নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনকারীদের ক্ষমা নেই (ভিকারুন নিসা নুন স্কুলের পশু পরিমল জয়ধরকে উৎসর্গ)

শাহ আলম বাদশা
Published : 7 July 2011, 05:48 AM
Updated : 7 July 2011, 05:48 AM

সুন্দরী অবুঝ শিশু সামিনা, বয়স ৮/৯ বছর। আর সুন্দরী হওয়াটাই হয়েছে ওর কাল। তালাকপ্রাপ্ত মায়ের সাথেই থাকে বস্তিতে। মা অন্যের বাড়িতে সারাদিন কাজশেষে সন্ধ্যায় ফেরেন আর সে ওর মা না আসা পর্যন্ত ঘরের ভেতর বা বস্তিতে খেলেই দিন কাটায়। দুঃখের কপাল তাই দুপুরের রান্নাটাও তাকেই সেরে ফেলতে হয়। ৬ বছর বয়স পর্যন্ত সে বকুলফুলের মালা বেচতো। এখন ওকে তা করতে দেয়না ওর মা। এরই মধ্যে ঘটে যায় ওর ছোট্ট জীবনের চরম সর্বনাশ। একদিন দুপুরবেলা বস্তির বখাটে সুজন সদলবলে ঘরে ঢুকে সামিনাকে ধর্ষন করে পালিয়ে যায়। পর সন্ধ্যায় মা এসে রক্তাক্ত ও অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে শেষপর্যন্ত বেঁচে যায় সে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও ওর মা আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষুর ভয়ে। উল্টো নিজের জীবন বাঁচাতে মেয়েসহ তাকেই বস্তি ত্যাগ করে চলে যেতে হয়।

এ ধরনের আরও কত সামিনা, তানিয়া, টুনিদের ভাগ্যে প্রতিনিয়ত ঘটছে পাশবিক নির্যাতন ।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীর সোনালি ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন তছনছ করে দিলো পরিমল জয়দর নামের শিক্ষকরুপি এক জানোয়ার। শুধু এক পরিমলই নয়, ওই স্কুলের আরো পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন অভিভাবকরা। সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া ওই শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন বরুণ চন্দ্র বর্মণ, বিষ্ণুপদ বড়াই, বাবুল ও অভিজিৎ। অভিযুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে বরুণ চন্দ্র বর্মণের বিরুদ্ধে বাণিজ্য বিভাগের দশম শ্রেণীর ছাত্রীরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে গত ২৭ জুন।

কিন্তু এদের ক্ষেত্রে বিচারের বাণী কেবল নির্ভৃতেই কাঁদে, হয় না সন্ত্রাসী-ধর্ষকদের বিচার। কিছু কিছু পত্রিকায় এসব কাহিনীর প্রচার হলেও অধিকাংশই ঘটনাই থেকে যায় আড়ালে। মূলতঃ শিশু ও নারীধর্ষণ আর নির্যাতন আজ সামাজিক এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। একারণেই '' কর্মজীবী নারী'' নামক একটি বেসরকারি সংস্থা ২০০৬ সালে সংঘটিত নারীনির্যাতনের ওপর একটা জরিপ চালায়। এদেশের ১০টি জাতীয় দৈনিকে২০০৫ এর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত সহিংসতার ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তারা যে তথ্যচিত্রটি প্রকাশ করেছে, তা এক কথায় ভয়াবহ। সংখ্যাচিত্রে দেখা যায় যে, ২,৭২৯ জন নারী ও শিশু নানারকম সহিংসতার শিকার হয়েছে। ধর্ষণ, এসিডনিক্ষেপ, যৌতুক, পাচার, অপহরণ, আত্মহত্যা, শারীরিক নির্যাতন, যৌনহয়রানি ও অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ৬০৬, ১৪৭, ৮৮, ১৫৫, ৩৫৭, ৮৬৪, ২১০, ৪৩ ও ২০টি। এছাড়াও ১৮টি অপহরণ চেষ্টা, ৪৭টি হত্যা প্রচেষ্টা, ৬০টি রহস্যজনক মৃত্যু, ২৩টি আত্মহত্যার চেষ্টা, ২৫টি ফতোয়া এবং ৬টি উত্যক্ত করণের ঘটনাও ঘটেছে। এতসব ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে মাত্র ১,১৫২টি আর মামলা হয়নি ৭৫৬ টির । ৮২১টি ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হওয়া না হওয়ার কোন তথ্য উদঘাটিত হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়না এমন ঘটনার সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। আর ২০১১ সালে এসে তার ভয়াবহ রূপটি যেন হাজারো শাখা-প্রশাখায় এবং প্ত্র-পল্লবে বিস্ফারিত হয়ে আমাদের জানান দিচ্ছে যে, তোমরাও দেখি পাক হানাদার বাহিনীর চেয়ে কোন অংশে কম নও? ওরা অবাঙ্গালী হয়ে লাঞ্ছিত করেছিল আমাদের মা-বোনদের আর তোমরা নিজেরাই লাঞ্ছিত করছো নিজেদের মা-বোনদের!!!

