জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসুক সুষ্ঠু পরিবেশ

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
Published : 6 June 2017, 01:47 PM
Updated : 6 June 2017, 01:47 PM

জাহাঙ্গীরনগর  বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে বিচলিত  হওয়ার বেশ  কারণ রয়েছে । স্বাধীনতার পর এই প্রথম  ৭৩ এর অধ্যাদেশে পরিচালিত কোন স্বায়িত্বশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিনা ওয়ারেন্টে ৪২ জন শিক্ষার্থীকে রাতের আঁধারে কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ, প্রচলিত শব্দে এটাকে অনেকে গ্রেফতার বলছেন।

গ্রেফতারের আগে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু যৌক্তিক দাবি নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষার্থীরা। অবরোধে ক্ষমতাসীন  ছাত্র  সংগঠনের নেতা ও সিনিয়র  কর্মীরা আন্দোলনকারীদের শার্টের কলার ধরে টান দেয় বেশ কয়েকজনকে চটকনা দেয়, যারা ভাল ফুটবল খেলে তারা কয়েকটা ফ্রি কিকও খেলে। তাদের দখলকৃত হলে থাকতে হবে বলেও  হুমকি দেয়। সহপাঠি  হারানোর  ব্যথায়  শোকে বিহবল ও   ঢাকা-আরিচার মহাসড়কের অনিরাপত্তায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এসব উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যান।

অবরোধের দিন (২৭ মে ২০১৭) সারাদিন প্রশাসনের  সাথে আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়া নিয়ে দফায় দফায় দেনদরবার চলে। এক পর্যায়ে প্রশাসনের ভাষায় 'তথ্য গ্যাফের কারণে' আর আন্দোলনকারীদের ভাষায় প্রশাসনের প্রতারনায় আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয় চার সহস্রাধিক রণসজ্জ্বিত পুলিশ। টিয়ারশেল আর রাবার  বুলেট ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে  আন্দোলনকারীদের। মারাত্মকভাবে আহত হয় সাংবাদিক ও ছাত্রীসহ প্রায় ১২ জন  শিক্ষার্থী। পুলিশী নিপীড়ন থেকে বাঁচতে কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের দোকানে আশ্রয় নিলে পুলিশ শাটার তুলে সেখানেও  টিয়ারশেল ছোড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ খেলার মাঠে ওড়ে  নীল পুলিশের টিয়ারশেলের  ধোঁয়া। হেমন্তে যে  মাঠে ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম সে মাঠ টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা চলে যায় ভিসির বাসভবনে। তারা এই পুলিশি নিপীড়নের জবাব চায়। কিন্তু দেশের প্রথম নারী উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম দেখা দিলেন না। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসার গেইটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকে। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষারত শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে ভিসির বাসভবনেই উপস্থিত শিক্ষকদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অশালীন অশ্রাব্য অশ্লীল বাক্য বিনিময় কখনো কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে হয়েছে কিনা জানা নেই। তবু ভিসি ম্যাম আসেন না। দেখা দেন না। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমনের কোন চেষ্টা করেন না!

এক পর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অনশনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিপরীতে ভিসি  ম্যাডাম জরুরি সিন্ডিকেট ঢেকে  অযৌক্তিকভাবে হল ভ্যাকেন্ট ঘোষণা করেন। মেয়েদের হলে ঝুলিয়ে দেন তালা। তার বাসভবনে থাকা ৪২ জন শিক্ষার্থীদের ২ শতাধিক পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখেন। ভাঙচুর গুরুতর জখম ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়। দেশের প্রথম নারী উপাচার্য হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়েছিলেন  ড. ফারজানা  ইসলাম। তিনি আজ ২য় বার ইতিহাসের অংশ হলেন।

ভিসির  নির্দেশে স্বাধীন দেশে  মাঝরাতে  বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে  ১২ জন ছাত্রীসহ ৪২ শিক্ষার্থীকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। নিজেদের ক্যাম্পাস থেকে নিজেদের শিক্ষকের নির্দেশে পুলিশ শিক্ষার্থীদের অকথ্য ভাষা গালি-গালাজ করে টেনে হিঁচড়ে নিষিদ্ধ কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে তুলছে এই দৃশ্য সুস্থ সমাজ কীভাবে মেনে নিয়েছে বা নিচ্ছে আমার বোধগম্য নয়।

উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পোগ্রামে নিজেকে ছাত্র-ছাত্রীদের মা দবি করেন। সেই মা তার সন্তানদের মাঝরাতে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পুলিশি নিপীড়নে আহত সন্তানদের  তিনি একবারের জন্য দেখতে গেলেন না। কোন খোজঁখবরও নিলেন না। উপরন্তু যারা প্রতিবাদ করেছে তাদেরও পুলিশে দিলেন!

নারী তুমি কার হাতে নিরাপদ?

