আমরা সবসময় ক্ষমতাসীনদের দোষ খুঁজি । নিজেদের দোষ চোখে পড়ে না। তাই আজ প্রশ্ন করবো না রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাওয়া কারণে উপকূল সীমান্তে টহল বাড়ানো সত্বেও কিভাবে ২৫ হাজার মানুষ(রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী) অবৈধ পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়? আমার জানার ইচ্ছে করেনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় অবৈধ পথে বিদেশগমন বন্ধ করার জন্য সচেতনতামূলক কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? আজ জানতে চাইব না জ়ি টু জি প্রোগ্রামের বিরোধীতাকারীরা বৈধ পথে লোকজন না পাঠাতে পেরে মানুষ ঠকানোর অন্য কোন পন্থা বেছে নিয়েছে কিনা তা জানার জন্য সরকারের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল কিনা?এতগুলো মানুষের জীবন যাওয়ার পর এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার পর কেনো ৩০০ জনের তালিকা ধরে অভিযান চলছে?আমি প্রশ্ন করবো না কেনো মানব পাচারকারীদের একের পর এক এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হচ্ছে যারা অনেক তথ্যের উৎস হতে পারত?
কয়েকদিন ধরে ভাবছি লাশ নিয়ে লিখব। সীমান্ত লাশ, থাইল্যান্ডের লাশ, পেট্রল লাশ, এনকাউন্টার লাশ ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে থাইল্যান্ডের লাশ গুলো বারবার মাথায় কিলবিল করছে। কিন্তু এই লাশগুলোর প্রতি আমার দরদ কেনো যেন তুলনামূলক কম মনে হচ্ছে।
আমরা গরিব। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করে। কিন্তু বিবেক-বুদ্ধি তো আমাদের আছে ? চায়ের দোকানে দাঁড়ালে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে পৃথিবীর সকল খবর পাওয়া যায়। সারাদিন ভ্যান চালায় যে মানুষটি সেও জানে আজকের দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি। ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ হেরেছে কি জিতেছি, খালেদা জিয়ার বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ কখন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, নেপালে কতজন মানুষ ভূমিকম্পে মারা গেছে ইত্যাদি খবর আজ তাদের নখদর্পণে। শুধু তাই নয় বেখবরও সবার আগে তারা পায়। সাঈদীকে রাত তিনটায় চাঁদে তারা নিজ চোখে দেখেছে অথবা না দেখলেও খবরটা রাত চারটার মধ্যে শুনেছে। মতিঝিলে একরাতে কয়েক হাজার মানুষ মারা যাওয়ার খবরও তারা শুনেছে এবং বিশ্বাস করেছে।কোন খবর তাদের অজানা নয়।
তোমার চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম- এই কথা এখন আর বলতে হয় না। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সাথে সাথে উত্তর পাওয়া যায়। এখন ৩০০-৫০০ টাকা হলে কথা বলার উপযুক্ত একটা মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। নিতান্তই অসামর্থ্য ব্যক্তিও তার প্রতিবেশির মোবাই ফোনের মাধ্যমে দূরের আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে নেয়। জগে রাখা পানি কোন কারণে কেঁপে উঠলে ঢাকায় কাজ করা কাজের বুয়া সাথে সাথে খোঁজ নেয় গ্রামে তার মা-বাবা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা?
আমরা সব খবর পাই , সব খবর জানি। শুধু এই খবরটা জানিনা সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। কেউ যদি ভাগ্যগুণে মালয়েশিয়া পৌঁছেও তার কপালে নেমে আসে অমানবিক অত্যাচার। আদম ব্যাপারিরা তাদের বিক্রি করে দেয় কোন এক কৃষি মহাজনের কাছে। যেখানে সারাদিন কাজ করতে হয়, কিন্তু খাবার বেলায় অর্ধেক পেট ভরে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ভাগ্য পরিবর্তন তো দূরের কথা পুরো পরিবারের ভাগ্যে নেমে আসে বিপর্যয়। অনেক সময় আদম ব্যাপারিরা তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ দেওয়ার জন্য বাড়ি-ভিটা, গরু –ছাগল সব বিক্রি করে টাকা পাঠায় পরিবার। তবুও অনেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসে , আবার অনেকের ভাগ্যে কি হয়েছে পরিবার কোনদিন জানতেও পারে না। হয়তো সমুদ্রে সলিল সমাধি অথবা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একসাথে অনেকের শেষ শয্যা।
থাইল্যান্ডের জঙ্গল, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার উপকূল হতে যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কেউ ৪০০ রিঙ্গিত দিয়ে, কেউ বা ১০/২০ হাজার টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকায় চেপে বসেছে। জোর করে কাউকে নৌকায় তোলা হয়েছে এ ধরণের অভিযোগ কিন্তু কম।অল্প কিছু ভুক্তভোগী জবরদস্তির অভিযোগ এনেছে। এখন প্রশ্ন সবকিছু জানা সত্বেও তারা কেনো মৃত্যু কূপে লাফ দিয়েছে? সরকার ও সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে কি সম্ভব একজন মানুষকে চব্বিশ ঘন্টা পর্যবেক্ষনে রাখা? সাধারন নাগরিকদের কি কোন দায় নেই?
