জাতীয় স্মৃতিসৌধের অমর শিল্পী, তুমি রবে জাতির হৃদয়ে

শহীদুল্লাহ শরীফ
Published : 11 Nov 2014, 12:38 PM
Updated : 11 Nov 2014, 12:38 PM

সৈয়দ মাইনুল হোসেন, স্মৃতিসৌধের অমর  স্থাপত্যশিল্পী, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতার স্মারক যে সৌধটি মাথা উঁচু করে আছে সাভারে, সেই জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি তিনি।

আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধটির কাছে গিয়ে নানান দূরত্ব থেকে, বিভিন্ন কোণ থেকে আমরা গিয়ে দেখি আর মুগ্ধ বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যাই। কেমন যেন অনুভূতি হয়; তা বিশালতার, জাতীয়তার, গর্বের, ভালোলাগার … । নানামাত্রিক অনুভূতি সঞ্চারিত হয়ে যায় দেহ-মনে ব্যাপে। এমন অমর স্থাপত্য শিল্পের শিল্পী হলেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। মহান এই স্থাপত্যশিল্পী চলে গেলন নীরবে নিভৃতে। প্রথমে তাঁকে জানাই হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ও তার বিদেহী আত্মার শান্তি।

আমরা জানি, জাতীয় স্মৃতিসৌধ সাতটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভের সমন্বয়ে নির্মিত। এটি ১৫০ ফটু উঁচু। এই সাতটি স্তম্ভ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সাতটি পর্যায়ের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত। পর্যায়গুলো হলো ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬-এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। সুতরাং শুধু তাঁর অমর সৃষ্টি জাতীয় স্মৃতিসৌধ শুধু "শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে জন্মভূমি"ই নয়; আমাদের জাতীয় ইতিহাস এর সঙ্গেও রয়েছে এর চিরবন্ধন। তাই তিনি, আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। 

এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিসৌধ স্তম্ভের আকার সম্পর্কে শিল্পী সৈয়দ মাইনুল হোসেন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, 'চারদিকে প্রচণ্ড চাপ। সেই চাপে কিছু একটা উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে।' জাতীয় স্মৃতিসৌধে সাতটা খাঁজের মানে সম্পর্কে বলেছিলেন, 'বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত সাতটা বড় আন্দোলন হয়েছিল। সবচেয়ে নিচের খাঁজটা বায়ান্ন, সবচেয়ে উঁচুটা একাত্তর…।' তাঁর সাক্ষাৎকারে শোনা কথাটা বারবার আজ কানে বাজছে। 'চারদিকে প্রচণ্ড চাপ। সেইচাপে কিছু একটা উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে।" সে-রকমই শিল্পী সৈয়দ মাইনুল হোসেন জীবনের চাপ সইতে না পেরে অভিমানে নীরবে নিভৃতে জীবন থেকে ছুটি পেয়ে চলে গেলেন, না-ফেরার দেশে। কিন্তু তাঁর কীর্তি, এই যে বিশাল মহিমান্বিত শিল্প তা থাকলো চির অমর হয়ে।

আরও থাকার মতো কিছু স্থাপত্য-শিল্প-কীর্তি তিনি রেখে গেছেন; যার মধ্যে কারওয়ান বাজারের আইআরডিপিভবন, ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বারকা উন্সিল ভবন, চট্টগ্রাম ইপিজেড, বাংলাদেশ চামড়াজাত প্রযুক্তির কর্মশালা ভবন, উত্তরা মডেল টাউন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্যগুদামের নকশা, কফিল উদ্দিন প্লাজা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ভবন ইত্যাদি। এর বাইরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের নকশা ও করেছেন তিনি।

স্থপতি মাইনুল হোসেনের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৭ মার্চ, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে। তাঁর বাবা সৈয়দ মুজিবুল হক যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। দাদা সৈয়দ এমদাদ আলী ও নানা গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি। তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি নেন। মৃত্যূকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৩ বছর। তিনি দুই মেয়ে, মা ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

জাতীয়স্মৃতিসৌধ ও উপরে উল্লিখিত অনেক অমর শিল্প-কীর্তির মধ্যে আমরা তাঁকে খুঁজে ফিরব। জাতি তাকে ভুলবে না। এরকম শিল্পীরা নীরবে নিভৃতে চলে যান ঠিকই জাতির মন থেকে, শিল্পের ইতিহাস থেকে তাঁদের মৃত্যু নেই। তবে তাঁর এমন প্রস্থানআমাদের কাছে খুবই বেদনাদায়ক!

যাই হোক, যতদিন বাংলার বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস (১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ) পালন করবে ততদিন স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন এর কথা দেশবাসী স্মরণ করবে… তিনি সবার হৃদয়ের থাকবেন অনন্ত কাল ধরে ।

কিছুটা মনোবেদনা:

বিবিসি বাংলা রেডিওতে সংবাদ শুনে ওনলাইন পত্রিকাগুলোতে নিউজটি ভালোভাবে জানার জন্য চেষ্টা করলাম। দেশের কয়েকটি কথিত প্রধান পত্রিকায় নিউজটি না দেখে আমি মিনে বেদনা অনুভব করেছি। শেষে একটি স্বল্প দামে বিক্রি হওয়া পত্রিকায় দেখি ওরা নিউজটি করেছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাঈনুল হোসেনের প্রতি পত্রিকা-বেনেদের এমন আচরণ কি স্বাভাবিক। তবে, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নিউজটি কভার করেছে।

সম্পূরক খবর:

আজ ১২ নভেম্বর, ২০১৪, বুধবার সকাল সোয়া১১টায় মরহুমের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়।কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাঈনুল হোসেনের প্রতি শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

এর আগে বুধবার সকালসাড়ে ১০টায় মরহুমের লাশ বহনকারী গাড়ি বুয়েটের আর্কিটেক্ট ডিপার্টমেন্টের সামনে রাখা হয়। এখানে শিক্ষার্থী ও সহকর্মীরা তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পরিবারসূত্রে জানা যায়, মাঈনুল হোসেনের বোন ও মেয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁরা বৃহস্পতিবার দেশে ফিরলে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর দাফন হবে।

কৃতজ্ঞতা: প্রথম ছবিটি জাহিদুল করিম-এর তোলা, শহীদমিনারে ফুল দেওয়ার ছবিটি bdnews24.com থেকে নেওয়া, বাকিগুলো  গুগল থেকে সংগৃহীত।