আহমদ ছফা ও ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু কথা….

শাহমুন নাকীব ফারাবী
Published : 11 Jan 2016, 08:09 PM
Updated : 11 Jan 2016, 08:09 PM

আমাদের পাশ্ববর্তি উপজেলার এক বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তাদের পরিবারে মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যে উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে। ছোট বেলা থেকেই তাকে দেখেছি অমায়িক এবং ভদ্র হিসেবে। পড়ালেখার ক্ষতি হবে বলে তিনি তেমন একটা খেলাধুলাও করতেন না। বলতে গেলে খেলতে পারতেন না।তার মুখে সিগারেট সে তো অলীক কল্পনা! কিন্তু কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে দেখা করে পুরো চিত্রটাকে ভিন্ন দেখলাম! তিনি এখন একটি রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতি অঙ্গনের সভাপতি। আমার সামনেই পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট ধরাচ্ছেন! উনি বললনে, কিরে অবাক হচ্ছিস! অবাক হবার কিছু নাইরে ভাই! পলিটিক্স করতে গেলে অনেক টেনশন তাই একটু আধটুকু খাই! কিন্তু সিগারেটের মাঝেই সে সীমাবদ্ধ নেই। তার বিচরন এখন গাজা, ফেন্সিডিল আর ইয়াবার মাঝে।

বিশ্ববিদ্যিালয়ের এই অবস্থাটা সেইকাল থেকেই চলে আসছে। আর এর বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং প্রতিবাদ করতেদ গিয়ে আহম ছফা "ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত বিশ্ববিদ্যালয়" শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন। সেই কলামের অংশ বিশেষ তুলে ধরছিঃ

বিশ্ববিদ্যালয় এখন মুমূর্ষ রুগ্ন। তার অল ধবল শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শোণিত স্রোত। তার প্রাণের প্রবাহ পথ রুদ্ধ করে, ইট কাঠ পাথরের প্রকান্ড ভূতুড়ে চেহারা প্রকটিত করে রাক্ষসী ডাইনীর চেহারায় তাকে পরিচিত করে তোলার জন্য চেষ্ঠার অন্ত নেই। এই রকম নিষ্ফলা বন্ধ্যা সময়েও আমি বিশ্বাস করি,ভুখন্ডের জনগোষ্ঠির প্রতি বিদ্যুতের অক্ষরে অমোঘ নির্দেশ জারি করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তেজিত হও,জাগ্রত হও,জ্ঞানের আলোকে জাগো,মানবতার আবেগে জাগো,প্রতিরোধের দুর্দম ষ্পৃহা বুকে নিয়ে নতুন পৃথিবী নির্মাণ করার প্রতিজ্ঞায় জাগো।

আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা অলংঘনীয়তার প্রয়োজনের কথা বলে বিশেষ লাভ হবে না। তারা সমঋদ্ধ দেশ চা না, ক্ষমতা চান। সুগঠিত জাতি এবং সমন্নিত সংস্কৃতি চান না, শুধু শাসক হওয়ার, ধার্মিক হওয়ার অধিকার অর্জন করতে চান। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ওপর উপুর্যপরি বলাৎকার চালানো এই মহাপুরুষ এবং মহিয়সী নারীদের মুখ্য রাজনৈতিক কর্মকান্ড হয়ে দাড়িয়েছে। তারা কি চান সেটা নিশ্চিতভাবে জানেন। এই দেশে সবধরনের পন্য বিদেশ থেকে আসে। শিক্ষাও একটি বিপনণ যোগ্য পণ্য। তাও আসুক বিদেশ থেকে। ক্ষতি কোথায়? শিক্ষিত মানুষ প্রয়োজন, তাও বা এমন কি ভাবনার বিষয়। এই হাতের তালুকের দখলে রাখার জন্য কতোজনই বা শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন। বাইরে থেকে সে পরিমান মানুষ আমদানি করতে কোন অসুবিধা নেই। তাদের ছেলে মেয়েরা ইংল্যান্ড, আমেরিকা,অষ্ট্রেলিয়া, রাশিয়া,ভারত এ- সকল দেশে চলে গেছে। সেখানে উত্তাপিত বেষ্টনির মধ্যে তাদের পুত্র কন্যারা অখন্ড মনোযোগ সহকারে রেখাপড়া করছে।