তিনি একজন মা। তিনি একজন  নারী। তিনিই নারী শিক্ষার্থীদের মাঝরাতে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। পুলিশি হেফাজতে আটককৃতদের  মানসিকভাবে হেনস্তা করা হয়। গত ১ জুন এটিএন নিউজের ইয়াং নাইটে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী  সেই রাতের বিভৎসতার বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সে ছাত্রীর বর্ণনা মতে আটকের পর তাদেরকে একটি জনাকীর্ণ কক্ষে রাখা হয়।

আরেক ভুক্তভোগী মালিহা মুস্তফা সূচনা বলেন, 'আটককৃত ১২ জন ছাত্রীকে যে রুমে রাখা হয় সেখানে কিছুক্ষণ পর পর পুলিশ এসে তাদের গণনা করতেছিল। বারবার এই অদ্ভুত আচরণের প্রতিবাদ করলে যথেষ্ট তামাশা ও তাচ্ছিল্যের সাথে পুলিশ জবাব দেয় এটা তাদের ডিউটি এবং এই ধরনের অপমানজনক আচরণ অব্যাহত রাখে '। [তথ্যসূত্র: দ্যা ডেইলি স্টার, ৩১ মে ২০১৭]

মাইক্রোতে শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হয়  আটককৃতদের।  পুলিশ হেফাজতে থাকা ১২ জন ছাত্রীর কাছ থেকে ব্যক্তিগত ভাবে মোবাইল নাম্বার খোঁজে পুলিশের পুরুষ সদস্যরা যাতে তারা ভবিষ্যত কোন বিপদে সাহায্য করতে পারে । এই ধরনের বিরক্তিকর ও অপমানজনক উপহাস নিঃসন্দেহে নিপীড়নের সমতুল্য। নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন বৈরী আচরণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার

একদিন ড.  ফারজানা ইসলাম থাকবেন না। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরাও থাকবে না। কিন্তু দেশের প্রথম নারী ভিসির সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের এমন লাঞ্ছনার সম্মুখীন হওয়ার ইতিহাস একদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে ড.ফারজানা ইসলামকে।

হল ভ্যাকেন্টের এই দ্রুততম সময়ের নোটিশে এতজন ছাত্র-ছাত্রী কোথায় গিয়ে দাড়াঁবে সে চিন্তা করার সময ছিল না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের । ২৮ মে ছাত্রীদের বিকেল ৫ টা পর্যন্ত হল ছাড়ার সময় দিলেও  বেলা ১১:৩০ টায়  জিফাত ফারজানা জুইঁকে জোর করে হল থেকে বের করেন জাহানার ইমাম হলের আবাসিক শিক্ষক তাসলিন জাহান মৌ ও হল সুপারিনটেনডেন্ট শাহনাজ পারভীন। জুঁই তার রুমে অপ্রস্তুত অবস্থায় পুরুষ স্টাফ ঢুকে রুম তালা দেয়ার অভিযোগ করে।

হাজারও অভিযোগের ভিড়ে এই অভিযোগগুলো চাপা পড়ে যাবে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন আমাদের মা-বাবা আমাদেরকে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের হতে তুলে দেন। ক্যাম্পাসে তারাই আমাদের অভিভাবক। কিন্তু সে অভিভাবকরা আমাদেরকে জোর করে হল থেকে বের করে দিচ্ছেন, পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন, টিয়ারশেলের মুখে ছেড়ে দিচ্ছেন, হাসপাতালে বেডে  হ্যান্ডক্যাপ পরিয়ে রাখছেন। এত বিভৎস এত নিষ্ঠুর কেন আমাদের অভিভাবকরা?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক মতামত প্রকাশের কোন প্লাটফরম নেই। জাকসু নির্বাচন  নেই ২৪ বছর। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বিনা-টাকায় পড়তে আসায় তাচ্ছিল্য করেন। নিয়মিত ক্লাশ নেন না। কোন ধরনের মত প্রকাশ করতে চাইলে বা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে চাইলে বাম ট্যাগ লাগিয়ে হেনস্তা করেন। যারা একটু-আধধু গলা তোলেন তাদেরকে প্রতিপক্ষ ভেবে দমন করার চেষ্টায় নত থাকেন। শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে দূরত্ব  বজায় রেখে চলেন।

তার ফলস্বরুপ  যে সমস্যার সমাধান ভিসি ম্যাম তার বাসায় বসে করতে পারতেন সে সমস্যার জন্য তিনি একাত্তর টিভিতে লাইভে গিয়ে নিজ ছাত্রের সাথে পাড়ার বাচ্চার মত ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে দেশবাসীর হাসির খোরাক হন।

শিক্ষক -শিক্ষার্থীর এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ বন্ধ হোক। নিরপেক্ষ একটি তদন্ত কমিটি দিয়ে পুরো ঘটনার তদন্ত করা হউক। ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়ানের সিদ্ধান্ত  থেকে সরে আসুক ‍বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হউক। শিক্ষকরা  যে মামলার সংস্কৃতি চালু করছে তা যদি শিক্ষার্থীরাও আয়ত্ব করে তবে পরিস্থিতি দিনকে  দিন ঘোলাটে হবে। যা কারো কাম্য নয়।

তরুণ প্রাণের ক্ষোভ বা প্রতিবাদ কোনটিরই মৃত্যু নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের আবেগ, অভিমান ও ক্ষোভকে আমলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শিক্ষার্থী বান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে নিয়ে আসবে এমন প্রত্যাশা সবার।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়