সেলুন এবং বিউটি পার্লার স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতা জরুরি

মোঃ আজিজুর রহমান
Published : 8 Jan 2017, 09:49 AM
Updated : 8 Jan 2017, 09:49 AM

কল্পনা করুন। আপনি কাজে বাইরে বের হবেন। আপনার স্ত্রী আপনাকে একটা শার্ট এনে দিলেন। একটু স্যাঁতস্যাঁতে ভিজা। বললেন, তোমার ছেলে আজ শখ করে তোমার এই প্রিয় শার্টটা পরে একটু বের হয়েছিলো। যে গরম! ঘামে ভিজে গেছে। এরপর চিরুনিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, চুলটা ঠিক করে নাও। একটু নোংরা হয়ে গেছে। আমাদের গ্রাম থেকে যে গেস্টরা এসেছিলো, তাঁরা না বুঝে এটা ব্যাবহার করে ফেলেছেন। পরিস্কার করতে হবে। আজ চালিয়ে নাও।

এরকম পরিস্থিতি বাস্তবে হলে আপনি কী করতেন? নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হতেন এবং রেগে গিয়ে স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যাবহার করে ফেলতেন। কারণ, আপনি একটু খুঁতখুঁতে। কারো জামা কখনো পরেননি, কারো সাথে গামছা, তোয়ালে কখনো শেয়ার করেননি। পরিস্কার বিছানা ছাড়া আপনি ঘুমাতে পারেন না ইত্যাদি। স্ত্রীকে বলতেন, তুমি জানোনা, আমি কেমন?

আপনি একটু খুঁতখুঁতে। কারণ, আপনি জানেন একজনের জিনিস অন্যজনের ব্যবহার করা উচিৎ নয়। এতে একজনের শরীরের জীবাণু অন্যের শরীরে চলে যায়, সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু এই আপনি যখন চুল কাটাতে বা শেইভ করাতে নাপিতের কাছে যান তখন কি করেন? নাপিত যখন আপনাকে সপ্তাহখানেক ধরে না কাঁচা, অপরিচিত কত মানুষের গলায় পরানো, পানি এবং ঘাম দিয়ে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে একটা কাপড় বা তোয়ালে আপনার গলায় পেঁচিয়ে দেয় এবং আপনি প্রায় আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সেই কাপড় গলায় পেঁচিয়ে চুল কাটানোর মজা উপভোগ করেন, তখন কোথায় যায় আপনার চিরাচরিত খুঁতখুঁতে স্বভাব?

তারপরে আসুন চিরুনির ক্ষেত্রে। বাসায় আপনার যে চিরুনি শুধু আপনারই, এখানে কী করছেন আপনি? নাপিত আপনার মাথায় যে যে চিরুনিটি বীরদর্পে চালিয়ে দিচ্ছে তা দিয়ে আপনার আগে কতজনকে সাইজ করে দিয়েছে তা ভেবে দেখেছেন? তাও আবার এক মিনিট দু মিনিট নয়, চুল কাটার পুরো সময় তা আপনার পরিস্কার খুসকিমুক্ত মাথায় ঘুরছে, আর আপনার আগের মানুষগুলোর মাথা থেকে অতি যত্নে সংগৃহীত ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি আপনার সুন্দর মাথার খুলিতে এবং চুলে লাগিয়ে দিচ্ছে।

ভেবে দেখেছেন, আপনি চুল কেটে বাড়ি গিয়ে শাওয়ার নিতে নিতে, এই নতুন আগন্তুকগুলো আপনার মাথায় বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে কি না?  আপনি সেলুনে ফেলে গেলেন আপনার অপ্রয়োজনীয় চুল এবং মাথায় করে সাথে নিয়ে গেলেন অগনিত মানুষের ভালো-খারাপ লাখ লাখ জীবাণু। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো এই নতুন আগন্তুকরা কোন ক্ষতি করতে পারবে না, কারণ আপনার নিজের শরীরের জীবাণুগুলো তাদের হয়তো বাঁধা দিতে চেষ্টা করবে, কিন্তু খারাপ হলে আপনি পেয়ে যেতে পারেন স্ট্যাফাইলোকক্কাসের মতো ভয়ংকর কিছু জীবাণু যা আপনার মাথায় ফলিকুলাইটিস নামক এক ধরনের ফুসকুড়ি তৈরি করবে। সেলুন থেকে বা অন্যের ব্যবহারের জিনিস শেয়ার করার ফলে একজনের থেকে আরেকজনের কাছে সংক্রামিত হয় রিং ওয়ার্ম বা দাঁদের জন্য দায়ী 'টিনিয়া' প্রজাতির ছত্রাক এবং খুস্কির জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া যেমন স্ট্যাফাইলোকক্কাস বা প্রপায়নিব্যাক্টেরিয়াম এবং ছত্রাক যেমন ম্যালাসেজিয়া (Malassezia) ।

