জাফরদ্বেষ: জ্বি হুজুর, হ্যাঁ হুজুর, না হুজুর

শফিকুল ইসলাম(শফিক)
Published : 18 May 2015, 11:16 AM
Updated : 18 May 2015, 11:16 AM


ছোট বেলায় সকালে ঘুম থেকে উঠে মক্তবে পড়তে যেতাম। পড়ানোর শেষ দিকে হুজুর আমাদের বাসায় এসে কি করতে হবে, কি করা যাবে না ইত্যাদি নিয়ে বলতেন। মাঝে মাঝে আরবি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা করতেন, " তোমরা কি বুঝেছ?" ।আমরা সমস্বরে চিৎকার দিতাম, "জ্বি হুজুর"।আসলে আরবি তখনো বুঝতাম না, এখনো বুঝি না।

রাজনীতির পাঠ নিতে গিয়ে হলো আরেক অভিজ্ঞতা। ১৯৮৮ সালে এসএসসি পাশ করা সভাপতি ভাই যখন জিজ্ঞাসা করলো, "বল্টু, আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?" বল্টুর উত্তর, " না ভাই, আপনাকে এখনো অনেক ইয়াং লাগছে?" ভাই খুশি হয়ে বল্টুকে সিগারেট আনতে পাঠিয়ে দেয়। পাশ থেকে একজন বুঝিয়ে দিল, ভাই যা বলবে তাতে হ্যাঁ-না করতে হবে। কোন কথা বলা যাবে না। বুঝলাম।

কিছুদিন আগে আশিকুর বাবুকে হত্যাকারী মাদ্রাসা ছাত্র তো বলেই দিয়েছে ব্লগ কি সে জানেনা। বড় হুজুরের আদেশে আশিকুর বাবুকে হত্যা করেছে।হয়তো হুজুর বলেছে, " জিকরুল্লাহ, ব্লগার আশিকুর বাবু ধর্ম অবমাননা করেছে, ওকে কতল করো? জিকরুল্লাহ, " জ্বি হুজুর, এখুনি কোপায় আসতেছি?"

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক কিছু মোসাহেব দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাজ উদ্দিন আহমেদের মতো ত্যাগী নেতাও দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হয়তো বলে থাকবেন, " মোস্তাক, আমি ভাল কিছু করবার চাই, তাজ উদ্দিন সমর্থন করছে না"।মোস্তাকের উত্তর, "জ্বি নেতা, আপনি জাতির জনক, যা করবেন তাই ঠিক। তাজ উদ্দিন তো আপনার ঘরের শত্রু"। বঙ্গবন্ধু শত্রু-মিত্র প্রভেদ করতে পারেন নি তাই স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় জাতি পিতৃহারা হয়েছিল।বড় পদের বড় সমস্যা, বিরুদ্ধাচারণ এমনকি গঠনমুলক সমালোচনাও মেনে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এ ব্যাপারে ফ্রান্সিস বেকন তার 'অব গ্রেট প্লেস' এ ভাল বলেছেন। যাদের প্রবন্ধটি পড়া নাই দেখে নিতে পারেন।

এক স্টুডেন্ট কে পড়াতে গিয়ে এক মধুর সমস্যায় পড়েছিলাম।কোন টিচার নাকি তাকে বেশিদিন পড়াতে পারেনা। স্টুডেন্ট মেধাবী। তাহলে সমস্যা কোথায়? কিছুদিন পড় আবিষ্কার করলাম। তাকে পড়ানোর পূর্ব শর্ত জাফর ইকবাল দিয়ে শুরু করতে হবে। ওর কাছে জাফর ইকবালের গল্প শুনতে হবে অথবা ওকে গল্প শোনাতে হবে। ওর মতো হাজার হাজার শিশু,কিশোর, তরুণ, তরুণী আছে যারা জাফর ইকবালের গল্প পড়ে অনুপ্রেরণা পায়, জাফর ইকবাল কে দেখে অনুপ্রেরণা পায়, জাফর ইকবাল হতে চায়।

গত কয়েক বছরে আমাদের নীতি ও আদর্শের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। অনেক রথী মহারথীকে সেই ঝড়ে উড়ে যেতে দেখেছি। যাদের লেখা পড়ে মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবেসেছি, দেশকে ভালোবাসার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছি তাদের অনেককে দেখেছি রাতারাতি বদলে যেতে। মিন মিন করে স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে কথা বলতে। কিন্তু একজন জাফর ইকবাল অঁটুট আছেন তাঁর আদর্শে।সেই আগের মতো সাধা-সিদে ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের কথা, শিশুদের কথা, তরুণদের কথা, শিক্ষার কথা বলে গেছেন, বলে যাচ্ছেন। আজ সাস্ট স্টুডেন্টদের ড্রোন তৈরি করা, দেশের প্রথম সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকার যাত্রা, এসএমএস এর মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির আবেদন ইত্যাদি সম্পন্ন করে হাজার হাজার শ্রম ঘন্টা ও অর্থ সাশ্রয়ের ব্যবস্থার পেছনে এই নিবেদিত প্রাণ মানুষটির অবদান অপরিমেয়। আমেরিকার বিলাস বহুল জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের লক্কর ঝক্কর রাস্তা দিয়ে অবিচল চিত্তে চলেছেন এই স্বপ্ন পাগল মানুষটি। অকুতোভয় আপনাদের ভাষায় ব্লগার জাফর ইকবাল। শিবিরের কর্মীরা যখন তাঁর জিব কেটে নিতে চায় তিনি চুপসে যান না। তিনি 'তোমরা যারা শিবির করো' শিরোনামে শিবিরদের প্রতি ভালোবাসা মিশ্রিত জবাব দেন। তিনি যা বিশ্বাস করেন তাই বলেন । কোন লুকোছাপা করেন না। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মেনে করতে হবে এই কথা তিনি বার বার বলতে দ্বিধা করেন না। মুক্তিযুদ্ধে পিতা হারানো শহিদ পরিবারের সন্তান আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মানুষটি।

আমাদের সমাজে ব্লগার কথাটি এখন মানুষ ক্ষ্যাপানোর অস্ত্র। তা না হলে হলে দুর্মূখেরা জাফর ইকবালের মতো একজন স্বনাম ধন্য লেখক, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক কে কেনো ব্লগার পরিচয় করিয়ে দিয়ে চাবুক দিয়ে পেটানোর কথা বলবে। আসুন দেখা যাক কী দোষ ছিল অধ্যাপক জাফর ইকবালের?

