লাবনী হত্যাকাণ্ড: সামাজিক মৃত্যুনামার আরেকটি অধ্যায়

শফিকুল ইসলাম(শফিক)
Published : 12 August 2017, 07:36 AM
Updated : 12 August 2017, 07:36 AM

আমি জানি প্রতিবাদের বিশাল দাবানলে আমি খড়ের একটা স্ফূলিঙ্গ মাত্র। তবুও প্রতিবাদের উপর আস্থা হারাইনি। কেউ শুনুক বা না শুনুক, কোন কাজে আসুক বা না আসুক আমি প্রতিবাদ করেছি। নারীর প্রতি যেকোন সহিংসতায় অনলাইনে বা অফলাইনে প্রতিবাদ মুখর হয়েছি। মাইক্রোবাসে ধর্ষিত নারীর জন্য প্রতিবাদ করেছি, তনু হত্যার প্রতিবাদে শাহবাগে দাঁড়িয়েছি। আমার সকল সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে চেষ্টা করেছি প্রতিবাদমুখর হওয়ার।এদের কাউকেই আমি চিনতাম না।শুধু সামাজিক অন্যায় হিসেবে একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু কখনো ভাবিনি নারীর প্রতি সামাজিক নৃশংসতার তীরটি ধীরে ধীরে আমার দিকে আসছে। হ্যাঁ, এবার সামাজিক নৃশংসতার শিকার আমার একজন বন্ধু, যারা সাথে আমাদের প্রত্যাহিক স্মৃতি জড়িত আছে।

লাবনী সাহা। সদা হাস্যময়ী মিস্টি একটি মেয়ে। আমি তাকে চিনি। আমাদের সহপাঠি। হয়তো সহপাঠি বলে আমি তার জন্য পক্ষপাতিত্ব দেখাব। কারণ আমার কাছে সে সবসময় ভালই হবে। তাই তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছি তার আশেপাশের লোকজনকে। তার বিপরীত ধর্ম, বর্ণের লোকজন কে। যেখানে সমাজের চোখে একজন ভদ্র, ভাল মেয়ের সার্টিফিকেট পেতে অধিকাংশ মেয়েই ব্যর্থ, সেখানে লাবনী সাহাকে সবাই অকুন্ঠচিত্তে ভাল বলছে। আমি নিজেকে মিলিয়ে নিলাম। এই জায়গায় লাবনী পাস করেছে এ+ না হোক অত্যন্ত এ গ্রেড পেয়ে। তার ফেইসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখুন তথাকথিত বেহায়াপনা কথা, ছবি কিছুই নাই। কিন্তু এত ভাল হয়ে কি লাভ হলো। ত্রিশ বসন্তে এসে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে! অভিমানী আত্মহত্যা! নাকি অপমৃত্যু?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত কারমাইকেল কলেজ থেকে ইংরেজি সাথি স্নাতকোত্তর ডিগ্রীপ্রাপ্ত লাবনী বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে চলতি বছরের মার্চ মাসেই। এখনো নখের মেহেদি উঠে যায় নি, বিয়ের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়নি। তাতেই তার মাঝে সংসার বৈরাগ্য দেখা দিল? সে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠল? কিন্তু আমরা যে লাবনীকে চিনি সে এমন নয়। সমাজের আর দশটা নারীর মতো তার গর্বের জায়গা ছিল তার পরিবার, পরিবারের সদস্যরা। ফেইসবুকে তাকে খুঁজতে গিয়ে তার পরিবার কেই বেশি পেয়েছি। যে মেয়ে ত্রিশ বছর শুধু পরিবারের জয়গান গাইল, যখন নিজের একটা পরিবার তৈরির সময় আসল, মাত্র পাঁচ মাসেই তার মনে হলো, এ সংসার আমার নয়? সে আত্মহত্যা করে বসল! সমীকরণটা কিছুতেই মিলছে না। কোথায় যেন হিসেবের গড়মিল থেকেই যাচ্ছে!

মার্চের ১২ তারিখে তার হলুদ ছোঁয়া অনুষ্ঠান ছিল। ফেইসবুকে একটা ছবি পেলাম। বাবা মেয়ের কপালে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। তার মন্তব্য,"আমার বাবু"। মার্চের ত্রিশ তারিখে ফেইসবুকে কাপল ছবি দিয়ে সবার কাছে জানিয়ে দিল নতুন জীবনে প্রবেশের কথা।সে লিখেছে," Starting new stage of my life"। কিন্তু মাত্র পাঁচ মাসেই সে স্টেজ পরিবর্তনের কথা ভাবল কেনো? পাঁচ মাসের সংসার জীবন তাকে কি এমন অভিজ্ঞতা দিয়েছে যে তাকে মরতে হবে?

পত্রিকায় প্রকাশ, গত মার্চ মাসে দেবাশিষের সঙ্গে একই জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলা শহরের গোবিন্দচন্দ্র সাহার মেয়ে লাবণীর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় ১২ লাখ টাকাসহ প্রায় ২০ লাখ টাকা যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়। কিন্তু এতেও দেবাশীষ দের নারী লিপ্সা মেটেনি।যৌতুক গ্রহণের সময় তার মনে ছিল না সে আরেকটি মেয়ের সাথে প্রেম করে। সব কিছু নেওয়ার পর তার দ্বিতীয় বিয়ের খায়েস জন্মে। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য অনুমতি চায়। চলে শারীরিক নির্যাতন।আর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে সে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।কিন্তু আত্মহত্যা কিনা তা নিশ্চিত নয় পরিবার?

সমাজের চোখে ভাল থেকে কি লাভ হলো লাবনীর? সমাজ তো তাকে রক্ষা করতে পারল না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নারীদের জন্য এখনো অনুকূল হয়ে ওঠেনি। এই সমাজ নারীকে বাঁচতে দেয় না, আবার মরতেও দেয় না। আজ ডিভোর্স এর হার বেড়ে যাওয়া নিয়ে কত আলোচনা? লাবনী মরে না গিয়ে যদি ডিভোর্স দিতো পাষণ্ড স্বামীকে, তবে সমাজ তাকে ছি ছি বলতো।লাবনী জানে একজন স্বামী পতিত্যক্তা নারী সমাজ ও সংসারে কত বড় বোঝা? এই সুযোগটি নেয় হিংস্র পুরুষরা। তাতে একজন নারী হয় আত্মহত্যা করে,অথবা সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে আত্মসন্মানহীন ও যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করে।লাবনী মরে গিয়েই বেঁচে গেছে।বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে তার পরিবারকে, সমাজকে।