তাই দেখা যায়, গরীব-ধনী নির্বিশেষে বিভিন্ন আঙ্গিকেই নারী ও শিশু নির্যাতন ঘটে থাকে এদেশে। যেমন গৃহকর্তা বা সংশ্লিষ্ট অন্য কারো দ্বারা কাজের মেয়ে ধর্ষণ, হত্যা, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দান, বিয়ের প্রলোভন দিয়ে গর্ভবর্তী করণ ও পিতৃ পরিচয়দানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, জোরপূর্বক গর্ভনষ্ট বা মাতৃত্ব নষ্টকরণ, প্রেমের ফাঁদে ফেলে সতীত্ব হরণ, কিংবা পতিতালয়ে বিক্রিকরণ বা পাচার, আর শিক্ষিত নারীদের কলগার্ল হিসেবে নিযুক্তকরণ, পরকিয়া সম্পর্কের কারণে স্ত্রীকে তালাকদান ইত্যাদি আজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক পরিবারে নারীর মানসিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক পরিবারে নারীর মানসিক ও অর্থনৈতিকসহ হরেকরকম কদর্য নির্যাতনের ঘটনা পর্দার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আসলে বর্তমান সমাজে নারীরা সাধারনত জন্মের পরই বিশেষত সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও বহু ভয়াবহ নারীনির্যাতন ঘটে থাকে, যা কদাচিৎ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়ে থাকে। রীমা হত্যা, বুশরা হত্যার মতো অসংখ্য ঘটনার কথাতো এখনো কারো ভুলে যাবার কথা নয়। নারীরা আজ পুরুষ কর্তৃক যেমন নির্যাতিত হচ্ছে তেমনি নারী কর্তৃকও নির্যাতিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে । শাশুড়ী, ননদ, জা কর্তৃক নারীনির্যাতনের পাশাপাশি পুত্রবধুর হাতে শ্বশুর-শাশুড়ী বা দেবর-ননদের নির্যাতনের কাহিনীও কিন্তু কমনেই এদেশে। অন্যদিকে গৃহকত্রী কর্তৃক কাজের মেয়ে নির্যাতন, হত্যা, সংঘবদ্ধ নারীচক্র কর্তৃক শিশু ও নারীপাচার, ধর্ষণসহ অভিজাত দেহব্যবসায়ের কাজে নারীর পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সহায়তাদানের নজিরও কম নয়। মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এ অমানবিক ব্যাধি নির্মূলে যথাযথ আইনের শাসন ছাড়াও সামাজিক গণসচেতনতা সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। তেমনি ইসলামধর্মে নারীর উচ্চ মর্যাদাদানের বিষয়টিও আজ সামনে আনতে হবে। কেননা ইসলামে বলা হয়েছে, কোন স্বামীর তার স্ত্রীকে ঘৃণা করা উচিত নয়। তার একটা অভ্যাস যদি স্বামীর ভালো না লাগে, তবে আরেকটা অভ্যাস ভালো লাগবে (মুসলিম শরিফ) । আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, আমার স্ত্রীদের কাছে অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের মারপিটের অভিযোগ নিয়ে আসছে। মারপিটকারী স্বামীরা উত্তম মানুষ নয় (আবু দাউদ)। নারী নির্যাতনরোধে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার এবং প্রসারও ঘটাতে হবে ব্যাপকভাবে। ধর্মীয়চেতনার সমন্বয়ে সামাজিক গণজাগরণ সৃষ্টি তাই আজ সময়ের দাবি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের মতো এবারও ৮ মার্চে পালিত হয়েছে '' আন্তর্জাতিক নারী দিবস'' তাই আমাদের শ্লোগান হোক '' নারী ও মেয়েশিশুর নির্যাতনকারীদের ক্ষমা নেই'' সুতরাং এখন সময় এসেছে নারী ও শিশু নির্যাতনকারী পশুদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বয়কটের এবং কঠোর শাস্তিবিধানের।