রেস্টুরেন্ট আর বিউটি পার্লারের শহরের তরুণ আমরা

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
Published : 11 Jan 2017, 04:31 PM
Updated : 11 Jan 2017, 04:31 PM
বর্তমানে দেশের সামাজিক অবক্ষয় আর তরুণদের বিপদগামীতা অভিভাবক মহলকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে।জঙ্গীবাদে ঝুকে যাওয়া,,অল্প বয়েসে প্রেম-ডেটিং,অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক,মাদক গ্রহণ এমনকি অনলাইনে একে অপরকে হুমকি দিয়ে খুন পর্যন্ত করছে বিপথে যাওয়া তরুণরা। আশংকার কথা হচ্ছে এইসব অপরাধে জড়িতদের বয়স ১৩-১৮ বছরের মধ্যে। আমাদের সামাজিক শিষ্টাচার, পারিবারিক বন্ধন এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া,পারস্পরিক অবিশ্বাস ব্যক্তিগত জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। অষ্টম-নবম শ্রেণী পড়ুয়ারা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফেন্ড, স্মার্টফোন, ফেইসবুকের লাইক শেয়ার নিয়ে মেতে আছে ।
চট্টগ্রাম শহরের কলেজের ক্লাস ডিসি হিল আর সিআরপি হিলে হয়।। ছাত্রছাত্রীরা করবেই বা কী? চট্টগ্রাম শহরের ৬০ লক্ষ জনসংখ্যার জন্য ৬০০ এর অধিক রেস্টুরেন্ট আর বিউটি পার্লার রয়েছে অথচ ৬টি পাবলিক লাইব্রেরীও হয়নি। ফুটপাত আর সড়কদ্বীপ এখন জিরো লাইটের রেস্টুরেন্টের দখলে, অথচ যেখানে হওয়ার কথা ছিলো লাইব্রেরী। আজকাল কলেজ পড়ুয়ারা টিউশনির টাকা জমিয়ে বই কিনার কথা ভূলে গেছে।কারণ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ডেটিংয়ের বিল দিয়ে আর কতেই বা হাতে থাকে।
হিসাবটা সোজা, লাইব্রেরি তৈরী করে পাঠক, ভাবুক, দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল তরুণ আর বিপরীতে জিরো লাইটের রেস্টুরেন্ট বানাবে অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিক-প্রেমিকা। গুলশানে জঙ্গি হামলার পর বিপথগামী তরুণদের উদ্ধারে বেশ কয়েকদিন শোরগোল শোনা গিয়েছিলো। এবার উত্তারায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সমবয়সীদের হাতে খুন হন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আদনান। আবার বেশ কয়েকদিন সভা-সেমিনার আর জ্বালাময়ী বক্তব্য বা ফেসবুকের পোস্ট দিয়ে তরুণ সমাজকে সুপথে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস চলবে বেশ কয়েকদিন। এসব প্রয়াস অনেকটা 'এখানে প্রসাব করিবেন না, করলে ৫০ টাকা জরিমানা', কিন্তু সাইনবোর্ডের কোথাও লেখা নেই ৫০ গজ দূরে হাতের ডানে পাবলিক টয়লেট।
ঢাকা শহরে যে কয়টি খেলার মাঠ আছে তা সারা বছর  রাজনৈতিক সমাবেশ আর এই মেলা-সেই মেলার দখলে থাকে। ছেলেমেয়েরা জঙ্গি আর সন্ত্রাস না হয়ে কি হবে। সারা শহরে কয়টি থিযেটার আছে? কয়টি বিতর্ক সংগঠন অথবা আবৃত্তিশালা? কিন্তু দিন দিন পানশালা তো ঠিকই বাড়ছে।  স্কুলে কোন সাবজেক্টটি পড়ার মতো উপভোগ্য আছে? ক্লাস তো ছেড়ে দে কেঁদে বাঁচি। উত্তরার তথাকথিত গ্যাঙের সব ছেলে ধরে পায়ে ডান্টা বেড়ি অথবা ক্রসফায়ার দিয়ে দিলেই কি সমাজ বদলে যাবে? যাদের হাতে থাকার কথা ছিলো সায়েন্স ফিকশন আর গল্পগুচ্ছ তাদের হাতে কেন বিয়ারের বোতল?
