ঈশ্বর কণা ও কুন-ফাইয়াকুন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 5 July 2012, 06:22 PM
Updated : 5 July 2012, 06:22 PM

আদিতে মহাজগতের সকল বস্তুই একটি মাত্র বিন্দুতে থিতু অবস্থায় ছিল। এই বিন্দুর ঘনত্ব ছিল অসীম। বিজ্ঞানীরা একে বলেছেন সিঙ্গুলারিটি বা মহাএকত্ব। এর পর আসে সৃষ্টির মহেন্দ্রক্ষণ। একটি প্রচণ্ড শব্দের মধ্য দিয়ে এই অসীম ঘনত্বের বিন্দু থেকে সব কিছু ছড়িয়ে পড়ে। কিংবা এই প্রচণ্ড শব্দের ফলেই তৈরি হয় আর যা কিছু। সকল পদার্থ এই প্রচণ্ড শব্দের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন প্রচণ্ড নিনাদ তত্ত্ব বা বিগব্যাং থিওরি।

বস্তু সৃষ্টির পূর্বে সব কিছুই শক্তিরূপে বিরাজ করত। প্রচণ্ড নিনাদের ফলে আদিতে সৃষ্টি হয় মোট ১২টি কণা। এ গুলো আবার ৬টি করে দুইটি গুচ্ছে বিভক্ত। এই কণা বস্তুর আদিরূপ হলেও এদের স্থায়ীত্ব নেই। অন্য কণাগুলোকে সৃষ্টি করেই তারা আবার অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীরা ১১টি আদি কণা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ১২ নম্বর কণাটি গত ৪ জুলাই, ২০১২ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যৌক্তিক বিশ্বাসের মধ্যেই থেকে গিয়েছিল।

এই কণাটির অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন আইনস্টাইনের সহকর্মী ভারতীয় বাংগালী বিজ্ঞানী সত্যেন্ত্রনাথ বসু যাকে ইংরেজগণ বলেন বোস। কণাটির বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা করেছিলেন স্কটিশ বিজ্ঞানী হিগস। তাই এই কণার নাম দেওয়া হয় হিগস-বোসন। এতদিন কল্পিত কিন্তু মহাজগতের সৃষ্টি রহস্যের ব্যাখ্যার জন্য অপরিহার্য এই কণাটি মানুষের অজানাই রয়ে গিয়েছিল। ৪ জুলাই, ২০১২ ইউরোপিয়ান কমিশনের পারমাণবিক গবেষণাগারের (সার্ন) বিজ্ঞানীরা এই দ্বাদশ কণাটি আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।

বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এই নতুন কণাটির বৈশিষ্ট্যাবলীর সাথে হিগস-বোসন কণার নাকি ৯৯.৯৯৯ ভাগ মিল রয়েছে। প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে সুইজারল্যান্ড ফ্রান্স সীমান্তের কাছে ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি কৃত্রিম ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপ্রতীম পরীক্ষাগারে একটি মিনি সাইজের কৃত্রিম বিগব্যাং এর অব্যবহিত পরবর্তী ঘটনার জন্ম দেওয়া হয়। এই বিগব্যাঙের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা তাদের প্রত্যাশিত দ্বাদশ কণাটি খুঁজে পান। এই কণার অস্তিত্ব বিগব্যাং তত্ত্বের প্রায় পূর্ণতা দিয়েছে বলে দাবী করা হচ্ছে। সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম বলে এই হিগস-বোসনের সাহিত্যিক নাম হচ্ছে ঈশ্বর কণা।
লিও লিডারম্যান নামের একজন কল্প লেখক ১৯৯৩ সালে হিগস-বোসন কণাকে আশ্রয় করে যে বই প্রকাশ করেছিলেন তার নাম দেওয়া হয়েছিল ডি গড পার্টিকেল বা ইশ্বর কণা।

আজ সকালে নাস্তার টেবিলে স্ত্রী সন্তানদের সাথে ঈশ্বর কণা নিয়ে কথা বললাম। বিগব্যাং সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আমার রয়েছে। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে মহাবিশ্ব সৃষ্টির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন সৃষ্টির ইচ্ছা হলে আল্লাহ বলেছেন 'কুন' (সৃষ্টি হয়) আর ধ্বংসের সময় বলবেন, 'ফাইয়াকুন'( ধ্বংস হও)। এই সৃষ্টি বিগব্যাঙের মাধ্যমেই হয়েছিল কি না তার বর্ণনা অবশ্য কোরআনে নেই। তবে আল্লাহর ইচ্ছায় যে সৃষ্টি তা যদি একটি প্রচণ্ড নিনাদের মাধ্যমে হয়, তবে তাতে ক্ষতি কী? আর প্রলয় বা কিয়ামতের দিনের বিভিন্ন বর্ণনায় যে প্রচণ্ডতা রয়েছে তা পরকালে বিশ্বাসী মুসলমান মাত্রই জানেন।

পৃথিবীতে প্রথম মানুষ আদম সৃষ্টির ঘটনাটি কোরআনে ভালভাবেই বর্ণিত রয়েছে। হাদিসের বর্ণনা মতে আদমকে মাটি থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু মাটি কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা কোন ধর্মগ্রন্থে নেই। বিগব্যাং থিওরি আমাদের শুধু মাটি নয়, পৃথিবীতে বস্তু তৈরির একটি প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দেয়। শক্তি থেকে বস্তু তৈরিতে প্রাথমিকভাবে যে ১২টি মহাকণার সম্মিলন প্রয়োজন তার সবকয়টিই এখন মানুষের জানা। তাই, সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জয় হোক বিজ্ঞানের; উন্মোচন হোক মহাবিশ্ব-সৃষ্টি রহস্যের।