পদ্মা সেতু এবং দেশপ্রেমিক সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন

মোহাম্মদ শাহ জালাল সরকার
Published : 27 July 2012, 06:07 AM
Updated : 27 July 2012, 06:07 AM

বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে যতটুকু জানা যায়, ব্যপক ভিত্তিতে এবং অনেক সময় নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকারকে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মানের পরামর্শ প্রদান করে "জাইকা" নামক একটি জাপানী সংস্থা। এর পর অনেক চড়াই উৎরাই পার করে অবশেষে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ সেতুর জন্য দশ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়।

২০০৯ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহনের পর পর-ই পদ্মা সেতু প্রকল্প অতি দ্রুততার সাথে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একেকটি পর্যায় হিসাবে ৯ জানুয়ারী সেতুটির বিস্তারিত নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রস্তাব সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কর্তৃক অনুমোদন; একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি সেতুটির নকশা প্রণয়ন কাজ শুরু; ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান; ১১ অক্টোবর (বিশ্বব্যাংকের আপত্তির প্রেক্ষিতে) আবারও একই বিষয়ে দরপত্র আহ্বান; ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারিতে পদ্মা সেতুর সংশোধিত প্রকল্প মন্ত্রিসভায় অনুমোদন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারী বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের (অতি সহজ সুদে) ঋণ সহায়তা প্রস্তাব অনুমোদনের পর ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক, ১৮ মে জাইকা, ২৪ মে আইডিবি এবং ৬ জুনে এডিবির (সবগুলো ঋন চুক্তিই স্বাক্ষর হয় ২০১১ সালে) সঙ্গে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি কার্যাবলী অত্যন্ত সফলভাবেই সম্পন্ন করেছিল।

ভোটের রাজনীতিতে এবং দিন বদলের সনদে উল্লেখিত অঙ্গীকার গুলোর মধ্যে এ সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি ছিল অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ । আর তাই, এ সেতু প্রকল্পের কাজ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য মহাজোট সরকার অনেকটা উঠে পড়েই লেগেছিল। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতাকালে মহাজোট নের্তৃবৃন্দ জনগনকে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ব্যাপারে আশাম্বিতও করেছিল। কিন্তু ইহা বাস্তবায়নে প্রথম বাধ সাধে ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১ যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সততা নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির তারবার্তা, যা বহুল আলোচিত ওয়েবসাইট উইকিলিকস কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এর পর ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিশ্বব্যাংক কর্তৃক মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে দুর্নীতি অভিযোগ এনে অর্থমন্ত্রী বরাবরে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। প্রতিবেদনে প্রকাশিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৯ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালককে অপসারণ; ১৩ অক্টোবরে সেতু বিভাগের সচিবকে অন্যত্র বদলি; ১৮ অক্টোবর দুদক কর্তৃক অনুসন্ধান দল গঠন; অত:পর দুদক কর্তৃক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কোন দুর্নীতি করেননি মর্মে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পর পরই ঘটে যায় কয়েকটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা। দুদক থেকে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কর্তৃক দূর্নীতি মুক্ত মন্ত্রী হিসাবে সনদ পাওয়ার দিন অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর-ই বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের ঋণ সহায়তা স্থগিত ঘোষনা করা হয়। আলোচনার ঝড় ওঠে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিভিন্ন মহল থেকে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের দাবি ওঠে। এ দাবি দিন দিন আরও জোড়ালো হতে থাকে। এ গনদাবির এক পর্যায়ে ৫ জানুয়ারি ২০১২ যোগাযোগমন্ত্রী (বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহনের ঠিক তিন বছর পর) সৈয়দ আবুল হোসেনকে অন্যত্র (একটি ছোট মন্ত্রণালয় ভাগ করে, তার এক অংশে) সরিয়ে দিয়ে নতুনভাবে মন্ত্রিত্বে নিয়োজিত করা হয়।

সরকার যেন কোন কারনে তার কাছে দায় বদ্ধ অথবা তাকে মন্ত্রিত্ব না দিলে সরকার চলবে না- দেশের সচেতন মহলের কাছে এমনটি মনে হওয়া অমূলক নয় । আর সেই দায়বদ্ধতা থেকেই হয়তবা মন্ত্রনালয় ভাগ করে হলেও বর্তমান সরকার কর্তৃক মন্ত্রী তাকে করতে-ই হল । শুধু এখানেই শেষ নয়, দুদকের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সরকার দলীয় রাজনীতিকগন তার পক্ষে এবং তার সততার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অথচ রাস্তা ঘাটের বেহাল দশার কারনে আরেকবারও তার পদত্যাগের দাবি ওঠেছিল। এত কিছুর পরও মন্ত্রী তাকে রাখতেই হবে। কোন এক অদৃশ্য দায়বদ্ধতার দ্বারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিচার বিবেচনার শক্তি যে হারিয়ে গেছে! আর তাই দেশের স্বার্থকে তুচ্ছ বলেই মনে হয়েছিল তার কাছে।

জনগনেরতো সমালোচনা ছাড়া কিছু করার নেই। সমালোচনা আবার একটু অতিমাত্রায় হয়ে গেলে মামলার হাজিরা দিতে দিতে নি:স্ব হয়ে যাওয়া ছড়া কোন পথ খোলা থাকবে না। জনগন যে গোপন ব্যালটে গোটা জাতিকে বিশ্বের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার সঠিক জবাব দেবে, সে জবাবের পথকেও রুদ্ধ করা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। তবে চিরকাল যে ক্ষমতায় থাকা যাবে না, সে বিষয়টি অন্তত ভুলার কথা নয়। অত্যন্ত দু:খজনক হলেও সত্য যে, শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কর্তৃক দুদক থেকে গৃহীত দূর্নীতি মুক্ততার সনদটিও কোন কাজে আসলো না। দূর্নীতির অপবাদে পুরো জাতিকে কলঙ্কিত করে ৩০ জুন, ২০১২ পদ্মা সেতুর নির্মাণবিষয়ক এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ ঋণ চুক্তি বাতিল ঘোষনা করল বিশ্বব্যাংক।

