প্রশাসন চাইলে বন্ধ করা যায় ‘র‌্যাগিং’

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
Published : 4 April 2018, 02:18 AM
Updated : 4 April 2018, 02:18 AM

সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় কয়েকজন তরুণ লেখক 'র‌্যাগ ডে' আর 'র‌্যাগিং'কে এক করে তাল-গোল পাকিয়ে ফেলেছেন। তাই লেখার প্রথমে র‌্যাগ ডে ও র‌্যাগিং শব্দের বোধগত অর্থ নিয়ে আলোচনা করছি। র‌্যাগ ডে- একটি ইংরেজি প্রবাদ। যার বাংলা অর্থ পড়ালেখা শেষের হৈ-চৈপূর্ণ দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব ক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের এই বিদায় অনুষ্ঠান বেশ ঘটা করে নাচ-গান ও হাসি-তামাশার মাধ্যমে পালন করে।

আর র‌্যাগিংয়ের অর্থ হল পরিচিত হওয়া, তিরস্কার করা ইত্যাদি। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন আসা শিক্ষার্থীদের সাথে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটি সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা তাকে র‌্যাগিং নামে অবহিত করা হয়। কিন্তু এই পরিচিতি পর্ব কালক্রমে হয়ে পড়েছে মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের হাতিয়ার।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন ব্যাচ আসার সাথে সাথেই র‌্যাগিংয়ে নবীনদের অসুস্থতার খবর আসে। এই নিপীড়ন যেন একটি নিয়ম আর অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন করার মাধ্যম হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে র‌্যাগিং যেভাবে ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে তা আশঙ্কাজনক।

সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধলগ্ন করে ছয় শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিং করা হয়। পরে অর্ধলগ্ন ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করতে বাধ্য করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রবেশ করেছে নবীন ৪৭ তম ব্যাচ। দেশের একমাত্র এই আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নবীন শিক্ষার্থীদর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে প্রতিবছরই। তাই ৪৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের 'গণরুম' নামক একটি রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। সেই কষ্টের গণরুমে আবার প্রতি রাতে কতিপয় 'সিনিয়ররা' রাত জাগিয়ে তথাকথিত পরিচিত হতে আসে! রাতভর চলে র‌্যাগিং। আবাসন সংকট আর র‌্যাগিংয়ের নিপীড়নে তাদের ক্যাম্পাস জীবন প্রতি মুহূর্তে যেন হয়ে ওঠে বিষাদময়!

গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের এক ছাত্রকে মানসিক নির্যাতন করেছে ওই বিভাগেরই ৪৬ ব্যাচের কতিপয় শিক্ষার্থীর। ছেলেটা মানসিকভাবে এতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সে তার পিতাকে চিনতে পারছিলো না। ছেলেটি মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রশাসনের কাছে র‌্যাগিং বন্ধের দাবি জানায় শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষক মঞ্চ। এমনকি তারা বেশ কয়েকদিন হলগুলোতে নবীন ছাত্রদের খোঁজ নিতেও যান।

পরিস্থিতির চাপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র‌্যাগিংয়ের শাস্তি আজীবন বহিষ্কার বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু র‌্যাগিং বন্ধ করতে প্রশাসনের কোন কার্যকর নজরদারি দেখা যায় না। হলে হলে প্রতিরাতে শেষ রাত অবধি যে র‌্যাগ দেয়া হচ্ছে তা বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেই হল প্রশাসনের। যেহেতু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় র‌্যাগিং চলে তাই প্রশাসন তাদের বিরাগভাজন হতে চায় না। উল্টো খুবই হাস্যকরভাবে দায় সারার জন্য আওয়ামীপন্হী শিক্ষকেদের ব্যানারে র‌্যাগিং বন্ধে মানববন্ধন করে বেশ কয়েকটি বিভাগের সভাপতি, হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষক। অথচ তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলগুলোতে তাদের নাকের ডগায়তেই প্রতি রাতে চলছে র‌্যাগিং! তাই প্রশ্নে উঠেছে বিড়ালের গলায় আসলে ঘন্টাটা বাঁধবে কে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য র‌্যাগিংয়ের বন্ধে পত্রিকায় বিশাল এক উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন। অথচ তার সময়ে র‌্যাগিং আরো ভয়াবহ রূপ ছিল। ব্যাপারটা এমন যেন, যে যায় লংকায় সে হয় রাবণ!

গত ২ মার্চ ঘটে আরেক ভয়ঙ্কর ঘটনা। শহীদ রফিক-জব্বার হলের ৪৭ তম ব্যাচের গণরুমে ৪৬ তম ব্যাচের ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন কর্মী ঢুকে কান ধরা, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা এবং পরে জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে থাকতে বলে। ঝুলে থাকতে যেয়ে পরে গিয়ে আহত হয় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের আজওয়াদ আহমেদ। আজওয়াদের আঘাত গুরুতর ছিল, যে কারণে বিশ্বদ্যিালয়ের মেডিকেল থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

মেয়েদের হলগুলোর চেয়ে ছেলেদের হলগুলোতে র‌্যাগিং বেশি গুরুতর। আপেক্ষিকভাবে ছেলেদের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। সারা রাত জাগিয়ে র‌্যাগিং চলার পর তাদের পক্ষে ক্লাসে নিয়মিত হওয়া কঠিন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি ২০১৫ সালে। সেই থেকে আমার পর্যবক্ষণ বলছে, প্রতিবছরই র‌্যাগিং নিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে জাাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী র‌্যাগিং প্রথার বিপক্ষে। গুটিকয়েক যে কয়েকজন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর ছত্রছায়ায় ও প্রশাসনের আশকারায় নবীন শিক্ষার্থীদের র‌্যাগ দিচ্ছে তারা নিপীড়ক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার দায়ে অপরাধী। যেহেতু ক্যাম্পসের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ র‌্যাগিংয়ের বিপক্ষে, তাই প্রশাসন চাইলে র‌্যাগিং বন্ধ করা যায়।

ছাত্রলীগের মূলনীতিতে আছে- 'শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি'র কথা। বাংলাাদশের বহু গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের অংশীদার ছাত্রলীগ। তাই ছাত্রলীগের উচিত শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থে র‌্যাগিং অপসংস্কৃতি বন্ধ করা।

 

পূর্ব প্রকাশিত: www.poriborton.com, ২৪ মার্চ ২০১৮