
বিজনেসম্যান (প্রচন্ড বিস্মিত) : তাহলে এই আওয়ামী নেতা একটা বিশাল চাপাবাজি করেছেন, বাঙালকে লন্ডন দেখিয়েছেন? শেখ হাসিনাও তো বলেছেন লন্ডনে দুটি সিটি কর্পরেশন আছে।
ব্যাক্তি : এরা দুজনই পলিটিক্স করেছেন। ঈশ্বর এদের ক্ষমা করুন।
বিজনেসম্যান : ঈশ্বর ওদের ক্ষমা করলেও আমি তো ক্ষমা করতে পারবো না। এই উত্তর আর দক্ষিণ ঢাকার ফ্যাসাদে পড়ে আমার অনেক টাকা লস হয়ে গিয়েছে। আমার গ্রুপ অফ কম্পানিজের সব লেটারহেড নতুন করে ছাপতে হচ্ছে। জানি না আমার বার্থ সার্টিফিকেট, আইডি কার্ড যেখানে শুধু ঢাকা লেখা আছে, সেসব নতুন করে করতে হবে কি না। কিন্তু ওদের পলিটিক্সটা কী?
ব্যাক্তি : ওরা ভেবেছিলেন ঢাকা সিটি দুই ভাগ করলে দুটি আওয়ামী মেয়র নির্বাচিত করা সম্ভব হবে। দুটি না হলে অন্তত একটি আওয়ামী মেয়র। কিন্তু ওরা ভেবে দেখেনি, দুটি মেয়র তো বিএনপি থেকেই নির্বাচিত হতে পারতো। ওদের ভাগ্য ভালো, উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার কোনো মেয়র নির্বাচনেই বিএনপি অংশ নেয়নি।
বিজনেসম্যান : ওটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। নিশ্চয়ই কাগজে পড়ছেন দুই আওয়ামী মেয়রের মধ্যে কেমন মারামারি হচ্ছে। লোকমান হত্যার মতো এখন দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে কেউ মারা না গেলেই হয়। (একটু থেমে) আপনি কি শুনেছেন আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে আরো কিছু আইন পাস করবে আওয়ামী সরকার?
ব্যাক্তি  (কৌতূহলী) : যেমন?
বিজনেসম্যান : ইনডিয়াকে ট্রানজিট দেয়ার বিরুদ্ধে কেউ সমালোচনা করলে তার দুই পা রেল লাইনে কেটে দেয়া হবে। টিপাইমুখ বাধের সমালোচনা করলে তাকে কাপ্তাই বাধে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়া হবে।
ব্যাক্তি  : তাই নাকি? আমি জানতাম কুইক রেন্টালের কোনো সমালোচনা করলে তার বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। এসব তো শুনিনি।
বিজনেসম্যান (নিচু স্বরে) : আরো একটা আইন তারা পাস করবে শুনেছি।
ব্যাক্তি  : কী সেটা?
বিজনেসম্যান (আরো নিচু স্বরে, কিছুটা ভীতভাবে) : ওই আওয়ামী নেতা চলে গিয়েছেন। এখন আপনাকে বলতে পারি।
ব্যাক্তি   (বিরক্ত স্বরে) : দেখুন, সংসদে এই সরকারের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মেজরিটি আছে। তারা যা খুশি তাই করতে পারে। তারা অতি সহজেই ঢাকা সিটি ভাগ করতে পেরেছে। তবে একটি কথা তারা মনে রাখলে ভালো করতো। শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ৭ জুন ১৯৭৫-এ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে স্থির হয় দেশে একমাত্র দল হিসেবে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ থেকে সারা বাংলাদেশে ৬১টি জেলায় ৬১ গভর্নর হবেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ওই ৬১টি জেলায় তাদের নিচে সচিব হিসাবে কাজ করবেন ৬১টি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে চতুর্থ সংশোধনীতে বাংলাদেশকে বিভক্ত করা হয়েছিল ৬১ ভাগে। সম্ভবত সেই ধারণা থেকেই সংসদে মাত্র সাড়ে চার মিনিটে ঢাকা সিটি দুই ভাগে বিভক্ত করার সময়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পারলে তিনি ঢাকা সিটিকে চার ভাগে বিভক্ত করতেন।

ঠিক সেই সময়ে বাইরে বিকট শব্দে একটি টায়ার বার্স্ট করলো।
সভয়ে বিজনেসম্যান ও ব্যাংক ম্যানেজার দরজার দিকে তাকালেন।

৩ ডিসেম্বর ২০১১

(সব ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
(বানান রীতি লেখকের নিজস্ব)
শফিক রেহমান: প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।