সাঁওতাল বা রোহিঙ্গা নয় এরা সংখ্যালঘু, এটাই ওদের পাপ

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
Published : 29 Nov 2016, 03:42 AM
Updated : 29 Nov 2016, 03:42 AM

বিশ্বজুড়ে আজ সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চলছে। জাতিগত বা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের উপর সমাজের তথাকথিত ক্ষমতাশালী শ্রেণী কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিপীড়ন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িঁয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র এইসব নিপীড়নে উৎসাহ দিচ্ছে সমান তালে। সমাজের এই অবক্ষয়ের অন্যতম উদাহরণ গত ৭ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্ধগঞ্জে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাঁওতালদের সংঘর্ষ।

১৯৫৫ সালে তৎকালীন সরকার আখ চাষের জন্য গোবিন্ধগঞ্জ উপজেলায় ১ হাজার ৮৪০ একর জমি অধিগ্রহণ করে, যাতে উচ্ছেদ হয় প্রায় ১৫ টি সাওঁতাল গ্রাম। অধিগ্রহণের শর্ত ছিলো এই জমিতে আখ চাষ করা হবে। অন্য ফসলের চাষ হলে জমি মালিকদের কাছে ফেরত দেয়া হবে। বেশ কয়েক বছর ধরে এইসব জমিতে  তামাক ও আখের চাষ করা হচ্ছিলো। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জমি ফেরত পাওয়ার দাবি করে সাওঁতালরা। কিন্তু রাষ্ট্র চুক্তির শর্ত অস্বীকার করে সাওঁতালদের উচ্ছেদ করে বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রের এমন উদার্য্যপূর্ণ আচরণের সাহস হয় কারণ ভুক্তভোগিরা সংখ্যালঘু,'পশ্চাদপদ জাতি'। তাদের রাজনৈতিক মুল্য বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন নেই রাষ্ট্রের কাছে।

বাংলাদেশের সমতলে বসবাসকারী ১০ টি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালরা সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত। কাপেং ফাউন্ডেশনের মতে, গত আট বছরে (২০০৭-২০১৫) সালে ভূমিকেন্দ্রিক ৯০ টি সংঘর্ষ হয় সাঁওতালদের সাথে। এইসব সংঘর্ষে প্রায় ১৬০ জন সাঁওতাল আহত ও ১৬ জন সাঁওতাল নিহত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জনাব আবুল বারাকাত হোসেন গবেষণা করে বলেছেন, 'গত তিন প্রজন্মে সাঁওতালদের প্রায় তিন লক্ষ বিঘা জমি বেহাত হয়েছে যার আনুমানিক মুল্য পাচঁ হাজার কোটি টাকা।'

সাঁওতালদের এভাবে জমি বেহাত হওয়ার অন্যতম কারণ ঐতিহ্যগতভাবে সাঁওতাল নৃগোষ্ঠীর মধ্যে জমির গোষ্ঠীগত মালিকানা পদ্ধতি প্রচলিত। গোষ্ঠীগত মালিকানায় স্বাভাবিকভাবেই দলিলের প্রচলন ছিলো না। জমি মালিকানায় সাঁওতালদের নিজেদের পদ্ধতি তথাকথিত আধুনিত সমাজ মানে না। তাই  এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের রাজনৈতিক অপশক্তি খোড়া অজুহাতে সাঁওতালদের  লক্ষ লক্ষ বিঘা জমি দখল করেছে।

এই অপদখলের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা যুগে যুগে প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের আধুনিক সমরাস্ত্রের কাছে তীর ধনুকের প্রতিবাদ নিপীড়িত হয়েছে বার বার। কিন্তু এবার নিগৃহীত এই নৃগোষ্ঠী সরকারের রাজনৈতিক তামাশার ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের মুখে ঘৃণার তীর ছুড়ে মেরেছে।

যে মুহুর্তে বাংলাদেশে সাঁওতালরা নিজ ভূমিতে নিপীড়িত ঠিক তখনি পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ শুরু করেছে বার্মা সরকার। মায়ের বুক থেকে সন্তানকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, বাবার সামনে মেয়েকে গণধর্ষণ করা হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আরকান (রাখাইন) রাজ্যে বাস করলেও সামরিক জান্তা সরকার বুটে পিষ্টে তাদের নাগরিত্ব বাতিল করে। মায়ানমারের রোহিঙ্গারাও সংখ্যালঘু ও পশ্চাদপ জনগোষ্ঠী। বিশ্ব মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অহিংসার ধর্ম প্রচারকদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে মানবতা।

অনেকে ভেবেছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সাং সূচি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মানবিক হবেন। কিন্তু মানবতা আজ আগুনে পুড়ছে, ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। সুচি নির্বাক। কারণ তিনি গণতন্ত্রের মা, মানবতার নয়। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের, মানবতার নয়। সুচি গণতন্ত্রের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে সংখ্যালঘুর মানবতাকে হত্যা করতে প্রস্তুত আছেন। বাংলাদেশের সাঁওতালদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা কোনোটি তথাকথিত গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ করে না। তাই তো বিশ্ব বিবেক আজ নীরব। বিশ্ব নেতাদের মানবতার বুলিও বন্ধ। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কিছু তরুণের কাছে রোহিঙ্গা নিধন মানবতার লুন্ঠন হলেও সাঁওতালদের ভূমিহীন করা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাঁওতাল বা রোহিঙ্গা নয়, হিন্দু বা মুসলিম নয়, কবি কন্ঠে বলতে চাই, 'হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার'। তাই বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হোক। এই গ্রহের যেখানে মানবতার লুন্ঠন, সেখানেই হোক প্রতিবাদ।

লেখক, শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।