মুজিব বর্ষে ডিজিটাল বাংলাদেশের উপহার ‘ফ্রিল্যান্সার সনদ’

শাদনান মাহমুদ নির্ঝর
Published : 26 Nov 2020, 05:05 PM
Updated : 26 Nov 2020, 05:05 PM

গত বছরের শেষ নাগাদ বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভুটানের পথে রওনা দিলাম। বর্ডার ইমিগ্রেশনে ডাক পড়ল আমাদের। ইমিগ্রেশন পুলিশের ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "কী করেন? কাগজ দ্যান।"

বাংলাদেশের প্রথা বিবেচনায় আমার পরিচয় একজন বেকার। আবার আমার পড়ালেখা শেষ তাই স্টুডেন্ট আইডি নামের মহামূল্যবান বস্তুর ভ্যালিডিটিও শেষ।

বললাম, "আমি ফ্রিল্যান্সিং করি।"

ইমিগ্রেশন পুলিশ ধরে বসলেন; যেহেতু আমি চাকরি করি না, ব্যবসার কাগজপত্র নেই, আবার স্টুডেন্ট আইডি কার্ডের ভ্যালিডিটিও নেই। কোনো ভাবেই আমাকে বর্ডার পার হতে দেবেন না তিনি।

ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট প্লেসের কাগজ দিলাম; এই বোঝাই, সেই বোঝাই। প্রায় তিন ঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে, ইমিগ্রেশনের অন্য এক কর্মকর্তা এসে ওনাকে বোঝানোর পর আমার ইমিগ্রেশন কমপ্লিট হয়। ততক্ষণে আমাদের প্ল্যান করা ট্যুর পুরোটাই ওলট পালট।

একবার কোনো এক প্রাইভেট ব্যাংকে কাজে গিয়েছি। সেখানে যে ডেস্কে আমার কাজটা হবে সেই ডেস্কের কর্মকর্তা একজনের সাথে বাদানুবাদে ব্যস্ত। বাদানুবাদের বিষয় হচ্ছে কোনো একটা ফর্ম ফিলাপে জব ডিটেইলস সাবমিট করা লাগবে। যিনি সাবমিট করছেন তিনি নিজের পেশা দিচ্ছেন ফ্রিল্যান্সিং, কিন্ত তার পেশা ভেরিফাই করার মত কোনো কিছুই উনি সাবমিট করতে পারছেন না।

বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে বললাম,  "ভাই, ফ্রিল্যান্সিংটা কই করেন, একটা লিংক দেখালেই তো হয়।"

উনি বললেন, বড় ভাইয়ের সাথে গ্রাফিক্সের কাজ করেন। অনেক কথা চালাচালির পর বড় ভাইয়ের সাথে কাজ করা ফ্রিল্যান্সার ভাই তার কাজ করতে না পেরে ব্যাংককে আচ্ছা মত গাল দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন।

বাংলাদেশের রিজার্ভে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জমা হচ্ছে তার কিছু ভাগ আসে এইসব এইসব ফ্রিল্যান্সার বা মুক্ত পেশাজীবীদের থেকে।  যদি ডিকশনারি খুলে ফ্রিল্যান্সিং মানে  খোঁজার চেষ্টা করেন, তাহলে ফ্রিল্যান্সিং বলতে আসলে এই দেশে কী বোঝানো হয় তার উত্তর পাবেন না। আমাদের দেশে ফ্রিল্যান্সিং মানে মোটা দাগে  বাইরের দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করা; এরপর ক্লায়েন্ট ডলারে পে করলে যে কোনো পেমেন্ট গেটওয়ে দিয়ে সেই টাকা দেশে নিয়ে আসা। মোট কথা এই দেশে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গায়ে ট্যাগ লাগাতে হলে ওই ব্যক্তির বাইরের দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করতেই হবে – তা সে সরাসরি করুক অথবা মার্কেটপ্লেসে।

