শান্তিপদক নিয়ে বাঙালির যত অশান্তি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 17 August 2012, 07:20 AM
Updated : 17 August 2012, 07:20 AM

প্রফেসর ইউনুস সম্পর্কে এই ব্লগে যা লেখা হচ্ছে কিংবা যে সব মন্তব্য এসেছে সেগুলোর মধ্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি এক সময় জড়িয়ে পড়ি। লিখতে গিয়ে নয়, বরং মন্তব্য করতে গিয়েই যত ঝামেলা। আমার এই পোস্টের মধ্য সেই সব লেখা ও মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ার সাথে আমার নিজস্ব কিছু মতামত রয়েছে। ইউনুস বিতর্কে প্রবেশ করে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থানের জন্যই আমার এই নিবন্ধ।

অনেকে মনে করেন, পাশ্চাত্যের পদলেহন ভিন্ন কেউ নোবেল লাভ করতে পারে না। আমি বলি, নোবেল পুরস্কার প্রদান করে নরডিক বেল্টের সুইডিস একাডেমী। নরডিকদের পাশ্চাত্য পূজোর বেশি ইতিহাস নেই। এরা প্রতীচ্য আর পাশ্চাত্যের ভাবধারা থেকে বহুলাংশে পৃথক। তবে প্রবলের প্রভাব অস্বীকার করতে পারে কে?

প্রথম বাংগালী হিসেবে নোবেল পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তার কাব্য সংকলন গীতাঞ্জলিই তাকে এই সম্মান এনে দিয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিতে কোন পাশ্চাত্য দর্শনের গুণগাণ নেই। গীতাঞ্জলির সুর একান্তই বাংগালীর। গীতাঞ্জলীর দর্শন একান্তই প্রচীত্যের বা বঙ্গ-ভারতের।

তবে নোবেল কমিটি যে সব কিছুই সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারে বা নোবেলের মূল্যায়ন সবার কাছে সঠিক মনে হবে, এমনটি আমি মনে করি না। নোবেল কমিটি সাহিত্যে সর্বপ্রথম যাকে নোবেল দিয়েছিলেন সেই সুলে প্রুদোমের লেখা এখন কেউ পড়ে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে, এর মাত্র ১২ বছর পরে ১৯১৩ সালে নোবেল পাওয়া রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া বাংগালীরা কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই শুরু করে না। টেগরকে নিয়ে পাশ্চাত্যের এখনও বড় আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু তারপরও রবীন্দ্রনাথ বাংগালীদের শান্ত করতে পারেননি। সেই সময় বলা হত, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের নোবেল নাকি বিড়ালের ভাগ্যে দইয়ের শিকা ছেঁড়ার মতো।

অনেকে রবীন্দ্র বিরোধীতা করতে গিয়ে নতুন তত্ত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন যে রবীন্দ্রনাথ লান্ডনে গিয়ে নোবেল পাওয়ার জন্য আইরিশ কবি ডাব্লিউ.বি.ইয়েটস এবং নির্বাসিত আমেরিকান কবি এজরা পাউন্ডকে তেল মেরেছিলেন। এই দুই কবি নাকি ছিল নোবেল কমিটির কাছে গীতাঞ্জলির পক্ষে শক্ত-সামর্থ্য লবিস্ট।

হাস্যকর বটে! ইয়েটস একজন ভাল কবি। তিনি রবীন্দ্রনাথে বন্ধু ও ভক্ত ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির কিছু গান ইংরেজিতে অনুবাদও করেছিলেন। কিন্তু আইরিশ-ইংলিশ অভিজ্ঞ হলেও ইয়েটস বাংলায় দক্ষ ছিলেন না। তাই তার কৃত অনুবাদ গীতাঞ্জলির ভাবকে ধারণ করতে পারে নাই। অগত্তা রবীন্দ্রনাথ নিজেই এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। এই অনুবাদ ছিল সাবলিল, যে কবি বাংলায় লিখেছেন, তিনিই ই্ংরেজিতে লিখেছেন। যে ভাবুক বাংলায় ভেবেছেন, তিনিই ইংরেজিতেও ভেবেছেন। তাই গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে এখনও পাশ্চাত্য মুগ্ধ।

