মনোয়ারা ক্লার্কসহ দেশমাতার সন্তান যুদ্ধশিশুদের প্রতি আমাদের দায়

শহীদুল্লাহ শরীফ
Published : 9 Dec 2014, 09:03 AM
Updated : 9 Dec 2014, 09:03 AM

একজন যুদ্ধশিশু বাংলাদেশের সমান বয়সী পিতৃমাতৃ তথা আত্মপরিচয়হীনা দুঃখিনী মনোয়ারা ক্লার্ক। এখন তার পরিচয় দেশমাতা-বাংলাদেশের সন্তান হিসেবে। সেই দেশমাতার সন্তান মনোয়ারা ক্লার্ক এর কন্ঠে যখন শুনি, "মাই হোল লাইফ ইজ ফুল নেগলিজেন্সিস, আপস অ্যান্ড ডাউন, ব্রোকেন রিলেশনশিপ, অল দিজ মেইড মি সো স্যাড। সো স্যাড। আই জাস্ট ওয়ান্ট মাই বার্থ সার্টিফিকেট। আই ওয়ান্ট টু লিভ মাই লাইফ অ্যাজ বাংলাদেশি।" মনটা বেদনায় ও সমবেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

দেশমাতার সন্তানদের (যুদ্ধশিশু) অন্যতম মনোয়ারা ক্লার্ক। তাঁর উপর লেখা জন্মদাগ একাত্তরের সনদ, শামীমা বিনতে রহমান এর প্রতিবেদনটি আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। যে কারো মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলবে। প্রতিবেদনের সঙ্গে দেওয়া ছবিতে ওকে দেখে মনে হয়েছে, ও আমার কোনো বোন, আত্মীয় পরিজন। কিন্তু আসলে বাস্তবে তা নয় ও (মনোয়ারা) একজন দুঃখী-নিঃসঙ্গ-অসহায়-আত্মীয়-পরিজনহীন মানুষ।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে মনোয়ারার আত্মপরিচয় নিঃশেষ হয়ে গেছে। জানা যায়, তাঁর মা একাত্তরে অপমানিত (ধর্ষিত) ও বেয়নেটের আঘাতে নিহত হয়েছেন। তাই জন্মসনদটিও তাঁর নেই। এখন হবে বলে জেনেছি। তাঁকে দত্তক নেওয়া মাবাবাও সে-ভাবে নেই। তাঁর স্বামী-সংসারটিও নেই। তাও হারিয়ে গেছে সেই আত্মপরিচয়হীনতার ছুতোয়। আছে শুধু একটা অটিস্টিক বেবি, জুলিয়া। আর সদ্য কুড়িয়ে নেওয়া বাংলাদেশের নিদর্শন একটি পথের কুকুর। মনোয়ারার কান্না শোনাবারও তাই বোধ করি কেউ নেই। এই মানুষটি যে আমার দেশের জন্মসূত্রে একজন নাগরিক, সে-সুত্রে আমার, আপনার বাংলাদেশের সবার স্বজন আপনজন। সেই তাকে দেখে মনে হয় একজন দুঃখী-নিঃসঙ্গ-অসহায়-আত্মীয়-পরিজনহীন মানুষ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পিতৃমাতৃ তথা আত্মপরিচয়হীন যুদ্ধশিশুদের পরিচয়, তারা দেশমাতা-বাংলার সন্তান। এসব দেশমাতা-বাংলার সন্তানরা কে কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আমরা তার খবর রাখি না। এ কেমন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, আর আমরা কেমন বাংলাদেশের নাগরিকবৃন্দ। যাদের রক্তের বিনিময়ে মুক্ত স্বদেশ, যাদের স্মরণ করি গানে, "এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভূলব না।" তাদের নাড়িছেঁড়া-ধন সন্তানেরা সেই স্বাধীন দেশে আত্মপরিচয়হীন/ আত্মপরিচয়হীনা। তাদের জন্মগত সনদ বা নাগরিক সনদপত্র নেই সেই দেশের, যে দেশের তাদের মা-বাবা রক্ত দিয়েছেন।তাদের মাবাবার নাম নেই ইতিহাসের পাতা, হয়ত বা ইতিহোসে তোমাদের নাম লেখা রবে না। সত্যিই তো, এসব শহীদ, নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালি নর-নারীর নাম ইতিহাসে নেই, জ্ঞানী আন গুনীদের আসরেও নেই তাদের নাম লেখা, এমনকি তাদের সন্তানদেরও নেই আত্মপরিচয়, দেশের পরিচয়পত্র, কী হতভাগা জাতি আমরা।

আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক, স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছি। আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি করবো আর মনোয়ারাসহ যুদ্ধশিশুরা দুঃখী-নিঃসঙ্গ-অসহায়-আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায় থাকবে, এটা মানবতার যেমন অপমান তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও অপমান, নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্যও অপমানের। আমরা এই অপমান ও দায়ভার  আর কত দিন বয়ে বেড়াবো? কেন এ অকৃতজ্ঞের অপমান বয়ে বেড়াবো? মনোয়ারা এবং তাঁর মতো সবহারা দেশমাতা, বাংলা মায়ের সন্তান বা যুদ্ধশিশুদের প্রতি আমাদের কি কোনো দায় নেই? এ দায় আমরা এড়াতে পারি না।

মনোয়ারাসহ দেশমাতার সন্তান-যুদ্ধশিশুদের কথা, চাপা কান্না আমাদের শোনা উচিত । ওরা কীভাবে দুঃখী-নিঃসঙ্গ-অসহায়-আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থা থেকে একটু খানি পরিবর্তন পেয়ে সুখী-সমাজসঙ্গ-সহায়তাপূর্ণ মানুষ হতে পারে সেটা তো আমাদের ভাবা উচিত। এ-ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে সরকারি বেসরকারি সংস্থা কাজ করে তাদের আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। ১. প্রথমেই এসব যুদ্ধশিশুদের তালিকা করা দরকার। ২. তারপর তাঁদেরকে কীভাবে পরিচিতি, সম্মান, স্বীকৃতি ও সহায়তা দিয়ে সুখী-সমাজসঙ্গ-সহায়তাপূর্ণ মানুষ হিসেবে দাঁড় করানো যায় তার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।

……………………………………………………….

কৃতজ্ঞতা: ছবিগুলো হুমায়ুন কবির ঢালী ও সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালে'র সৌজন্যে প্রাপ্ত।