না না ওসব এলাকায় তোমাদের যেতে চেষ্টা করা একেবারেই ‍উচিত নয়। তোমরা কোমলমতি যুবক, দেখো রাজপথগুলো কতো সোজা, কতো দ্রুত গতিতে আসা যাওয়া করা যায়। চাক্কু রামদা হকিষ্টিক এগুলো ব্যবহার শিক্ষা করা কতো সহজ। তোমাদের পা গুলো দেখো কি রকম চঞ্জল গতিময়,হাতগুলো ক্ষিপ্র। আর দেখো এ এক চমৎকার খেলা, রিভলবারের ট্রিগারে একবার চাপ দাও দেখবে একটা সীসের গুলি বেরিয়ে আসছে। একটা গুলিই একটা আস্তো মানুষকে খুন করার জন্য যথেষ্ঠ। রাইফেল মেশিনগানের ব্যবহার যদি শিখতে পারো, আর তোমাদের পায় কে! এক্কেবারে গন্ডা গন্ডা মানুষ খতম করতে পারবে। মানুষ মারার নেশা ভারী চমৎকার নেশা। সুন্দরবনের বাঘকে মানুষ এতো ভয় এবং এতো শ্রদ্ধা করে কেন জানো? তার একটাই কারণ বাঘ খুন করতে জানে। আমরা তোমাদের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বানাবার সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিতে পারি। কি সুন্দর লোভনীয় জীবন তোমাদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে। হাতে কড়কড়ে টাকা সবসময় থাকবে। টাকা এমন বস্তু ও দিয়ে যা চাইবে কিনতে পারবে। চমৎকার গাড়ি,সুন্দরী নারী, দামি সুরা। এতে শেষ নয়। এক ডাকে দেশের মানুষ তোমাদের চিনবে। তোমাদের নাম ফেটে যাবে। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মন্ত্রী হতে পারবে।

এটা নিশ্চিত ধরে নিতে পারো একাত্তর সালে একজন পাঞ্জাবী মেজর জেনারেলের হাতে যে পরিমান ক্ষমতা ছিল তার জাইতে অনেক বেশি ক্ষমতার মালিক হবে তোমরা। ক্ষমতা এক আশচর্য জিনিশ। ক্ষমতার বলে বুদ্ধিমানকে দাস করা সম্ভব। থুত্থুরে বুড়ো হলেও ষোড়শী তন্বীর পাণিগ্রহণ করা যায় অনায়াসে। সেই ক্ষমতার মালিক মোখতার হতে যাচ্ছো। তোমাদের জীবন দর্শন হবে ক্ষমতার পূজো করা ক্ষমতাবান হতে চেষ্ঠা করা। বিশ্ববিদ্যালয় পঠন,পাঠনের নিরামিষ জীবন চার্চ,শুষ্ক বিদ্যার বিচালি চর্বণ পদ্ধতির সর্বাংশে বিরোধিতা করার নির্দেশ দেবো। তোমরা উন্মত্ত অট্টহাস্যে উন্মত্ত নিত্য করতে থাকো।

বিশ্ববিদ্যালয় সরকার এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার ধাক্কা সামলাবার বাফারষ্টেট নয়। তবে চলমান রাজনীতির প্রভাব যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না সেটা আশা করা যায় না। কিন্তু চলমান রাজনীতির ঘাত প্রতিঘাত সবটা একা যখন বিশ্ববিদ্যালয়কে বইতে হয়,তার পরিণতি কি হতে পারে আজকের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।

মাসে তিরিশ দিন দাঙ্গা-হাঙ্গামা অনুষ্ঠিত হয়,অনবরত বোমাবাজি চলছে,দেশের ক্রিমিন্যালরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস সমূহে ডেরা পেতেছে। পত্রিকার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের একাংশকেও এই ক্রিমন্যিালদের সঙ্গে হাত মেলাতে হচ্ছে। মোট কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তশানে যে পরিস্থিতিতে এসে দাড়িয়েছে তা দেখে জাতীয় জীবনে বিশ্বদ্যিালয়ের ভূমিকা কি সে প্রশ্নে একটা দুঃখজনক সিদ্ধান্তে না এসে উপায় থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় দেশ জাতির পক্ষে যা কিছু শুভ, কল্যাণপ্রদ,মঙ্গল দায়ক তার নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। জাতির আশা,আকাঙ্খা ধারন করেছে এবং মানসজীবনে গতিশীল করেছে, হালফিল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা পালন করার ক্ষমতা নেই।

এই অবস্থা কেন সৃষ্টি হলো, কারা গোটা পরিবেশটা বিষিয়ে তোলার জন্য দায়ী, এই ব্যপারটা যতোই ঠান্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্ঠা করেছি, ঘুরে ফিরে একটাই জবাব পেয়েছি, নিছক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যায়ের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আজ বিশ্ববিদ্যালয়টা গ্রাস করে ফেলেছ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক প্রশাসক যারাই থাকেন এই পশুশক্তির কাছ থেকে ছাত্রপত্র সংগ্রহ করে অবস্থান করতে হয়। উৎকর্ষ বিবর্জিত জাতীয় রাজনীতির প্রথম বলি আমাদের বিশ্ববিদ্যালেএবং সারাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। ছাত্রশক্তিকে ব্যবহার করে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, বিরোধী দলসমূহও একই ছাতশক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় চড়ে বসতে চায়।

স্বাভাবিক নিয়মে একটা সময়ে এই সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। কিন্তু তার পরে যে সরকার বসবে, সেই সরকারের পক্ষে শিক্ষাজীবন কে পূর্নগঠন করা কি সম্ভব হবে? ক্ষতি যা হওয়ার এরই মধ্যে ঘটে গেছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে গহব্বরে নেমে গেছে , আগামী পঞ্চাশ বছরেও সেই অতল-গভীর খাদ থেকে টেনে তোলা সম্ভব হবে কি?