পুরো জাতি লজ্জিত হলেও লজ্জিত হল না মহাজোট সরকার। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক গত ২ জুলাই, ২০১২ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বিবৃতিতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন ৬ টি প্রকল্পসহ মোট ৭ টি প্রকল্পের দূর্নীতির কথা তুলে ধরাই এর উৎকৃষ্ট উদাহরন। কাটা গায়ে নুনের ছিটা। এক দূর্নীতির অপবাদ সহ্য করা যেখানে দায়, সেখানে বিএনপি'র আমলের দূর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ যে আসলেই একটি দূর্নীতি গ্রস্থ দেশ সেটাই সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়ার সফল চেষ্টা করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। এক দল কর্তৃক আরেক দলের উপর দায় চাপানোর অপ-প্রয়াস দেখলে মনে হয়, দায় চাপাতে পারা অত্যন্ত গর্বের বিষয় এবং সেটাতে কোন লজ্জা নেই। লজ্জা শুধু নিজের ঘাড়ে পড়লে। দূর্নীতির অভিযোগে যেখানে গোটা জাতি অপমানিত, সেখানে অর্থমন্ত্রী আরও কিছু দূর্নীতির তথ্য দিয়ে গোটা জাতিকে কলঙ্কিত করলেন। নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য বীরের বেশে কেউ কেউ আবার বিশ্বব্যাংকের দূর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী নিজেও পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, তাদের (বিশ্বব্যাংক) ভেতরে যে দুর্নীতি আছে সে খবর কে নেবে? এ প্রসঙ্গে তিনি বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা ব্যবসা বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের অনিয়ম সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিকেও টেনে আনার চেষ্ঠা করেছেন।

গত ১৬ জুলাই গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের উদ্বোধনী বক্তব্যে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ঋন চুক্তি বাতিলের কারন হিসাবে প্রধানমন্ত্রী একটি নতুন তথ্য সংযোজন করে বলেন "কোন এক ব্যক্তি বিশেষের একটি ব্যাংকের এমডি পদ নিয়ে বিশ্বব্যাংক ঋণ বন্ধ করে দেবে, এ কথা অনেকে বলেছেন, আমি আগে থেকেই শুনে আসছিলাম।" একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের কথা শুনলে জনমনে এ প্রশ্ন জাগাটা স্বভাবিক যে, একজন ব্যাক্তির ক্ষমতার ব্যপ্তি এত ব্যপক জানা সত্ত্বে মহাজোট সরকার দেশের উন্নয়নের স্বার্থে তাকে কাজে লাগালেন না কেন এবং তার এমডি পদ নিয়ে এত টানা হেছড়ার কি প্রয়োজন ছিল? মহাজোট সরকার যেখানে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে এত উদার, সেখানে কোন বিশেষ আইন করেও কি তাকে এমডি পদে বহাল রাখতে পারলেন না? সংসদে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা দিয়েছেন, যে করেই হোক পদ্মা সেতু তারা নির্মাণ করবেই।

সংসদের স্পিকার ব্যক্তিগত ভাবে মত প্রকাশ করে বলেছেন, মোবাইল ফোনের কল থেকে ২৫ পয়সা হারে কাটার জন্য এবং সংসদের সকল সদস্য ১ মাসের বেতন- ভাতা দেওয়ারও ঘোষণা করেছেন তিনি। গত ১৬ জুলাই মন্ত্রী সভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মানের অর্থ সংগ্রহের জন্য দুটি ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত ইতি মধ্যেই নিয়ে নিয়েছেন। কিছু অতি উৎসাহী লোক এ সেতু নির্মানের জন্য অর্থ সংগ্রহও শুরু করে দিয়েছেন। এ নিয়ে দ্বন্ধের জের ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রলীগ কর্মী খুন হয়েছেন। এদিকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে এবং অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহল অভিমত ব্যাক্ত করছেন এবং সরকারের এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অর্থনৈতিক দিকগুলো আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করারও পরামর্শ দিয়েছেন। সে দিকে কেউ কর্নপাত করছেন না।

অতি উৎসাহী কিছু মহল তাদের বেতন থেকেও অর্থ যোগান দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। অর্থের যোগান দেশের যেখান থেকেই করা হোক, তাতে যে তারল্য সংকট বাড়বে এবং অর্থনীতিতে চাপ পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমনিতেই তারল্য সংকটের কারনে দেশেরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম, ব্যবসা বানিজ্যে মন্দা, দিন বদলের সনদ অনুযায়ী মহাজোট সরকার কর্র্তক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কথা থাকলেও দিন দিন সুযোগ কমে দিন বদলে গেছে সাধারন মানুষের, এমন একটি মূহুর্তে হুট করে এ ধরনের সিদ্ধান্তে যৌক্তিকতা নিয়ে নীতি নির্ধারকগন ভাবছেন না।

অবশেষে বোধদয় হয়েছেই বলে মনে হয়। মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। আশার বানীও শোনা যাচ্ছে যে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। সকল খারাপ সংবাদের মাঝে এটি অত্যন্ত ভালো সংবাদ বলেই মনে করি। যদি শেষ পর্যন্ত তাই হয়, তবে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এত কথার কি প্রয়োজন ছিল?