লর্ড কর্নওয়ালিসের দারোগা বনাম বাংলাদেশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 3 August 2012, 05:10 AM
Updated : 3 August 2012, 05:10 AM

বাংলার ইতিহাসে কোতোয়াল, ফৌজদার, দারোগা ইত্যাকার পুলিশ পদবীগুলোর প্রবর্তন হয়েছিল সুলতানী শাসন আমলে (১৩৪২-১৫৩৮) [১]। প্রদেশ (ইকলিম) বা বিভাগ (শিকাহ্‌) এর দায়িত্বে থাকতেন একজন ফৌজদার। জেলা (আরছা) এর দায়িত্বে থাকতেন কোতোয়াল এবং থানার (পরগণা) দায়িত্বে নিযুক্ত থাকতেন একজন দারোগা। অনেক সময় বড় বড় শহরের দায়িত্বে থাকত ভিন্ন একজন কোতোয়াল। শহরের কোতোয়াল বর্তমানের মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের মতো দায়িত্ব পালন করতেন। বর্তমানে পুরাতন জেলা শহরের কিছু থানার নামের সাথে কোতোয়ালী শব্দটি রয়ে গেলেও ফৌজদার কিংবা কোতোয়াল বলে কোন পদবী বাংলা-ভারতের পুলিশ প্রশাসনে প্রচলিত নেই। কিন্তু দারোগা শব্দটি এখনও বহুল প্রচলিত। যদিও সরকারি নথিপত্রের কোথাও কোন অফিসারকে দারোগা বলে নিহ্নিত করা হয়নি, তবুও দারোগা বললে দেশের আপামর জনসাধারণ প্রশ্নাতীতভাবে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরকেই বোঝেন।

ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ইংরেজগণ নানা প্রকারের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। সুলতানি আমল থেকে গৃহীত মোঘলদের প্রতিষ্ঠিত পুলিশ-ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে তারা জমিদারদের অধীনে পুলিশ রাখার মতো কাজও করেছিলেন। কিন্তু এসবের কোনটাই ফলপ্রসু হয় নাই। ১৭৯৩ সালে বাংলার বড় লাট লর্ড কর্নওয়ালিস জমিদারদের কাছ থেকে পুলিশকে বের করে এনে সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ন্যাস্ত করেন। এই সময় ফৌজদার না থাকলেও কোতোয়াল ও দারোগার পদটি বহাল ছিল। ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, পাটনা প্রভৃতি শহরগুলোর আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকতো একজন কোতোয়াল । তার অধীনে থাকত কয়েকজন দারোগা। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের থানাগুলোতে নিয়োগ করা হত একজন করে দারোগা [২]।

কোতোয়াল ও দারোগার চাকরি ছিল সরকারি। পূর্বে তাদের বেতন আসতো জমিদার বা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে। এখন তাদের বেতন দেওয়া হয় সরকারি কোষাগার থেকে। কিন্তু কোতোয়াল ও দারোগাদের নিয়োগের শর্ত হিসেবে ব্রিটিশ সরকার একটি কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়। কোতোয়াল হতে হলে চাকরিপ্রার্থীকে সরকারি কোষাগারে জামানত দিতে হত ৫,০০০/ টাকা এবং দারোগার জন্য জামানত ছিল ১,০০০/- টাকা [৩]।

এই সময়টি সায়েস্তা খানের আমল ( ১৬৬৪-১৬৮৮) [৪] থেকে মাত্র একশত বছর পরে ছিল। সায়েস্তা খানের সময় বাংলা ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল। লর্ড কর্নওয়ালিসের সময়ও এর কোন পরিবর্তন ঘটেনি। যদি সায়েস্তা খানের আমলে এক টাকা সংগ্রহ করতে আট মন চাল বিক্রয় করতে হত, তাহলে লর্ড কর্নওয়ালিসের সময় হয়তো এক টাকা সংগ্রহ করতে অন্তত একমণ চাল বিক্রয় করতে হত। সেক্ষেত্রে সহজেই অনুমান করা যায় চাকরিপ্রার্থী দারোগার পদটির দাম ছিল কমপক্ষে ১,০০০ মণ চালের দামের সমান।

লর্ড কর্নওয়ালিস আমলের একজন দারোগার বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল মাসিক ২৫/- টাকা মাত্র [৫]। এমনকি লর্ড কর্নওয়ালিসের রাজত্ব (১৭৮৬-১৭৯৩) শেষ হওয়ার প্রায় দেড়শত বছর পরেও, ১৯৪৯ সালে, একজন দারোগার মাসিক মূল বেতন ছিল মাত্র ৮০/-টাকা [৬]। এমতাবস্থায়, লর্ড কর্নওয়ালিসের রাজ্যে একজন দারোগাকে কত বেশি অর্থের বিনিময়ে সরকারি পদ ক্রয় করতে হতো তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই সময় সাধারণ ঘরের কেউ দারোগা হতে পারতো না। সেই সময়ের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তানগণ বহু টাকা বিনিয়োগ করে কিংবা কোন সাধারণ ঘরের যুবক তার সর্বস্ব বন্ধক-বিক্রয় করে প্রয়োজনীয় অর্থ রাজকোষে জমা দিয়ে দারোগার পদটি ক্রয় করত।