অনেকে বলছে দারিদ্রতার কারণে ওরা বিদেশ যেতে চায়। খোঁজ নিয়ে দেখুন বাংলাদেশের চরম দরিদ্ররা কখনো বিদেশ যাওয়ার চিন্তা করেনা।তাঁরা ইট ভেঙ্গে, রিকসার প্যাডেল চেপে, নির্মাণ শ্রমিকের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে বা অন্য যেকোন উপায়ে দিনাতিপাত করে ।যারা যায় তাদের বাড়ি ভিটা, আবাদি জমি, পোষা প্রাণী বিক্রি করে ৫/ ১০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য আছে।
ভুক্তভোগীদের আমি দায় বেশি দিচ্ছি এর পেছনে অনেক কারণ আছে। ধরে নিলাম আগে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর কিছু শোনেনি তারা। কিন্তু ৪ মে থাইল্যান্ডের গণকবরে বাংলাদেশীর লাশ এবং একজন জীবিত বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে এই খবর কিন্তু তাদের কানে পৌঁছেছে। কারণ পত্রিকাগুলো শিরোনাম করেছে উপকূলীয় মানুষের আহাজারির কথা। এতসব খবর সত্বেও ১২ মে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে টেকনাফ থেকে ১১৬ জন কে ধরা হয়েছে। শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে ১১ জন কে আটক করা হয়েছে। মাছ ধরার ছোট নৌকায় করে বড় জাহাজে ওঠার জন্য আরো অনেকে যে সমুদ্রে পাড়ি দেয়নি তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।ভবিষ্যতে যে কেউ যাবে না এটাও বলা দুস্কর।“বাঁচি আর মরি আমি যাব”- এই ধনুকভাঙা পণ যারা করে বসে আছে তাদের বাঁচানো কঠিন। তাদের মরতে দেওয়া উচিত? অথবা দেশে ফিরিয়ে এনে অবৈধভাবে বিদেশ গমন ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপরাধে বিচারের আওতায় আনা দরকার।
সূত্র লিঙ্কঃ-
১।http://bangla.bdnews24.com/world/article963463.bdnews
২। http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article966958.bdnews
৩।http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article967340.bdnews
৪।http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article967829.bdnews
৫।http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article965370.bdnews
৬।http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article967440.bdnews
৭।http://bangla.bdnews24.com/world/article965819.bdnews
৮।http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/528286
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেছেনঃ
মানব পাচার ও মানব চোরাচালানের মধ্যে যে সূক্ষè পার্থক্য আছে তা কিছু দিন আগেও বুঝতাম না। এর বড় কারণ সম্ভবত বাংলাদেশে মানব পাচার নিয়ে যত হৈচৈ হয়, মানব চোরাচালান নিয়ে ততোটা হয় না। অন্যদিকে মানব পাচার প্রতিরোধ ও ভিকটিমদের পূনর্বাসনের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন (মানব পাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২) থাকলেও মানব চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন আইন নেই। তাই এদেশে মানব পাচার আর মানব চোরাচালানকে এক করে দেখার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
সাধারণ মানুষতো বটেই এমনকি বিশেষজ্ঞরাও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এ দুটো প্রত্যয় নিয়ে বড় গোলমেলে অবস্থার মধ্যে থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে, অন্তত এই মুহূর্তে, মানব চোরাচালান বলতে কোন অভিধাই নেই। এখন সবই মানব পাচার। অভিযোগ হলেই মানব পাচার, অভিযোগ হলেই ২০১২ সালের সেই বিশেষ আইনে মামলা। কিন্তু যেখানে অপরাধের সংজ্ঞা তথা খোদ প্রত্যয়টি নিয়েই মত বিরোধ রয়েছে, সেখানে যতই মামলা নেই, তদন্ত করি, অভিযোগপত্র দাখিল করি এবং অপরাধটি আদালতে প্রমাণের চেষ্টা করি, চূড়ান্ত বিচারে অপরাধীর সাজা হয়না বললেই চলে। গড়পড়তায় এ আইনের মামলাগুলোতে আদালতের বিচারে অভিযুক্তরা খালাস পাচ্ছে।