গিগ ইকোনমিতে (একধরনের খণ্ডকালীন কাজের ব্যবস্থা) বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। বিশাল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই খাত থেকে আয় হয়। দেশের অর্থনীতিতে এত বড় অবদান রাখার পরেও ফ্রিল্যান্সারদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই দেশে টিউশনি যা, ফ্রিল্যান্সিংও প্রায় ওইরকম ভাবেই দেখা হয়। যদিও এমন একজনকে চিনি শুধু ওয়েবসাইটের ডিজাইন বিক্রি করে বাৎসরিক আয়ের হিসাব কোটির ঘরে নিয়ে যেতে পেরেছেন তিনি। মাসে লাখ টাকা আয় করা পরিচিত আরেকজন  সেদিন দুঃখ করে বলছিলেন, ২৫ হাজার টাকা বেতনের বেসরকারি চাকরি করা একজন চাইলেই ক্রেডিট কার্ড পান, আর আমি মাসে লাখের উপরে পাই কিন্ত ক্রেডিট কার্ডের জন্য এফডিআর ছাড়া অ্যপ্লাই করতে পারি না।

সুখবর হচ্ছে, কিছু দেরিতে হলেও ফ্রিল্যান্সিং খাতের উন্নতির দিকে সরকার চোখ দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ভার্চুয়াল আইডি কার্ড করার সুবিধা উদ্বোধন করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ এতটা গুরুত্ব নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং খাতের দিকে তাকানোর জন্য। সরকারের একটু সদিচ্ছা থাকলেই এই খাত হয়ে সরকারের আয় আর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার অন্যতম বড় খাত হয়ে উঠতে পারে।

আমাদের মত ফ্রিল্যান্সারদের হাজারটা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। কাজ শেষ হওয়ার পর ক্লায়েন্ট ১০০ ডলার টিপস দিতে চাচ্ছেন, কিন্ত পেপ্যাল না থাকায় সেই টিপস নিতে পারিনি, এমনও হয়েছে। ব্যাংকে কনভার্সন রেটের নামে প্রতি ডলারে চার থেকে পাঁচ টাকা কেটে নেওয়া হয়; অন্যদিকে ইন্টারনেটের অতি উচ্চ মূল্য সমস্যা তো আছেই।

বিদেশ থেকে যারা ডলার পাঠান (রেমিটেন্স) তাদের সরকার  দুই শতাংশ প্রণোদনা দেয়। কিন্তু আমরা ফ্রিল্যান্সাররা সেই একই গেটওয়ে দিয়ে ডলার আনলে প্রণোদনা আমরা পাই-ই না, বরং প্রতি ডলারে ৮৮ টাকার জায়গায় আমরা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাই ৮২ টাকার মতো।

এত এত সমস্যার মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে সরকারের এই নতুন উদ্যোগ freelancers.gov.bd ওয়েবসাইট।  কোনো সুযোগ দেওয়া আগে সরকার ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সমন্বিত ডেটাবেজ তৈরির চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করেই সরকার ফ্রিল্যান্সিং খাতের নতুন উদ্যোগ নেবে বলেই ধারণা করছি।

'চাকরি করব না, চাকরি দেব' মন্ত্রে বারবার উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের আইসিটি বিভাগের যে এই ফ্রিল্যান্সিং খাতের উপর সজাগ দৃষ্টি রয়েছে তারই প্রতিফলন হচ্ছে এই ওয়েবসাইট।

কীভাবে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিবন্ধিত হতে হয়?

ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিবন্ধনের জন্য যেতে হবে app.freelancers.gov.bd/signup  লিংকে। নাম (এনআইডি অনুসারে), ই-মেইল, মোবাইল আর আট অক্ষরের পাসওয়ার্ড দিয়ে এখানে নিবন্ধন করা যাবে। নিবন্ধন ফরম জমা হলে ই-মেইলে অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করতে বলা হবে। ভেরিফিকেশন শেষে নিজের অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করা যাবে।

লগ-ইন করার পরের কাজটি গুরুত্বপূর্ণ।  'ফ্রিল্যান্সার আইডি' বাটনে ক্লিক করা হলে চার ধাপের একটি ফরম আসবে। প্রথম ধাপে নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (এনআইডি চাওয়া হয় ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করার জন্য), ফোন নম্বর দিতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপে ফ্রিল্যান্সারকে তার কাজের যাবতীয় তথ্য এবং সর্বশেষ ১২ মাসের আয়ের পরিমাণ জমা দিতে হবে। তৃতীয় ধাপে আরো কিছু তথ্য দিতে হয় এবং  সবশেষে  ছবি সংযুক্ত করতে হয়।

যেহেতু এই তথ্য ব্যক্তির এনআইডির বিপরীতে জমা থাকবে তাই এমন ছবি নির্বাচন করতে হবে যেন এনআইডিতে থাকা ছবি আর এই ওয়েবসাইটে সংযুক্ত করা ছবির মধ্যে মিল থাকলে ভালো।

কারা নিবন্ধন যোগ্য?

