দেশের চাইতে শ্রেণী বড়

শামীমা বিনতে রহমান
Published : 19 August 2012, 06:15 AM
Updated : 19 August 2012, 06:15 AM

উত্তর প্রদেশের রাজধানী শহর লাক্ষ্ণৌতে এসে চারবাক স্টেশনে নামার পর স্কলারশিপ প্রদানকারী প্রতিষ্টান, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স, আইসিসিআরের দুই কর্মকর্তা, নাগরিক পরিচয় ভারতীয়, আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে নিয়ে যাবার পর পরই পরিচয় করিয়ে দিল বিভিন্ন দেশ, জাতীয়তাবাদের নাগরিকদের সঙ্গে।

: নাইস টু মিট ইয়্যু, মি ফ্রম ফিজি, ফিজি আইল্যান্ড, মাই নেইম রিগস। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বিপমালার বাসিন্দা রিগস, শুধু ইংরেজিই পারে না, ও হিন্দিতেও ওস্তাদ। পড়ার বিষয় সাংস্কৃত ভাষা।

: হ্যালো, আই এম ফ্রম ঘানা, ম্যানুয়েলা, ইয়্যু ক্যান কল মি এলা। মাথা ভর্তি আফ্রিকান ট্রাডিশনাল স্টাইলের চুলের বেনি। আমার এই স্টাইলটা অনেক পছন্দ।
নামিবিয়া দেশের লুইস, সাইকোলজির ছাত্রী, যে নাকি মানুষের হাঁটা আর হাসি দেখলেই মোটা দাগে বুঝে ফেলতে পারে মানসিক গঠন; প্রথম প্রশ্ন: তুমি কি নেপালি?
আমার শরীরের শিরা উপশিরায় দেশ, জাতীয়তাবাদের কড়া প্রবাহ, ঘাড় সোজা করে বললাম, না বাংলাদেশ। তুমি কি বাংলাদেশ নামে কোন দেশের নাম শুন নাই। আইসিসিআরের সুনীল বিশ্বকর্মা, সবাইকে উদ্দেশ্য করে প্রথমেই আমার দেশের পরিচয় বলেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ শব্দটার সাথে একদম পরিচয় না থাকায় মি. সুনীলের হিংলিশ উচ্চারণ সে একদমই বুঝতে পারে নাই। আমি তার সাথে হাত মিলায়া এক থেকে সোয়া এক মিনিটের বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য দিলাম। তখনই ঘানার আরেক ছাত্র, যে তাদের দেশের ন্যাশনাল মিডিয়া কাউন্সিলে চাকরি করতো এবং ৭ বছরের চাকরি শেষ করে আবার স্কলারশীপ নিয়া ভারতে পড়তে আসছে অর্থনীতিতে, হঠাৎ করে বলে উঠলো, ইয়েস আই নো বাংলাদেশ। ইন লাস্ট ইয়ার অফ মাই কোর্স, হ্যাড আ্যা চ্যাপ্টার অন বাংলাদেশ। শুইনাই মনটা ভইরা উঠলো। নামে তো চিনে! কি পড়সে কে জানে, পরে শুনলাম মাইক্রো ক্রেডিট। কোফি নিজেকে পরিচিত করসিল এই ভাবে, মাই নেইম ইজ কোফি, ক্যুফর সেলরম কোফি, নট কফি, হা হা হা. . .

আরো অনেকে। নেপাল, জর্জিয়া, কম্বোডিয়া, ত্রিনিদাদ আ্যান্ড টোবাগো, উগাণ্ডা, ইথিওপিয়া, অনেক দেশের অনেক শিক্ষার্থী এই লাক্ষ্ণৌতে জমা হৈসে, লাক্ষ্ণৌ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য। মোটা দাগে সবাই থার্ড ওয়ার্ল্ড।

আমরা প্রথমে দেশ পরিচয়ে পরিচিত হৈলাম এবং সবার সাথে প্রাথমিক গল্পে যেটা বুঝলাম, সবার দেশই একটা সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। দেশের পর পরই দ্বিতীয় যে টি পরিচয়ের ইনডিকেটর ছিল, সেটা ধর্ম। আমার নামের মধ্যে মধ্য প্রাচ্যের মুসলমানদের একটা গন্ধ আছে। তো, এটা কেউ কেউ ধরতে পারলো। ঘানারই আরেকজন, সাবা, পরিচয়ের সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলো: আর ইয়্যু মুজলিম?
আমি তারে উত্তর না দিয়া পাল্টা জিগাইলাম, তুমি কি?
বললো, আমি মুজলিম। আমি ফাস্টিং করতেসি। ঠিক করসি এবার ৩০ দিনই রোজা রাখবো। ইয়্যুর নেইম লাইক মুজলিম। বিনতে।
আমি বললাম, আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে হৈসে। বাট আমি নিজেরে কোন ধর্মেরই মনে করি না।
সে ভ্রু কুঁচকাইয়া বললো, তুমি কি এথিয়েস্ট?
আমি বললাম, আমি ধার্মিক না। আমি আ্যগোনিস্টিক এথিয়েস্ট।

এই উচ্চারণটা একটু ধাক্কা ছিল অন্যদের কাছে। ওদের কাছে, বাংলাদেশ মানে ইন্ডিয়ার মতো একটা কিছু। পুরানা, মানে মাস্টার্স কমপ্লিট করে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষাকারি বা মাস্টার্সের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে ভারতীয় মানে ভয়ংকর ধার্মিক আর রক্ষণশীল। তো এরকম পরিচয় কোন মানে তৈরি করসে কি-না জানিনা, তবে ধাক্কা ছিল, এটা বুঝতে পারসি। দেশ পরিচয়ের মতো এরপর সবাই ধর্মীয় পরিচয় দিল আমারে। খ্রিস্টানের সংখ্যা সর্বোচ্চ। এরপর হিন্দু তারপর বুদ্ধিস্ট, মুজলিম,মানে মুজলিম মাত্র ১ জন। শাবা। এরা ধার্মিকতার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস না, তবে বিশ্বাসি, মনে করে একজন গড বা ভগবান বা আল্লাহ নিশ্চয়ই আছেন, যিনি পৃথিবীসহ মানুষের স্রষ্টা।

