দেশের নারীমুক্তি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা কবি সুফিয়া চেয়েছিলেন একটি সুস্থ সমাজ। যে সমাজে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ থাকবে না। তারা এক সাথে এগিয়ে যাবে। পিছিয়ে থাকা নারীদের ভাই-বোন-মা-খালা-ফুফু-চাচী-সহকর্মী তথা নানান পরিচয়ে সহযোগী হিসেবে পুরুষরা এগিয়ে নেবে। কেউ কারো গলগ্রহ নয় সহযোগী হিসেবেই সমাজে একসাথে ও পাশাপাশি বাস করবে, েভেদাভেদহীন। তিনি বলতেন, নারীর অধিকার অর্জনে পুরুষের সহযোগিতা প্রয়োজন আছে। যা একটি সুস্থ সমাজের বৈশিষ্ট্য। সেই আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামালের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের খবরটি পড়ছিলাম গত ২০ নভেম্বর একটি পত্রিকায় (প্রআ)। পাশেই একটি নারী হত্যার ফলোআপ প্রতিবেদন। পত্রিকার অন্যান্য কলাম ও পাতার খবরে চোখ বুলালে আরও কত নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক দেখতে পাব কে জানে। আমার ধারণা, যদি পত্রিকার অন্যান্য কলাম ও পাতার খবর দেখি, পর্যালোচনা করি, সেখানেও অনেক খবরই দেখতে পাব নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক। পত্রিকাজুড়ে নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা, এমনকি স্বামী হত্যা ইত্যাদি আমাদের সমাজদেহে অসুস্থতারই চিত্র।
সুফিয়া কামালের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই পর্যবেক্ষণই ফুটে উঠেছে নারী-আন্দোলনের নেত্রী ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানমের কথায়, "দেশে অনেক সংগঠন নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তারপরও বর্তমান সময়ে নারী নির্যাতনের সংখ্যা এবং মাত্রা দুটোই বেড়েছে।"
তাঁর পর্যবেক্ষণ, "সমাজে নারী নির্যাতনের সংখ্যা এবং মাত্রা দুটোই বেড়ে যাওয়া", এর কারণ কী?
সমাজে নারী নির্যাতনের সংখ্যা ও মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ শনাক্ত করে তার সমাধানে কাজ করা প্রয়োজন।
সুফিয়া কামালের কাছে এই অসুস্থ সমাজ-পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসাই ছিল নারীমুক্তির অন্যতম প্রধান উপায়। তাই তিনি তাঁর নারীমুক্তি সংগ্রামে সুস্থ সমাজ গড়ার গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি, যা গঠন করতে হবে নারী-পুরুষ এক সাথে, এটাই ছিল তাঁর আদর্শ, একটা সংশ্লেষণাত্মক সমাজের আদর্শ। এজন্যই এবারের বেগম সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণসভার প্রতিপাদ্য শ্লোগান : নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূলে পুরুষ ও তরুণ সমাজের চাই সক্রিয় ও জোরদার ভূমিকা", যথার্থ ও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সুফিয়া কামাল, আমার জানা ও অধ্যয়ন মতে, সংগ্রামের পথে পথে ধাপে ধাপে এ পর্যায়ে বুঝেছিলেন যে সমাজে নারীর সম অধিকার নিশ্চত করার ক্ষেত্রে নারীর পাশাপাশি পুরুষদের সক্রিয় ও জোরদার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই তাঁর নারীমুক্তি আন্দোলনের আদর্শ অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র্য।
সুফিয়া কামাল নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এই আদর্শকে তাঁর অনুসারীদের বুঝাতেও সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তার মৃত্যুর পনের বছর পরেও তাঁর অনুসারীরা সে আদর্শ অনুসারে কাজ করছে।
আমাদের দেশের নারীর উপর এখনও অনেক সহিংসতা আছে, নারীর উন্নয়নে অনেক বাধা আছে কিন্তু এর মধ্যেও নারীর উন্নয়নের ধারা বেগবান থেকে বেগবানতর হচ্ছে। নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষায়, উন্নয়নের প্রায় সব সেক্টরে, যা বিচ্ছিন্নভাবে নয় পুরুষের সাথে সুস্থ প্রতিযোগিতায়, সহযোগী পেশাশীবী হিসেবে।
বেগম সুফিয়া কামালের যোগ্য উত্তরসুরী জনাব আয়শা খানম তাই সুফিয়া কামালের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন সভায় সবার প্রতি আহ্বান করেছেন, "দেশের নারীমুক্তি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা কবি সুফিয়া কামালের সংগ্রামী আদর্শ প্রতিদিনের জীবনে ধারণ করতে হবে। তাহলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করে সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।"
সুফিয়া কামালকে নিবেদিত কবির সুমনের গানটির কথা ও সুর আমাকে এই মহীয়সীর সম্মানে একটি অপূর্ব সৃষ্টি। আমি সুফিয়া কামালের প্রতি শ্রদ্ধায় আনত চিত্তে গানটি শুনেছি কয়েকবার। আপনিও ইচ্ছে শুনতে পারেন। গানের কথাগুলো আপনাদের উদ্দেশে তুলে দেওয়া হল:
ঐ তো লক্ষ্ ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি দামাল
সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে সুফিয়া কামাল।।
একেকটা দেশ থাকে মানচিত্রেই শুধু রাখা
কারো নয়নে থাকে স্বদেশের ছবিখানি আঁকা।
আমি সেইস্বদেশের ছবি দেখি আপনার মুখে
সুফিয়া কামাল মানে বাংলাদেশের ছোঁয়া বুকে।।
ঐতো…
মাটিতে পায়ের কাছে বসেছি ধুলোর মতো আমি
পৃথিবীকে চুমো খায় গানে গানে আমার বোকামী।
বোকারাই গান লেখে গান বাঁধে গান লেখে মরে
এবার মরলে আমি জন্মাবো আপনার ঘরে।।
ঐতো…
আপনার ঘর মানে ঘর আর বাইরের মিল
ভাষার থালায় ভাত খেতে বসে অপার নিখিল।
তারা ভাত কেড়ে নেয় সাবধান সামাল সামাল
ভাত মানে ভাষা ও খালাম্মা সুফিয়া কামাল।।
ঐতো…