ফলিকুলাইটিস (Folliculitis) খুবই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে এবং চিকিৎসা নিতে দেরি হলে, আপনার মাথার সব চুল সাফ করে দিতে পারে। সেলুনে দাড়ি কামানোর সময় স্কিন কেটে যাওয়া খুব কমন এবং এর মাধ্যমে অন্যের কাছ থেকে আপনার মধ্যে চলে আসতে পারে হেপাটাইটিস, এইডস সহ অনেক ভয়ংকর রোগের ভাইরাস। সেলুনের মাধ্যমে উকুন ছড়িয়ে পড়াও খুব কমন।

আর ঘাড়ে প্যাঁচানো স্যাঁতস্যাঁতে কাপড়টাতো আরো ভয়ংকর। স্যাঁতস্যাঁতে থাকার কারণে, এটা হলো জীবাণু বংশবিস্তারের এক আদর্শ মাধ্যম। আপনার ঘাড়ে যে নতুন দাঁদের মতো একটা ইনফেকশন ধরা পড়েছে তার উৎস কি ভেবে দেখেছেন?

তাহলে কী করবেন এসব সংক্রামক জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা পেতে? উন্নত দেশে সেলুন হাইজিনের ব্যাপারে আইন আছে। নাপিত বা পার্লারে যারা কাজ করবেন, তাদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। তাদের শিখানো হয় কিভাবে এই সংক্রামক রোগ ছড়ানো কমানো যায়। কিন্তু এরপরেও এখানকার সেলুনগুলো থেকে অনেক রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তার মধ্যে আছে এইডস, হেপাটাইটিস বি এবং সি, ফলিকুলাইটিস, রিং ওয়ার্ম সহ অনেক রোগ।

যেহেতু আমাদের দেশে সেলুন হাইজিন নিয়ে এরকম প্রশিক্ষণ নেই এবং এ সম্পর্কে কোন আইন নেই (না জানা থাকলে দুঃখিত) তাই নিজে সাবধান হতে হবে। পারলে চুল কাটার মেশিন কিনে বাসায় নিজে চুল কাটুন বা সেলুনে গেলে চুল কাটার জন্য যা লাগে যেমন দুইটা চিরুনি, একটা সাদা কাপড়, একটা ফোম সাথে করে নিয়ে যান। নিজের কাঁচি ছাড়া নাপিত অন্য কাঁচি ব্যবহার না করতেও চাইতে পারে। কাঁচিতে খুব একটা সমস্যা নাই, কারণ এটা আপনার স্কিনের সংস্পর্শে আসেনা। এবং পারলে নাপিতকে তার কাজের রিস্ক সম্পর্কে বলুন। হয়তো সে  নিজে সাবধান হবে।

এই হাইজিনের ব্যাপারগুলো শুধু জেন্টস সেলুনের জন্য প্রযোজ্য তা নয়। লেডিজ বিউটি পার্লারের মাধ্যমেও অনেক রোগ ছড়ায়। নক কাটার সময়, নেই ক্লিপারের মাধ্যমে নকের ফাংগাস, চুল কাটার সময় উকুন, খুসকির জীবাণু এবং ফেসিয়াল করার সময় একই তোয়ালে দিয়ে অনেকের মুখ পরিস্কার করার ফলে ব্রণের জীবাণু ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ে।

সাবধান হই, সবাই ভালো থাকি, সুস্থ্য থাকি।