ক্রিকেটের জয়ের দিনে মানবতার পরাজয়

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
Published : 3 Nov 2016, 11:41 AM
Updated : 3 Nov 2016, 11:41 AM

বাংলাদেশের ইংলিশ বধের আনন্দে যেদিন আমরা বিজয়োল্লাস করছি সেদিনই মানবতার পরাজয় ঘটেছে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়। একজনের বিশ্বাসকে, ইশ্বরকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই একই কাহিনী, একই অভিযোগ। ফেসবুকে ধর্মের অবমাননা অতঃপর মন্দিরে হামলা এবং প্রতিমা ভাংচুর, প্রশাসনের গাফিলতি।

রসুরাস দাশ নামক এক যুবকের ফেসবুক আইডির ধর্ম অবমাননার একটি ছবি থেকে ঘটনার সূত্রপাত। এই ছবি নিয়ে গত শনিবার থেকেই উত্তেজনা চলছিলো ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। শনিবারেই অভিযুক্ত যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু প্রশাসন উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও খাটিঁ আহলে সুন্নাাত ওয়াল জামায়াত নামে দুটি ধর্মীয় সংগঠনকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। সমাবেশের আড়ালে উগ্রবাদীরা হামলা চালায় হিন্দু ধর্মের উপাসনালয়ে। ১৫ টি মন্দিরে হামলার পাশাপাশি ভাংচুর করা হয় ৬০-৭০ টি হিন্দু বসতি। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগে অতর্কিতভাবে শত শত মানুষ মিছিল নিয়ে এসে হিন্দু মন্দির ও বাড়ি ঘরে হামলা চালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ হামলাকারীদের বেশীরভাগই অপরিচিত। স্থানীয় প্রশাসন সুন্নাহদের সমাবেশে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে হিন্দু মন্দিরে নিরাপত্তা দিতে পারে নি বলে জানান। (০১ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলো)


আজ থেকে ৪ বছর আগে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে মহানবী (সঃ) কে অবমাননা করার অভিযোগে কক্সবাজারের রামুতে স্থানীয় মুসলমান যুবকরা ১১ টি বৌদ্ধ মন্দির ২০ টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। রামুর চৌমুহনীতে সমাবেশ পরবর্তী মিছিল থেকে হামলা করা হয়। মাঝরাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় ৩০০ বছরের পুরানো মৈত্রী বিহারে।

ঘটনার পেক্ষিতে তদন্ত হয়েছে, মামলা হয়েছে, কিন্তু বিচার হয়নি। রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু ক্ষতিগস্ত মন্দির ও ঘর বাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার জন্য দেশবাসী ও সরকারকে ধন্যবাদ জানান। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মনের নির্মাণ হয় নি।


রামুর সেদিনের ঘটনাকে ভূলতে চান বৌদ্ধরা । তাই তো মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য রমজানে ইফতারের আয়োজন করে। এই বছর ঈদের জামাতের নিরাপত্তায় ছিলেন হিন্দু যুবক। এভাবে নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে গর্ব করি। কিন্তু কতদিন?

রামু বৌদ্ধ মন্দির আর ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় নাসির নগরের হামলার ধরন একই। ফেসবুকের কথিত ধর্ম অবমাননাকারী ছবি থেকে উত্তেজনার শুরু। নাসিরনগরের ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক পেশায় একজন জেলে। ফেসবুকের ছবিটি ফটোশপ করা। যা জেলে যুবকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর রামু বা নাসির নগরের যে যুবকরা হামলা করেছে তারা ফেসবুক চেনে বলে মনে হয় না। হামলা কারীদেরকে মগজ ধোলাই করে হামলায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ধরন দেখে বুঝা যায় প্রতিটি হামলায় পুর্ব পরিকল্পিত। তাছাড়া ফেসবুকের ছবির ধোয়াঁশা তো থাকছেই। বারবার প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা সন্দেহের উর্ধে নয়। তাই প্রশাসনের মধ্যে ঘামটি মেরে কোন সাম্প্রদায়িক অপশক্তি পরিকল্পিত ভাবে এই ঘটনা ঘটাচ্ছে কিনা তা ভাববার সময় এসেছে ।

বাঙালী জাতি হিসেবে কখনো সাম্প্রদায়িক নয়, আজও নয়। আমার বাবা একজন ধার্মিক লোক। তিনি আবার আমাকে জোসনা রাতে নদীর পাড় হয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে ফানুস দেখাতে নিয়ে যেতেন। হিন্দু বন্ধুদের সাথে সারাদিন ক্রিকেট খেলেছি। কখনো কারো কাছে ধর্মের প্রশ্ন আসে নি। কিন্তু তারা আজ পত্রিকার পাতা খোলে দেখবে আমার ধর্মের লোকেরা ধর্মের দোহাই দিয়ে তার ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা করেছে। আজ নিশ্চয় তারা ভাববে আমার আর তাদের পথ এক নয়। তারা আজকের পর থেকে আমার দিকে অন্য দৃষ্টিতে থাকাবে। সেটাই স্বাভাবিক, নিজের উপাসনালয়ে আগুনের অভিজ্ঞতা সহজ ভাবে নেয়ার নয়। এই বছরের  ঈদে বাড়ি ফেরার সময় আমার সহপাঠী মৃন্ময় মজুমদারকে ছিনতাই কারীরা প্যান্ট খুলে চেক করে। হিন্দু জানার পর উপুর্যোপরি খোপায়। মৃন্ময় আমার রুমমেট। কখনো নিজেদের ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠে নি। কিন্তু শুধু হিন্দু হওয়ায় মৃন্ময়কে কোপানো হলো। এরপরে কি মৃন্ময়ের মনে হয় নি সে হিন্দু আমি মুসলিম। মনে হওয়ায়  স্বাভাবিক। কারো বিশ্বাস ভিন্ন হওয়ায় জানের উপর আঘাত আজ নতুন নয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে। সমাজ এগিয়েছে। কিন্তু মানসিকতা কি মুক্তি পেয়েছে?

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।