ঘটনার সূত্রপাত লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয়ের চাপাতি মৃত্যুর মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও উপদেষ্টা সম্মানিত সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্স কে বলেছেনঃ
"আমরা একটা সূক্ষ্ম রেখায় হাঁটছি। আমরা চাই না লোকজন আমাদের নাস্তিক বলুক। …যেহেতু আমাদের বিরোধী দল আমাদের বিপক্ষে ধর্মের কার্ড ব্যবহার করে, সে কারণে আমরা তাঁর (অভিজিৎ) পক্ষে জোরালোভাবে প্রকাশ্যে আসতে পারি না। ব্যাপারটা অনেক স্পর্শকাতর।"

এবার আসুন দেখি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার কী বলেছিলেন?
"অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডকে স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যে স্টেইটমেন্ট দিয়েছেন, তা মৌলবাদীদের জন্য একটা গ্রিন সিগনাল। মনে হচ্ছে, তোমরা (জঙ্গিরা) এভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাও, সরকার কিছুই করবে না। একজন একজন করে মারা হবে, সরকার কোনো কথা বলবে না। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে যা বলেছেন, তা মানতে আমি রাজি না। আমি তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ জানাই। এদেশে প্রত্যেকটা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাদেরকে মেরে ফেললে তা সেনসিটিভ ব্যাপার হয় না।"
এছাড়া, ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যার প্রতিবাদে গত বুধবার শাবিপ্রবিতে আয়োজিত এক মানববন্ধনে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছিলেন, "ব্লগার হত্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পুত্র যা বলেছেন আমি তার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।"

যদিও এমপি সামাদ ওরফে কয়েস চৌধুরী নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করেননি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার। উল্টো সাংসদ কয়েস চৌধুরী নিজ নির্বাচনী এলাকা ফেঞ্চুগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে সিলেটবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে তাকে 'কোর্ট পয়েন্টে এনে চাবুক মারার' ইচ্ছা পোষন করেন।

সিলেটে জনাব জয়ের বিরুদ্ধে কটূক্তি করার প্রতিবাদে বিশাল মিছিল হয়ে গেলো।মিছিলের স্লোগান ছিল খুবই কুরুচিপূর্ণ। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো মিছিলে অংশগ্রহণকারী একজন কর্মী ব্লগার জাফর ইকবালের শাস্তি চেয়ে ঝাঁঝালো বক্তব্য দেওয়ার সময় সংবাদ কর্মী তাকে প্রশ্ন করেন, " জাফর ইকবাল কী বলেছিলেন?" উত্তরে তিনি কিছুই বলতে পারেন নি। উপরের ঘটনা, কর্মীর বক্তব্য শুনে অনেকে মনে করবেন এমপি সাহেব জামায়াতের আর কর্মীরা হেফাজতের। না, আপনার ধারণা ভুল। এমপি সাহেব আওয়ামীলীগের আর নেতা কর্মীরা আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের। ভ্যাবচ্যাকা খেলেন মধ্যবাম আওয়ামীলীগের কর্মকান্ড দেখে? জামায়াতপন্থি একটি পত্রিকা যে ভাষায় রিপোর্ট করেছে তাকে পত্রিকার প্রতিবেদন বলব নাকি কারো প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ বলব বুঝতে পারছিলাম না।

ঘটনা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতে পারত যদি জনাব জয় ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে ব্যাপারটি নিয়ে নেতাকর্মীদের কথা না বলার জন্য বলতেন যেহেতু তিনি ফেইসবুকে নিয়মিত। কিন্তু তিনি বা দায়িত্বশীল কেউ এ ব্যাপারে কোন কথা বলেন নি। যুগে যুগে মোসাহেবরা দল থেকে সুযোগ গ্রহণ করেছে কিন্তু দলের বিপদে দলছুট হয়ে সুবিধা মতো অবস্থান নিয়েছে। একটা দল, একটা সরকার চালাতে শুধু ৩৫০ জন এমপি, জ্বি হুজুর, হ্যাঁ হুজুর , না হুজুর বোলধারীদের দিয়ে হয় না। জাফর ইকবালদের লাগে। দেশের শিক্ষানীতি প্রনয়ণে, দেশের সমসস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান নিরুপণে, দেশকে প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল করতে।

দেশের জন্য এদের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দেশের বুদ্ধিজীবী নিধনে নেমে ছিল যাতে বাংলাদেশ আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে? স্বাধীন দেশে জাফর ইকবাল কে চাবুক মারার হুমকি দেয়া হলেও কেনো স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি দাবিদার সরকার চুপ থাকে? বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর স্থান পূরণ করার মতো নেতা আমরা পাইনি। ভবিষ্যতে পাব এই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জাফর ইকবালের মতো একজন বিজ্ঞান মনস্ক অনুপ্রেরণাদায়ীকে আমরা যদি থামিয়ে দিই এর জন্য জাতিকে চরম মুল্য দিতে হবে। কারণ প্রথিতযশারা বার বার জন্মায় না।