ইরাক যুদ্ধ
দুটি ছবি, একটি বিভীষিকা
লেখক মশিউল আলম: সাংবাদিক।
প্রথমে বাঁ পাশের ছবিটি দেখুন। ল্যাপটপের পর্দায় কী দেখছে মেয়েটি? কেন হাত দুটি অমন করে ঢেকে ফেলেছে মুখ? কী অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে ওর চোখে?
এবার চোখ রাখুন পাশের ছবিটির ওপর। কী দেখতে পাচ্ছেন শিশুটির বিস্ফারিত চোখে? ওই মুখ থেকে যে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে, তা কেমন তীব্র, কতখানি তীক্ষ্ণ হতে পারে?
বাঁয়ের কিশোরীটির নাম সামার হাসান। ল্যাপটপের পর্দায় সে দেখছে ডান পাশের ছবিটি। এ ছবি তার নিজের, ছয় বছর আগে তোলা। তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছরের কিছু বেশি। তার পোশাকে, পায়ের কাছে মাটিতে ছোপ ছোপ ওগুলো রক্তের দাগ। খুব তরতাজা, উষ্ণ রক্ত। এখানে মুদ্রিত সাদা-কালো ছবিতে ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না; কিন্তু সামার টের পাচ্ছে এই রক্তের উষ্ণতা। এ রক্ত ঝরার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তোলা হয়েছে ছবিটি।
ইরাকের উত্তরাঞ্চলের শহর তাল আফার। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে অসুস্থ এক ভাইকে হাসপাতালে রেখে বাসায় ফিরছিল সামার, তাঁর মামা-বা ও আরেক ভাই। আমেরিকান সৈন্যরা তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান সামারের মা-বাবা দুজনই। গুরুতর আহত হন সামারের ভাই রাকান। এই হত্যাযজ্ঞের ঠিক পরপরই রক্তাক্ত শিশু সামারের ছবিটি তোলেন মার্কিন ফটোগ্রাফার ক্রিস হোনড্রোস। ছবিটি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঝড় তোলে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, তাদের সৈন্যরা ভুল করে মেরে ফেলেছে নিরীহ দুজন মানুষকে। সামারের আহত ভাই রাকানকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরে। সুস্থ হয়ে ইরাকে ফিরে আসেন রাকান। তারপর একদিন তাঁদের বাড়িতে হামলা চালায় ইরাকি বিদ্রোহীরা, রাকান মারা যান। বিদ্রোহীদের ধারণা, বাড়িটির বাসিন্দারা আমেরিকার দালাল, নইলে রাকানকে কেন চিকিৎসার জন্য বোস্টন নিয়ে যাবে। সামারের ভগ্নিপতি নাদির বশির আলীকে লোকেরা মনে করে আমেরিকার চর।
সামারের বয়স এখন ১২। মসুল শহরে বড় বোন ইনতিজারের সঙ্গে থাকে। ভগ্নিপতি নাদির বশির আলী পুলিশে চাকরি করতেন, এখন অবসরে। তাঁর দুই ছেলে পুলিশে চাকরি করেন, তাঁদের উপার্জনেই চলে বিশাল পরিবারটি। সামারের ছোট ভাই মোহাম্মদও এ পরিবারেই থাকে। সামার স্কুলে যেত, কিন্তু গত বছর থেকে আর যায় না। স্কুলে সে কারও সঙ্গে মিশতে পারত না, পড়াশোনায় ভালো করছিল না। এখন সে বাড়ির বাইরে তেমন বের হয় না। তার ছোট ভাই, আট বছরের মোহাম্মদ, একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলে। সামার ও মোহাম্মদকে মাঝেমধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যান তাদের ভগ্নিপতি। শিশু দুটিকে ট্রমা দূর করার ওষুধ খাওয়ানো হয়। ইরাকে এ ধরনের ট্রমাটাইজড বা প্রচণ্ড মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা কত, সে পরিসংখ্যান নেই। নাদির বশির আলী নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদককে বলেছেন, প্রচুরসংখ্যক মানুষ ট্রমার ওষুধ নিতে হাসপাতালে ভিড় করে।
এই বিভীষিকাময় কাহিনি জানা গেল মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসসহ আরও কিছু পত্রপত্রিকা ও ওয়েবসাইটের কল্যাণে। আলোকচিত্রী ক্রিস হোনড্রোস ছিলেন ইরাকে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে এমবেডেড ফটোগ্রাফার। তিনি সম্প্রতি লিবিয়ার মিসরাত শহরে নিহত হয়েছেন। লিবিয়ায় চলমান রাজনৈতিক গন্ডগোলের ছবি তুলতে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর তোলা ছয় বছর আগের ছবিটি তাঁর মৃত্যুর পরে আবার ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেট ভুবনে। সামার নিজের এই ছবিটি দেখার সুযোগ পেল এই সুবাদেই। নিচের বাঁ পাশের ছবিটিতে সে ভগ্নিপতির ল্যাপটপে দেখছে নিজের সেই ছবিটি। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদক টিম আরাঙ্গো ইরাকের মসুল শহরে সামারের ভগ্নিপতির সেই বাড়ি গিয়েছিলেন। সামার তখন তাঁকে বলেছে, একটি লোক তার ছবি তুলছিল, এ কথা তার মনে আছে। তারপর সৈন্যরা ওই ফটোগ্রাফারকে থামিয়ে দিয়েছিল, তারপর সামারকে একটি ট্রাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তার হাতের জখমের চিকিৎসা করেছিল। সামার আরও বলে, ‘ওরা আমাকে কয়েকটা খেলনাও দিয়েছিল!’—লিখেছেন টিম আরাঙ্গো।
