আমি প্রতিদিন পাগল হই

শাহরিয়ান আহমেদ
Published : 2 May 2012, 05:25 AM
Updated : 2 May 2012, 05:25 AM

কখনও স্বপ্ন শেষ হতে চায় না। ডানা মেলতেই থাকে মেলতেই থাকে। কী মধুর সেই সময়। আর কখনও কখনও স্বপ্ন আছে বলেই বিশ্বাস হয় না। সময় কাটতে চায় না। প্রত্যেকটি সেকেন্ডকে মনে হয় একেকটি বছর। তখন দুঃস্বপ্ন কেবল রাতেই আসে না, প্রতিটি মুহূর্ত দুঃস্বপ্নের যন্ত্রনা বয়ে বেড়ায়। আহ! কী অমানুষিক।

দেশের বর্তমান অবস্থায় মানুষ বোধহয় আর সপ্ন দেখে না। অন্তত সাধারণ মানুষ তো নয়ই। কিভাবে দেখবে বলুন, স্বপ্ন দেখতে চাইলে তো কিছুটা সময় ঘুমের দরকার। হঠাত্‍ অসহ্য যন্ত্রনা, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে.। ছটফট করে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠি, রাতে বিদ্যুতের যন্ত্রনায় এই ঘটনা প্রায়ই ঘটে। হাত পাখাটা অবিরাম চলতে থাকে, তাতে খুব একটা লাভ হয় না বরং আরও ক্লান্ত হয়ে যাই। গরম, ঘাম ও ক্লান্তিতে আর সহ্য হতে চায় না। মশারির বাইরে বেরুতে পারি না মশার জ্বালায়। নিরুপায় হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি, বাতাসের ছিটে-ফোটাও নাই। জানালার করুণ হাসিটা যেন আমাকেই বেঙগ করে। একটার গায়ে আরেকটা লাগানো বিশাল বিশাল বিল্ডিংগুলো দাড়িয়ে আছে, বাতাস ঢুকার তিল পরিমাণ ফাঁকাও যেন ওরা বন্ধ করে দিতে চায়।

এভাবেই তো প্রতিদিন ভোর হয়। অফিস শুরু হবার অন্তত ঘণ্টা দুই আগেই বেরিয়ে পড়ি। দুই তিন কিলোমিটারের রাস্তাটা যেন টাইটানিকের সমুদ্র যাত্রা। সিএনজি অটোরিক্সায় চড়ার কথা তো স্বপ্নেও ভাবি না। উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়ার যে ভাড়া ওরা হাঁকায় তাতে চট্টগ্রাম না হলেও বাসে করে সিলেট যাওয়া যাবে। আর বাসের সিটে বসে যেতে পারা তো আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতই। ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে যেতে পারলে ছোটখাটো যুদ্ধ জয়ের আনন্দ লাগে। এরপর গাদা-গাদি, চাপা-চাপি, পায়ের পাতার উপর দলাই মালাই, ঘামের দুর্গন্ধ! রাস্তায় হাঁটার কোনও উপায় নাই। ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে, কিছুদূর পর পরই ডাস্টবিন, ছড়ানো ছিটানো ময়লা, দুর্গন্ধ, জমে থাকা ড্রেনের পানি, বিশাল বিশাল গর্ত, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি..! আর বৃষ্টি হলে … !

যাই হোক, শেষমেষ বাসের দরজায় ঠাঁই। দরজার হাতল ধরে কোনমতে অফিস পর্যন্ত যেতে পারাটাও কম কিসের! ঢুকতেই ইউপিএস এর পিপ পিপ শব্দে বুঝলাম বিদ্যুত্‍ নাই। আহ! কী শান্তি! অফিসে অনেক চাপ, কিসের চাপ জানেন? কাজ না থাকার চাপ। ব্যবসা নাই তো কাজ ও নাই। ব্যবসা কেন নাই তার উত্তরটা সরকারের কাছেই চাওয়া উচিত। মানুষের পকেটে টাকা না থাকলে কী কোনও ব্যবসা চলে? মাঝে মাঝে ভাবি চাকরিটা টিকবে তো? সারা দুনিয়ায় যেভাবে ছাটাই চলছে তাতে ভয় না করেই বা কী করব। বাংলাদেশেও তো ধাক্কাটা কম লাগেনি। অনেক বড় বড় কোম্পানী তাদের লোক ছাটাই করা শুরু করেছে। ভয়তো মনের ভেতর কাজ করেই, মাথার উপর কত কত দায়িত্ব ….