আপনার সাথে আমি এক মত। এটা মানব পাচার সংক্রান্ত অপরাধ সামান্যই। এটা মূলত মানব চোরাচালান। মানব চোরাচালানের অপরাধী বেবল চোরাকারবারীগণই নয়, যারা ভিকটিম তারাও। তাই তাদেরও সাজা হওয়া দরকার।
শফিক বলেছেনঃ
ধন্যবাদ, আব্দুর রাজ্জাক ভাই। আমার মতের আইনি দিক তুলে ধরার জন্য।
শফিক বলেছেনঃ
সন্মানিত অভিজ্ঞ ও ভাষা বিশেষজ্ঞ লেখক ও ব্লগারদের কাছে আমার পোষ্টের বিষয় ভিত্তিক মন্তব্যের পাশাপাশি শব্দ চয়ন,ভাষা প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ ও সমালোচনা আশা করছি।
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেছেনঃ
আমার মতকে আমি আংশিক সংশোধন করছি। প্রকৃতপক্ষে যারা ভিকটিম হয়েছেন তারা ভিন্নতর বিবেচনায় প্রতারণার শিকার। এর বাইরেও একটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে, তাহল, এই যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কিছু মানুষ যে বিদেশে যাচ্ছেন তাদের মানসিক অবস্থাটা আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্র তাদের এক দিক দিয়ে যেমন প্রতারিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেনি, অন্যদিকে তাদের সমাজের বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি এক প্রকারের অবিশ্বাস বা আস্থাহনীতাবোধ হওয়াও নিবারণ করা যায়নি। তাই তারা এক অর্থে অপরাধের সহযোগী হলেও তাদের শাস্তির আওতায় আনা সঠিক হবে না।
মানব পাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৩৭(১) ধারার মূলভাবটা কিন্তু তাই।
অপরাধের সহয়োগীয় হয়েও আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা কিন্তু আমাদের ১৮৬১সালের পেনাল কোডেও রয়েছে। এটা হল ব্যভিচারের অপরাধ। পেনাল কোডের ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোন পুরুষ কোন বিবাহিত মহিলার সাথে যদি দৈহিক সম্পূর্ণ স্থাপন করে, তাহলে এটা ব্যভিচার হবে। তবে এক্ষেত্রে বিবাহিতা মহিলাটি অপরাধের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হবে না। এটা এ জন্য করা হয়েছে যে এ উপমহাদেশের মহিলারা এমনিতেই বহু বিবাহজনিত অত্যাচারের শিকার। তাদের যৌন জীবন প্রায়শই অতৃপ্ত। একদিকে সতিনদের সাথে একমাত্র স্বামীকে ভাগাভাগি করতে হয়, অন্যদিকে বৃদ্ধদের সাথে নাবালিকারও বিয়ে হয়। এজন্য তারা যৌন জীবনে স্বাভাবিকভাবেই অসুখি ও অতৃপ্ত থাকেন। এর বাইরেও আছে সামাজিক মর্যাদায় অচ্ছুত অবস্থান। এরা এমনিতেই স্বামীর সংসারে নিরন্তর শাস্তি পেয়ে থাকেন। তাই নতুন করে তাদের উপর পেনাল কোড প্রণেতা লর্ড মেকুলে সরকারি শাস্তি চাপাতে চাননি।
মানবপাচার ঘটনার ভিকটিমগণ এমনিতেই যথেষ্ঠ শাস্তি পেয়ে থাকেন। তারা শুধু আর্থিক দিক দিয়েই নিঃস্ব হন, না শারীরিক ও মানসিকভাবেও নির্যাতিত হন। তারা মৃত্যুর মুখ থেকে কোন প্রকারে বেঁচে আসেন। তাই তাদের নতুন করে রাষ্ট্র কর্তৃক শাস্তি দেয়াটা সমীচিন নয়।
শফিক বলেছেনঃ
‘কমন ল’ বিচারকদের মানবিক ও নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করার আইন স্বীকৃত স্বাধীনতা দিয়েছে। আমি আইনের ব্যাপারে তেমন জানিনা । তাই বেশি বলা ঠিক হবে না।বিচার যে শুধু লিপিবদ্ধ আইনে হয় তা নয়, বিচারকের প্রজ্ঞাও আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। আমি আপনার সাথে একমত।
গৌতম হালদার বলেছেনঃ
অসংখ্য ধন্যবাদ, এমন চমতকার একটি লেখার জন্য।
আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
শফিক বলেছেনঃ
ধন্যবাদ, গৌতম দা।