২০০৫ সালে সামারের মা-বাবা হত্যার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত শিশুটির ছবি তোলার পর মার্কিন বাহিনী ফটোগ্রাফার ক্রিস হোনড্রোসকে ইরাক থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর ছবিটির যে আলোড়ন তোলার কথা, ইন্টারনেটে প্রচারের ফলে তা ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছিল। পেন্টাগনের খুব উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হয়েছিল: কীভাবে ইরাকে বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানি ‘মিনিমাম’ পর্যায়ে রাখা যায়। সামারের মা-বাবার ওপর যে মার্কিন সৈন্যরা গুলি চালিয়েছিল, তাদের তরফ থেকে এমন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল যে, তারা ওই গাড়িটিকে থামানোর জন্য প্রথমে আকাশে ফাঁকা গুলি করেছিল, কিন্তু গাড়িটি থামেনি বলে তারা গুলি চালিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, গাড়িটি চালাচ্ছিল আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা। কিন্তু মার্কিন সৈন্যদের এই ব্যাখ্যা আমেরিকান নাগরিক সমাজ গ্রহণ করেনি। কারণ ইরাকের জনগণকে সাদ্দামের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত করে দেশটিতে মার্কিন গণতন্ত্র রপ্তানি করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধ শুরু করে, তার ফলে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ১১ লাখেরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে বেসামরিক নিরীহ, নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের সংখ্যা কত, সে হিসাব কেউ রাখেনি। মার্কিন সামরিক গোয়েন্দাদের তৈরি করা গোপন যেসব নথিপত্র উইকিলিকস ফাঁস করে দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে ইরাকে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা ৯২ হাজার (এই সময়ে মোট প্রাণহানি ১০ লাখের বেশি)। উইকিলিকস মার্কিন সৈন্যদের হাতে বেসামরিক ইরাকি মানুষদের হত্যার ঘটনাগুলোর নাম দিয়েছে ‘আনুষঙ্গিক হত্যাকাণ্ড’ (কোল্যাটারাল মার্ডার)।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের পরিচালক সারা হুইটসন ক্রিস হোনড্রোসের তোলা সামারের ছবিটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস-এর টিম আরাঙ্গোকে বলেছেন, ‘এই ছবিতে ইরাক যুদ্ধের বিভীষিকা এমন নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে, যে বিভীষিকা আমেরিকানরা ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেনি। মেয়েটির চোখেমুখে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে, সেটা ইরাকের সমস্ত মানুষের অভিব্যক্তি।’
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে আমেরিকান প্রশাসন ও মূলধারার মার্কিন সংবাদমাধ্যম দেশটির জনসাধারণকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে আমেরিকা আক্রান্ত হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে তার ‘মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ’। তাই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে মার্কিন প্রশাসন দেশে দেশে আমেরিকার শত্রু খুঁজতে বের হয়েছে। এই তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ আমেরিকা দীর্ঘ সময় ধরে বোকা বানিয়ে চলেছে তার নিজের জনগণকেই। তবে গত পাঁচ-ছয় বছরে ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইয়েমেনসহ অনেক দেশে মার্কিন বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দাদের দুষ্কর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারছে, যা আগে মূলধারার মার্কিন সংবাদমাধ্যমে তারা জানতে পেত না। এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিকেরা বলছেন, সন্ত্রাসী সৃষ্টি করছে আল-কায়েদা নয়, খোদ পেন্টাগন। রক্তাক্ত সামারের ছবি দেখে রেডিট নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে ৫২৪টি মন্তব্য। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এ ধরনের নৃশংস ঘটনা আমেরিকার প্রতি আরব বিশ্বের মানুষের ঘৃণা ও বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলছে। একজন লিখেছেন, এ রকম একটি ঘটনাই ১০ হাজার সন্ত্রাসীর জন্ম দেবে। আরেকজন মন্তব্য করেছেন, হয়তো সামার বড় হয়ে কোমরে বোমা বেঁধে আমেরিকানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এবং তা যদি সে করে, তবে তার এই পদক্ষেপের পক্ষে সে প্রবল যুক্তিও খুঁজে পাবে।
মার্কিন যেসব সৈন্য ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে, তারা সামান্য ছুতানাতায় টপাটপ গুলি করে পশুপাখির মতো সাধারণ মানুষদের হত্যা করছে—এ ধরনের অভিযোগও মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। তবে তাদের একটা বড় অংশ মনে করে, মূল দোষ আমেরিকান প্রশাসনের। তারা যদি ইরাকে যুদ্ধ করতে সৈন্য না পাঠাত, তাহলে এসব নিরীহ নিরপরাধ মানুষ অকারণে প্রাণ হারাত না। মার্কিন সৈন্যরা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ভুল করে সাধারণ মানুষকে মেরেছে—এই যুক্তি নাকচ করে দিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, ‘তুমি ও দেশে গেছ কী করতে?’
বুশ-ওবামাদের আমেরিকা কবে এই কাণ্ডজ্ঞান ফিরে পাবে যে, ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র’ রপ্তানিযোগ্য নয়?
সূত্রঃ- প্রথম আলো- খোলা কলাম।
ইরাক, আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে পোস্ট করা। বাংলাদেশের জন্য নয়। পাঁচ বছর বয়সে এরকম ঘটনা কার সাথে ঘটে থাকলে শিশুকাল থেকে শিশুর মনে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে? প্রতিশোধ স্বাভাবিক।
হারুন বলেছেনঃ
যারা মানবতার কথা বলেন তারা কোথায়?
Safor বলেছেনঃ
Every action have equal and opposite reaction.America is the father and leader of terrorist. Others are follower of them.When man feel helpless than their have no other option without action.