টকশোতে মারামারি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চাপসৃষ্টিকারি গোষ্ঠীর মূমুর্ষূ প্রভাব

শফিকুল ইসলাম(শফিক)
Published : 6 May 2015, 07:26 PM
Updated : 6 May 2015, 07:26 PM

গত দু'দিন ধরে প্রায় সব পত্রিকার অনলাইন সংস্করনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদের মধ্যে একুশে টিভির টকশোতে দুই আলোচকের মারামারির ঘটনাটি পাওয়া যাচ্ছে । ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনাও হচ্ছে বেশ। আসলে ব্যাপারটি তেমন নয়। এটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর দৈন্য অবস্থার একটা উদাহরণ মাত্র। এ ধরণের ঘটনা বা এর এর চেয়ে বড় ঘটনা ঘটছে বা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব আজ খাদের কিনারায়। এর শেষটা দেখার দিকে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি।

বুদ্ধিবৃত্তিক চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তথা সুশীল সমাজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটা সময় ছিল যখন রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের কাছে সুশীল সমাজ ছিল পরম আগ্রহের জায়গা। রাষ্ট্র ও জনগনের মাঝে একটি নিরপেক্ষ ও কল্যাণকামী সত্তা হিসেবে বিদ্যমান ছিল এই গোষ্ঠী। কালের বিবর্তনে সুশীল সমাজ তার সর্বজনীন রূপ হারাতে থাকে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। কারণ আজকের সুশীল সমাজ কোন না কোন এনজিও বা দাতা সংস্থার বৈতনিক উপদেষ্টা। এখানে যতটা না নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সামগ্রিক কল্যাণের কথা বলতে হয় তার চেয়ে বেশি ভাবতে হয় সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থার কথা। এখানে সুশীল সমাজ ব্যক্তি নয় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াচ্ছে।এ ধরণের অনেক সমস্যা আছে যার ফলে সুশীল সমাজের আজকের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা।

বাংলাদেশে সুশীল সমাজকে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় দেখা যায় গত ৫ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া বিএনপি –জামাত জোটের পেট্রল বোমার মাধ্যমে মানুষ হত্যা করে মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যখন তাঁদের কে নীরবে মাঠ ছাড়তে হয়। শ্রদ্ধাভাজন ডঃ শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত সুশীল সমাজের নাগরিক কমিটিতে এমন একজনের নাম পাওয়া যায় যিনি কমিটি গঠনের কিছুদিন আগেও বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর একতরফা সমালোচনা করে দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকে বিশাল এক নিবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি কিভাবে নিরপেক্ষ হন ? সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে তিনি বিএনপি জোটের পেট্রল বোমার আন্দোলন কে "তথাকথিত" বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন ।গঠিত কমিটিকে বিএনপি স্বাগত জানালেও আওয়ামীলীগ সরকার বিরোধী এজেন্টদের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে কমিটি গঠিত হয়েছে দাবি করে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে। আওয়ামীলীগের দাবির যথার্থতা প্রমাণিত হয় নাগরিক কমিটি গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ ফাঁসের মাধ্যমে। ফোনালাপে রাজনীতির জন্য ছাত্র হত্যা, সামরিক শাসন, টকশোতে নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়ন নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে কথা বলার মতো বিষয় জনসন্মুখে চলে আসে। এরপর নাগরিক কমিটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিখ্যাত আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা এধরনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হয়ে থাকেন যারা নিজ নিজ জায়গায় সফল হয়ে সমাজের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁরা দলমত নির্বিশষে এক অস্পর্শনীয় উচ্চতায় অবস্থান করেন । কিন্তু আমাদের অবস্থা ভিন্ন।আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আর সুশীল দরকার হয় না। তাদের নিজস্ব সুশীল আছে। কোন দল যদি ১০০ জন সুশীল নিয়ে কমিটি গঠন করে আরেক দল ১০০০ জন নিয়ে কমিটি গঠন করে। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা সুশীল সমাজের মহড়া দেখতে পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ডঃ এমাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত বিএনপি সমর্থিত শত নাগরিক কমিটি যখন নির্বাচনকে ইতিহাসের জঘন্যতম নির্বাচন আখ্যা দিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ সামসুল হকের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী সমর্থিত সহস্র নাগরিক কমিটি নির্বাচন কে অবাধ, নিরপেক্ষ তকমা দিলেন। তারা কেউই বিবেক খাঁটিয়ে কথা বলেননি, দলের কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলে গেছেন। আমাদের বিবেকের আদর্শ ব্যক্তিরা এভাবে কেনো কথা বলে?

আবার কিছু সুশীল সমাজের নিরপেক্ষ ব্যক্তি আছেন যারা যদি, তবে , কিন্তুর মাধ্যমে তাদের একটি নির্দিষ্ট আদর্শের কথাই বলে যান। কিন্তু দেশের নিরপেক্ষ ব্যক্তি কারা এই ডাকে সবার আগে হাত তোলেন? আমাদের অগ্রজ অনুকরণীয়রা যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন ভবিষতে হয়তো আদর্শের উদাহরণ দিতে গিয়ে গুগল সার্চ দিয়েও পাওয়া যাবেনা অথবা বিমূর্ত উদাহরণ দিতে হবে ।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শেখার জায়গা গুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। সংসদে রাজনীতিবিদরা প্রতিপক্ষকে গালি দিতে গিয়ে এমন সব ভাষা ব্যবহার করে যা তথাকথিত বস্তির মানুষের ভাষা বলে জনসমাজে পরিচিত। প্রতিপক্ষের বাবা মায়ের চেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলতে আমাদের সংস্কৃতিতে প্রচলিত শ্রদ্ধাসুচক শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে।সমাজের আদর্শরা সর্বজনীন আদর্শিক মানদন্ডে কথা বলা ভুলে গেছেন। আর টেলিভিশিনের পর্দায় গিয়ে তাঁদের লাইভ মারামারির ঘটনা কি এমন বিচিত্র?

সুত্র লিঙ্কঃ-
১। http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article964040.bdnews
২। http://www.prothom-alo.com/opinion/article/518026
৩।http://www.prothom-alo.com/opinion/article/497443