অফিস শেষ করে বের হতে ইচ্ছা করে না, আবার তো সেই জাম, সেই একই দুর্ভোগ. তাও তো যেতে হবে. বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায়, আমাদের সময়ের দাম কোথায়, দাম তো কেবল ভিআইপিদের সময়ের. মন্ত্রীদের, এমপিদের। আর কী করা, বসে থাকতে হবে ঘন্টার পর ঘণ্টা। প্রতিদিনই বাসে কন্ডাক্টর- যাত্রী ঝগড়া হয়, কারণ একটাই বাড়তি ভাড়া। পাঁচ পয়সা সিএনজি'র দাম বাড়লে ভাড়া বারে পাঁচ টাকা। ভাড়া শুধু বাসেরই বারে তা না, পরিবহন সেক্টরের প্রত্যেকটি যানবাহনের ভাড়া বারে। সাথে সাথে বারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। আলু, বেগুন, পটল কেনার আগে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে হয়। মাছের কথা নাহয় নাই বললাম, মাছ দোকানিদের গরম দেখলে মনে ওরা আমেরিকা থেকে মাছ কিনে আনছে বাংলাদেশে বিক্রি করতে। ইলিশ মাছ আর বড় চিংড়ি মাছগুলোর দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকি, ভাবতে ভাবতে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে, কত খেয়েছি এই মাছগুলো। আর এখন দামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনা। ইলিশ, চিংড়ি, আঈর, বোয়াল, বাইন, কাজলি, বাইলা আর বড় বড় দেশী সরপুটি মাছ আব্বার খুব পছন্দ ছিল, বাজার থেকে ব্যগ ভরে বাসায় ফিরতো। মাছে ভাতে বাঙালির ঘরেই এখন ভাত নাই আবার বড় মাছ খাওয়ার স্বপ্ন .!

হুড়োহুড়ি করে বাস থেকে নামার সময় খুব আতংকিত থাকি, কখন যে মানিব্যাগ যাবে তার ঠিক নাই। মানিব্যাগ যাওয়া মানে তো সাথে মাসের বাকি দিনগুলো যাবে। বাস থেকে নেমে হাটতে হাটতে প্রায়ই চাঁদটাকে দেখি, ও আমার প্রতিদিনের সঙ্গী। হাসি মাখা মুখটা এখন আর দেখিনা, মলিন চেহারাতে বাসার গেট পর্যন্ত ও আমাকে সঙ্গ দেয়। হয়ত আমাদের মত সাধারণ মানুষের কষ্টে সেও কাঁদে…।

সারাদিনের ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, পরিশ্রান্ত শরীরটা নিয়ে বাসায় ফিরে গোসল করব অথচ! আর কী পানি নাই। তৃষ্ণার্ত গলাটা ভেজানোর মত একটু ঠান্ডা পানিও ফ্রিজে নাই, বিদ্যুতের যে অবস্থা তাতে ফ্রিজে রাখা মাছ তরকারি পচে গলে বেরিয়ে যাবার দশা, আবার ঠান্ডা পানি! এত বিদ্যুত্‍ কোথায় যায় কাউকে জিজ্ঞেস করি না, মোমবাতির আলোয় ভাত খেতে বসলে পোকা মাকড়ের লাফালাফি থামাতেই খাওয়ার বারোটা বাজে।

ফ্যান চেঞ্জ করে একটা এ/সি না হয় কিনে ফেলি। কিন্তু একসাথে এত্তগুলো টাকা ..। বিছানায় শুয়ে কিসব চিন্তা করি, বিদ্যুতের যা দাম তাতে ফ্যানের বিল দিতেই তো পান্তা ফুরায় আবার এ/সি! বিদ্যুতের দাম একটা টাকা বাড়লে সারা বাজারে আগুন লাগে, পানি, গ্যাস, সিএনজি, ডলার যাই বাড়ুক তাতে রিক্সওয়ালা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। পারিনা কেবল আমরা। মাসের শেষে একটা টাকাও তো বেশি পকেটে ঢুকে না। কিভাবে চলব আমরা। উল্টা বছর শেষে বলবে ভাই অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে বেতন দিতেই জান যায়, বাড়ানোর কথা কিভাবে ভাবি বলেন। চলছে আমাদের জীবন এভাবেই।

মানুষের হাতে নাকি টাকা নাই! হাজার হাজার ফ্লাট কারা কিনে তাহলে? মাইলের পর মাইল জায়গা জুড়ে প্লট কারা বুকিং দেয়? মাটি আর ইটের চাপায় মানুষ তাদের টাকা লুকিয়ে রাখতে চায়। চারদিকে ভীতি আর আতংক। একে তো ব্যবসা নাই তার উপর আবার সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের অতি উত্পাতে মানুষ দিশাহারা। নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ নিরুপায়। আইনশৃংখলা-রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে এক হয়ে যখন সন্ত্রাসীদের গুলি চালানোর খবর পড়ি তখন আর কিছুই ভাল লাগে না , মনে হয় এর চেয়ে অনিরাপদ আর কিছুই বোধহয় হতে পারে না। আমরা সাধারণ মানুষ বেড রুমে খুন হলে বা গুম হলে কেউ জানবেও না। ক্রস ফায়ারে ছিনতাইকারী নিহত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটলেও টাকার বস্তা সহ মন্ত্রীর এপিএস ধরা পড়লেও ঘটনাটা কেন যেন লোক চক্ষুর আড়ালে চলে গেল।

গরু তার ঘানি ভেঙ্গেই চলছে, গোলাকার বৃত্তের ভেতরই সে ঘুরছে। আমরা সাধারণ মানুষও ঘুরছি। ঘানি টানছি বৃত্তেরই ভেতর। হয়ত বৃত্তের ভেতরই কাটবে জীবের বাকি দিনগুলো। বৃত্ত ভেঙে যদি কোনদিন বেরুতে পারি…। ক্লান্ত মন ও মানসিকতা নিয়ে কী কী ভাবি তার কোনও ঠিক ঠিকানা নাই। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে, প্রতিদিন তো এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমাই। চোখ দুটো ভাল করে লাগতে না লাগতেই কেমন যেন ছটফট লাগতে শুরু করে, শ্বাস- নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যাবে। লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখব বিদ্যুত্‍ নাই…।