আমাদের আড্ডা জমে কিচেনে। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা রুমে থাকে। কিন্তু সবাই রান্না করে খায়, খাবারটা হয় ডাইনিংয়ে। ভেজ এবং ননভেজ, মানে সবজি ভোজি এবং মাছ-মাংসভোজি সবাই রান্নার প্রস্তুতি নিতে নিতে আড্ডা জমায় এবং এদের তেমন কোন ভারতীয় বন্ধু নাই। তৃতীয় বিশ্বের গরীব এবং উন্নয়নের চেষ্টাকারি দেশগুলার এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে, বেশিরভাগই চাকরিজীবি ছিল, চাকরি ছেড়ে আসছে, একটা বিরতির জন্য। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ আইন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবি ছিল, কেউ জাতিসংঘের উন্নয়ন শাখায়, কেউ গবেষক এরকম, নানা। সবার ইন্টারেক্টের ভাষা ইংরেজি। সবার সংস্কৃতি আলাদা। দেশ-সীমানার ভুগোল আলাদা। ধর্ম আলাদা। কিন্তু শুরুতে যে দেশ পরিচয় আর ধর্ম পরিচয়ের মধ্য দিয়া পরিচিতি শুরু হৈসিল, কয়েকদিনে সেটা গৌন হয়ে প্রধান ইন্ডিকেটর হয়ে দাঁড়ায় ক্লাস বা শ্রেণী।

এখানে বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্তের। কয়েকজন আছে নিম্ন মধ্যবিত্তের। এদের বাবা মা ভাড়া বাসায় থাকে। এরা টাকা খরচ করে মেপে মেপে। এরা একবার রান্না করে বেশিদিন ফ্রিজে রেখে খায়, কমন ফ্রিজ হওয়াতে এই তথ্য সবার জানা হয়ে যায়। এরা বাসের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবে, কিন্তু অটোতে চড়ে না। এরা পার্টি থ্রো করে না, কিন্তু অন্যের থ্রো করা পার্টিতে এসে এরা বেশি বেশি খায়। এবং এদের নিয়া আয়েশে চলা গ্রুপটা আলাদা হয়ে হাসি ঠাট্টা করে।

ঘানার কোফি, যে অসম্ভব সুন্দর স্কেচ করে, যার রুম ভর্তি অনেক খাবার দাবার থাকে, অন্যরা যে কারণে তার রুমে বেশি গতায়াত করে; একদিন বলতেসিল আমাকে, শুন, তোমার দেশে কি ওই যে আ্যামেরিকায় লোক নেয়ার লটারি সিস্টেম আছে?
আমি বললাম, হুম, আছে। বেশিরভাগই হুমড়ি খেয়ে তাতে আ্যাপ্লাই করে।
বললো, আমার দেশেও আছে। বুঝছো, আগে কি হৈতো, আচ্ছা বলতো তোমার দেশে বৃটিশরা যাওয়ার পর রেললাইন নতুন হৈসে কতদূর।
তেমন হয় নাই। তবে কিছু কাজ চলতেসে। ক্যান?
শুন আমার দেশে একদমই হয় নাই। যখন বৃটিশ কলোনি ছিলাম আমরা, তখন তারা আমার দেশ থেকে টিম্বার, তুমি কি টিম্বার বুঝতেস, ট্রি।
ইয়েস, বলো।
আমার দেশে তো জানই ডায়মন্ড এবং স্বর্ণের রিসোর্স আছে। তো বৃটিশরা বেসিক্যালি টিম্বার আর মানুষ নেয়ার জন্য ট্রেইন ব্যবহার করতো। তখন তারা দাস হিসাবে আমাদের মানুষ নিসে। আর এখনতো কলোনি পাল্টাইসে। এখন আ্যামেরিকা বিগ পাওয়ার। এখন আ্যামেরিকা লটারি দিয়া ওদের দেশে লোক নেয়। ওদের ডেভোলাপমেন্টের জন্য। আমরা গরিবরা গিয়া ওদের দেশ বানায়া দিবো আর ওরা বড়লোকরা আরাম করবো। ওখানে কিন্তু ওরা আমাকে নিতে পারবে না। ওরা নিবে, এই যে. . .(যাদের নাম বললো, তারা এই ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের হিসাবি বাসিন্দা, বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ যাদের নাই)।

আমি খেয়াল করসি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে প্রাধান্য দিয়া আইসিসিআর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন দেশ থেকে যাদের নিয়া আসছে, পড়াশুনা, থাকা-বই কেনার টাকা দিয়া, সেখানে দেশের প্রতিনিধিত্ব ড্রেসের প্রতিনিধিত্বের মতো। আমরা সবাই এক সাথে ইউনিভার্সিটি যাই আর আলাদা হয়ে যাই। গায়ের রং কালো, অথবা অকালো, চুলের স্টাইল বা কপালের টিপে দৃশ্যমান যতোই সাংস্কৃতিক ফারাক থাকুক, দেশ-সীমানার গণ্ডি ছাড়ায়া এক বিল্ডিংয়ের ভেতর আমরা এবং ওরা'র গোপন নয়, প্রকাশ্য বিভাজন।