দেশাত্ববোধ বনাম বিরোধীতাবোধ: কিঞ্চিত দীর্ঘশ্বাস

এসজিএস শাহিন
Published : 8 Nov 2014, 05:50 PM
Updated : 8 Nov 2014, 05:50 PM

ঘরে টিভি আছে। গ্রামে সাধারণত সবার বাড়ী টিভি থাকেনা বা থাকলেও খেলা দেখার সময় তরুনেরা বড় টিভি ওয়ালা, হৈ হুল্লোড় করা যায় এবং পরিস্কার দেখা যায় এমন বাড়ীতেই ভিড় জমায়। সেই সুবাদে খেলার সময় আমার ঘরে প্রচুর দর্শকের উপস্থিতি ঘটে। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার সময়। তো আমি খেলা দেখতে উপস্থিত থাকলে অপেক্ষাকৃত কমবয়সী যারা খেলা দেখতে আসে তারা প্রত্যেকেই খেলা বিষয়ক কোন মন্তব্য করতে গেলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়। এই যেমনঃ ম্যাচে আমাদের প্লেয়াররা কোন LBW এর আবেদন করলে আর আম্পায়ার না দিলে তারা বলবে, "দেখছেননি শাহিন ভাই; শালার আম্পায়ার ইজি LB টা দিলো না(আসলে LBW ছিলোই না!)? বিপক্ষ টিমের কোন বোলার পপিং ক্রিজের সীমানা রেখা সামান্য স্পর্ষ করে বল করলে কেউ বলবে, "দেখছেননি আংকেল, ইজি নো বলটা শালার আম্পায়ার দেখলো না"! অনেকে তো বিপক্ষ টিমের খেলোয়াড়দেরও গালি দেয়। এই যেমনঃ গর্ধবের বাচ্চা কি খেয়ে যে খেলায় উঠছে, বাড়ি দেবার আগেই ছক্কা চলে যায়! কেউ বলবে, কুত্তার বাচ্চা ক্যাচটা আর ছাড়লোই না!

দৃষ্টি আকর্ষণ কৃত কিংবা না আকর্ষিত প্রতিটি মন্তব্যই শুনি। সম্ভবপর হলে জবাবও দেই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বুঝানোর চেষ্টা করি যে, ঐ ক্ষেত্রে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিংবা তারা ছক্কা মারলে এটা আমাদের বোলারের ব্যর্থতা তাদের খাওয়া দাওয়ার দোষ নয়! অথবা ক্যাচ ছাড়বে কেন, আমাদের ব্যাটসম্যান দেখে মারলো না ক্যান?

আমি বুঝতে পারি, আমার কথা মেনে নিলেও তারা কেমন যেন বিরক্ত হয়, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আমি তাদের চেহারার দিকে তাকাই এবং তাদের বোধের যায়গাটিকে পরিমাপ করার চেষ্টা করি।
ওদের কথা কি বলবো, চরম মুহুর্তে নিজেই পক্ষপাতিত্ব করে বসি, গালাগালি তো কোন ছার! অবসরে মনে মনে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করি, আমরা অন্যায়ভাবে এত পক্ষপাতিত্ব করে কেন? এটা উগ্রতা, নাকি এটাই দেশপ্রেম?

সম্প্রতি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে একটি বিদেশী টিভি চ্যানেলের মিথ্যাচার নিয়ে বেশ প্রতিবাদ চলছে। ঐ বিদেশী চ্যানেলেরই বা কি দোষ দেই, আমাদের সংসদেই এই তত্ত্বটি দুঃখজনকভাবে ভুল উপস্থাপন করেছিলেন নিলুফার মনি নামে বিএনপির এক মহিলা এমপি। শুধু ঐ এমপি নন, আমাদের দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যাক্তি, দল এবং সংগঠনও এটা নিয়ে মিথ্যাচার করেছে, করতেছে। তারা ৩০ লক্ষকে ৩ লক্ষ বলে উপস্থাপন করতেছে। তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সংখ্যাটা আসলেই ৩ লক্ষ এবং বঙ্গবন্ধু ভুল করে ৩০ লক্ষ বলে ফেলেছেন! বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আইনজীবি খোন্দকার মাহবুব এবং গয়েস্বর চন্দ্র রায় তো আরো কয়েকধাপ এগিয়ে। তারা বলে কিনা, ৭১ – এ কোন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটে নাই! অথচ সেই সময়কার সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলে ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে হত্যা ও নির্যাতনের। এমনকি নিহতের সংখ্যা ৩০ লক্ষের পক্ষেও আছে। জাতিসংঘের একটি হিসাবেও নিহতের সংখ্যা ৩০লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পোস্টটিতে অনেক তথ্য-প্রমাণ একসাথে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাঠক চাইলে লিংকে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন।[ http://sovyota.com/?p=3782]
প্রশ্ন হলো, এই বিপুল সংখ্যক লোক বাংলাদেশের অধিবাসী হয়ে, বাংলাদেশের খেয়ে পরেও বাংলাদেশের ইতিহাসের সত্যের বিপক্ষে বলবে কেন? দেশের প্রতি কি তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই? তাদের কি দেশাত্ববোধ বলে কিছু নেই? এই সংখ্যাটা কমিয়ে বললে পাকিস্থানের কিছুটা লাভ হয়তো হলেও হতে পারে, কিন্তু তাদের কি লাভ?

জানি এসব প্রশ্নের কোন সরাসরি উত্তর নেই। কালকের শিশুটাও বোঝে এই দেশ আমার। অন্যায় হোক আর ন্যায় হোক আমাকে অবশ্যই দেশের পক্ষপাতিত্ব করতে হবে সেটা খেলা হোক আর যুদ্ধ হোক। কিন্তু আফসুস, এই বোধটুকু আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক এলিট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে নেই। তাদের কাছে দেশাত্ববোধ বলে কিছু নেই। তাদের আছে শুধু বিরুধীতাবোধ। খেলা হোক আর যুদ্ধ হোক, ইতিহাস হোক আর ঐতিহ্যের বিতর্ক হোক, তারা জানে তাদেরকে শুধু বাংলাদেশের বিরোধীতা করতে হবে। বিরুধীতায় স্বার্থ বিরোধীতায়ই যেন সর্ব সুখ।

তাদের প্রতি বলার মত কিছু নেই। বলেও লাভ নেই। এদের জন্য রইলো কবির লিখা সেই অমর লাইন দুটি…
বঙ্গেতে জন্মে যে হিংসে বঙ্গ বাণী,
তাহারও জন্ম কোথায় নির্ণয় ন জানি।