মানলাম শহরে খেলার মাঠ নেই,পড়ার লাইব্রেরি নেই,থিযেটার নেই কিন্তু টিভি খুলেই বা কি দেখার আছে। বাংলাদেশের ৪০টির মতো টিভি চ্যানেল। চ্যানেলগুলো খুললেই মনে হয় বাংলাদেশে রাজনীতি ছাড়া কোন আলোচ্যসূচি নেই। আর সে রাজনীতিতে একে-অপরকে দোষারোপ ছাড়া কিছু নেই । তরুণদের জন্য কয়টা অনুষ্ঠান হয় চ্যানেলগুলোতে। আমদের মিড়িয়া না পারে ভালো কোন অনুষ্ঠান করতে না পারে ভালো সিনেমা বানাতে । অথচ একটা সমাজ গঠনে মিড়িয়ার প্রভাব অনন্য। বই আর সিনেমা মানুষের মাঝে সাবলিমিনাল মেসেজ তৈরী করে। শ্রদ্ধেয় তারেক মাসুদ স্যারের রানওয়ে সিনেমাটা তরুণদের মাঝে পৌঁছানো গেলে হয়তো অনাকাঙ্খিত গুলশান ট্রাজিডির হাত থেকে বাঁচা যেত।
অনেকে বলেছেন পরিবার থেকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া উচিত। খুব গুরুরত্বপূর্ণ কথা,কিন্তু এখন পারিবারিক বন্ধন, শাসন, বারণ, আদর হারিয়ে গেছে। পারিবারিক অনুষ্ঠান, পারিবারিক ভ্রমণ, রাতে একসাথে খাওয়া, বসার ঘরে একটু আড্ডা দেয়া এসবের চর্চা আমাদের পরিবারগুলো আছে? স্বাভাবিকভভাবে ছেলে মেয়েরা নিজেদের জগতটা স্মার্টফোনে খুঁজে নিবে । তারা  জন্মদাতা বাবা-মাকে বাদ দিয়ে বন্ধুদের সাথে জন্মদিন পালন করে। কারণ তার জন্মদিনে পরিবারের কোন আয়োজন থাকে না। নিজেদের শুভদিন-খারাপ দিন, ভালো লাগা না লাগাগুলো পরিবারের বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই চলার পথের সিদ্ধান্ত বাইরের জগত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
শারীরিক চিকিৎসার জন্য যেমন হাসপাতাল দরকার তেমনি মনের চিকিৎসার জন্য দরকার লাইব্রেরি। আর বর্তমানে দেশের তরুণ সমাজ মনের মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের হাতে তুলে দিতে হবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সায়েন্স ফিকশন। বই দিয়ে নিবারণ করা যাবে যাবতীয় সামাজিক ব্যাধি। সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে হবে। পারিবারিক ভাবে নিজেদের চিন্তাগুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরী করতে হবে। পরিবারের মাঝে থাকলে মানুষের মনের হতাশাগুলো কেটে যায়।পরিবারের সদস্যদের ভালবাসা সবসময় নিখাদ থাকে। যে ভালবাসা সুন্দর করে বাচাঁর অনুপ্রেরণা জোগায় প্রতিনিয়ত।জীবনের চলার পথে ভূল হতেই পারে। তাই বলে 'তুই খারাপ' বলে তাকে দূরে ঠেললে সে আরো দূরে সরে যাবে। তাকে আপন  করে তার ভূল শুধরানোর সুযোগ তৈরী করতে হবে। খেলাধূলার পর্যাপ্ত মাঠ রাখতে হবে। আমাদের (তরুণদের) বন্ধু নিবাচনে সতর্ক হতে হবে। অভিভাবকেদের অবশ্যই একটা নির্মল ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে আমদের বেড়ে উঠার পরিধিতে। আর কোন আদনানকে হারাতে চাই না।