তবে চাইলেই নিজেকে ফ্রিল্যান্সার দাবি করে ফ্রিল্যান্সার আইডি নেওয়া যাবে না। এজন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতেই হবে। যেমন, ব্যক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, শেষ ১২ মাসে অন্তত এক হাজার ইউএস ডলার আয়, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করার কাগজ,  লিগ্যাল পথে আয় থাকতে হবে।

এই চার শর্তের কোনো একটিতেও কম থাকলে অ্যপ্লিকেশন বাতিল হয়ে যাবে।

আয়ের তথ্য কীভাবে তারা ভেরিফাই করবে?

ব্যাংক স্টেটমেন্টের মাধ্যমে এই ভেরিফিকেশন করা হয়। আয় ১৫০০ ডলার বলা হলে  ব্যাংক বা আয়ের কোনো মাধ্যমে সেই ১৫০০ ডলারের হিসেব না থাকলে সেই ক্ষেত্রে  অ্যাপ্লিকেশন বাতিল হবে। তাই ভুল তথ্য দেওয়া যাবে না।

ফ্রিল্যান্সার নিবন্ধন ফি ধরা হয়েছে ১৫০০ টাকা যা কার্ড বা এমএফএসে পরিশোধ করা যাবে। তবে অ্যপ্লিকেশন বাতিল হলে সেই টাকা আর ফেরত হবে না। প্রতি ১২ মাসে একবার  তথ্য হালনাগাদ করতে হবে এবং হালনাগাদ ফি প্রতি বছরের জন্য ১৫০০ টাকা।

অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ না করলেও ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়া যাবে, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিদেশে থাকা ক্লায়েন্ট কত টাকা কীভাবে পাঠিয়েছে তার স্টেটমেন্ট দিতে হবে।

সব তথ্য ঠিক থাকলে সাত কর্মদিবসের মধ্যেই ভার্চুয়াল কার্ড ইস্যু হবে। তথ্য নিশ্চিত করতে আবেদনকারী ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে ভিডিও কল বা অন্য যে কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করা হতে পারে। উপার্জনের প্রমাণ হিসেবে যে কোনো কাগজ বা ব্যাংক স্টেটমেন্ট  চাওয়া হতে পারে।

যদি কেউ মার্কেটপ্লেস বা সরাসরি ক্লায়েন্টের সাথে কাজ না করে থাকেন, লোকালি কারো অধীনে কাজ করেন তারাও নিবন্ধন করতে পারবেন; সেক্ষেত্রে তারা ওই ফ্রিল্যান্সারের টিম ম্যানেজার হিসেবে নিবন্ধন করতে পারবেন।

অনেক ভাবতে পারেন এখন হয়ত ট্যাক্স দিতে দিতে শেষ হয়ে যেতে হবে। সুসংবাদ হচ্ছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইটি খাতের সব কিছুতে ট্যাক্স মওকুফ। বর্তমান করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা আয় করলেও সরকার ফ্রিল্যান্সারের কাছে ট্যাক্স চাইবে না, ৩ কোটি টাকাতেও না। তবে অবশ্যই সেই আয় আইটি খাতে হতে হবে।

তাই দেরি না করে ফ্রিল্যান্সাররা  নিজের আইডি করে ফেলুন। ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে, পাসপোর্ট-ভিসা ও সরকারি সব খাতে আবেদন করতে এখন সরকার নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার আইডি থাকলেই হচ্ছে। এছাড়াও ভবিষ্যতে এই খাতে প্রণোদনা পেতে এই আইডি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে স্বাভাবিক ভাবেই।