দারোগা বা কোতোয়ালের পদ পেয়ে তৎকালে এই রাজকর্মচারিগণ তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ পূনরুদ্ধারের জন্য জনগণের উপর কিরূপ আচরণ করতো তার সাক্ষী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। তাদের দাপটে আপামর জনগণ সর্বদা তটস্থ থাকত। কোন গ্রামে দারোগা ঢুকলে গাছের আমটি থেকে গোয়ালের গরুটির মালিকানা পর্যন্ত চলে যেত দারোগার হাতে। একজন দারোগার নিজ লেখনিতেই প্রকাশ, " মুসলমান দারোগা হিন্দুর গ্রামে যাইয়া প্রকাশ্যরূপে হিন্দুর অখাদ্য জীব সকল জবাই এবং হিন্দুর অস্পর্শীয় দ্রব্য সকল চতুর্দ্দিকে নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিত, যাহাকে সম্মুখে দেখিতে পাইত, তাহাকে ধরিয়া নানারূপ কষ্ট দিত এবং চৌকীদার ও মণ্ডলকে মনের সাধ মিটাইয়া প্রহার করিত''।[৭]

সেই সময়ের মানুষ লর্ড কর্নওয়ালিসের মতো বড়লাটদের চোখে হয়তো দেখেনি। কিন্তু তার ক্ষমতার কথা জানতো। কিন্তু গ্রাম বাংলার মানুষ বাস্তবে বড় লাটের চেয়েও একজন দারোগাকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান বলে বিশ্বাস করত। কেননা, "পুলিশের এই সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে জমিদার কিম্বা অধিবাসীরা মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রতিবাদ করিলে তিনি তাহাতে প্রায়ই কর্ণপাত করিতেন না, অধিক হইলে দারোগার নিকট কৈফিয়ত তলব করিতেন এবং দারোগা সাহেবকে (ম্যাজিস্ট্রেটকে) এই বলিয়া প্রবোধ দিত, যে এই প্রণালীতে কার্য্য না করিলে, মোকদ্দমায় কৃতকার্য্য হওয়া তাহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইবে''।[৮]

এমনও কথা প্রচলিত আছে যে একদা বাংলার বড় লাট মফসালে ভ্রমণকালে জনৈক সাধারণ মানুষের প্রতি এক বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলেন। একজন সাদা চামড়ার মানুষ ভারতীয়দের এমন উপকার করতে পারে, তিনি তা ভাবতেই পারেননি। যারপর নেই খুশি হয়ে সেই বাংগালী কৃষক বড় লাটকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন, 'বাবা, তুমি আরো বড় হবে। আল্লাহ যেন তোমাকে একদিন দারোগা বানায়'। হয়তো এটা আতিশয্য দোষে দুষ্ট একটি উপকথামাত্র। কিন্তু, ব্রিটিশ আমলের দারোগারা যে বাংলার মানুষের কাছে অন্যায্য, অবৈধ ও বল্গাহীন স্বৈরাচারী ক্ষমতার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি ছিল এই উপকথা তারই ইঙ্গিত বহন করে।

আইন-বিধি ও কর্তব্য পালনের ধরণের জন্য বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক তথা বিচার ব্যবস্থায় আইনী ক্ষমতার দিক দিয়ে একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের অবস্থান এখনও অনন্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ ফৌজদারি মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর বা দারোগা আইনগতভাবে অনেকটাই স্বাধীন| পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ দারোগাদের উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেও আইনগত ক্ষমতা তাদের সীমীত। এমতাবস্থায়, দারোগাদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, পরিচালনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিজ্ঞতাপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

দারোগাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের নানা অভিযোগ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় [৯]। লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলের মতোই যদি স্বাধীন বাংলাদেশের দারোগারা সাধ্যাতীত অর্থের বিনিয়োগ করে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগলাভ করেন, তা হলে, তাদের আচরণ বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশিত সাব-ইন্সপেক্টরদের মতো নয়, বরং ঔপনিবেশিক আমলের দারোগাদের মতোই হবে। তাই, দারোগাদের নিয়োগ অত্যন্ত স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

সূত্রাবলীঃ

[১] http://en.wikipedia.org/wiki/Sultanate_of_bengal
[২] বাংলাদেশ পুলিশ: উত্তরাধিকার ও ব্যবস্থাপনা- আহমেদ আমিন চৌধুরী; দ্বিতীয় সমাবেশ সংস্করণ/ সমাবেশ, ঢাকা ২৩২ পৃষ্ঠা
[৩] কোম্পানী আমলে ঢাকাঃ মূল জেমস টেইলর, অনুবাদঃ আসাদুজ্জামান পৃষ্ঠা ৬১, বাংলা একাডেমী ঢাকা।
[৪] http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE_%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%81
[৫] Indian Police: Its development up to 1905 An Historical Analysis by J.C. Madan Page-18
[৬] বাংলাদেশ পুলিশ: উত্তরাধিকার ও ব্যবস্থাপনা- আহমেদ আমিন চৌধুরী; দ্বিতীয় সমাবেশ সংস্করণ/ সমাবেশ, ঢাকা ২৩২ পৃষ্ঠা
[৭] সেকালের দারোগার কাহিনী- গিরিশচন্দ্র বসু, ই-বুক বিডিনিউজ২৪ ডট কম।
[৮] ঐ
[৯] http://www.thedailystar.net/2007/02/16/d70216012217.htm