বলাবাহুল্য, যে ইয়েটসকে রবীন্দ্রনাথে নোবেল প্রাপ্তির জন্য লবিস্ট বলা হচ্ছে সেই ইয়েটস নোবেল পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের নোবেল পরওয়ার ১০ বছর পর ১৯২৩ সালে। এবার দেখুন, নোবেল কমিটির কাছে ইয়েটস এর মূল্যায়ন কি ছিল? আর এজরা পাউন্ড, তিনি তো ছিলেন মূলত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। তাকে নোবেল কমিটি পুরস্কারের তালিকায় বিবেচনাই করেননি।

আরো মর্মান্তিক হল রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদকটি চুরি করতে বাঙালি চোরগণ কার্পণ্য করেননি। আর একটি তথ্য না দিয়ে পারছি না। নোবেলে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি কৃষি ব্যাংক করেছিলেন। কিন্তু তা পরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে শান্তিতে নোবেল নিয়ে বিতর্কটা আরো বেশি গাঢ়, আরো বেশি প্রকট। শান্তিতে ঘোষিত প্রতিটি নোবেল মাঠের অশান্তি না হোক অনেকের মনের অশান্তি ডেকে এনেছে। দালাই লামার নোবেল চীনের, সুচির নোবেল মায়ানমারের এবং আরো অনেকগুলোর উদাহরণ দেওয়া যায়। আর ইউনুসের নোবেল যে বাংলাদেশের অনেকের মনে অশান্তির সৃষ্টি করেছে এই ব্লগের এই পোস্টসহ কয়েক ডজন পোস্টই তার প্রমাণ। নোবেলের শান্তি পুরস্কারের এই অশান্তি বাঙালিদের আরো কতদূর নিয়ে যাবে তা আমি অনুমান করতে পারছি না।

আমার চিন্তার ক্ষেত্রটা এই আলোচনা থেকে অনেকাংশে পৃথক। কিন্তু তবুও আমি সাম্প্রতিক অন্যান্য বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন নই। এই ব্লগের প্রায় সকল লেখাই আমি পড়ি। অনেকগুলোতে মন্তব্য করা থেকে সচেতনভাবেই বিরত থাকি। পুলিশিং বিষয়ে কোন পোস্ট আমার মন্তব্য থেকে দূরে থাকে না। এই বিষয়ের অনেকের লেখা আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, অনেক নতুন তথ্য দেয় এবং আমাকে আরো বেশি লিখতে উৎসাহিত করে।

ইউনুস সম্পর্কে যে ঝড় অন্যান্য মাধ্যমের মতো এই ব্লগেও আঘাত হেনেছে, সেই ঝড়ের আঘাত থেকে আমিও মুক্ত নই। এই ঝড় আমাকে নিয়মিতই প্রভাবিত করে। ইউনুসের পক্ষে বিপক্ষের যুক্তি ও যুক্তি খন্ডনে আমি নিজেও খণ্ডিত হই, আবার একত্রিত হই।

তবে ইউনুস বিতর্কের একটি রাজনৈতিক দিক আছে। রাজনৈতিক মাত্রা সম্পন্ন লেখাগুলো অতি মনোযোগ সহকারে আমি পড়ি এবং আরো বেশি মনোযোগ সহকারে এই সব বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি। কারণ, রাজনৈতিক গুণ সম্পন্ন ব্যক্তি ও লেখকগণ খুব কম ক্ষেত্রেই রাজনীতি নিরপেক্ষতা পছন্দ করেন।

যেমন, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ব্যক্তিকে মুসলমান সিঁধেল চোর থেকে শুরু করে খ্রিস্টান যাজক পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না, অশিক্ষিত কাজের ঝিগণ নাস্তিককে ঝাঁটা দিয়ে ও ক্ষমতাধর সেনাপতিগণ তাকে বন্দুক দিয়ে সোজা করতে এক পায়ে খাড়া, তেমনি রাজনীতি নিরপেক্ষ লেখদের আওয়ামী, বিএনপি, জাপা, জাগপা, জামাত, খেলাফত নির্বিশেষে শত্রু বলে ধরে নেন।

তারা মনে করেন, লেখক হোক আর ভাবুক হোক, যারা রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেন, তারা অপশক্তির দোষর। ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলে তাকে নাস্তিক বলে, কিন্তু প্রচলিত কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, কর্মী বা নেতা না হলে তাকে কি বলে, তা আমার জানা নেই।

তবে এরও একটা পরিভাষা হয়তো একদিন আবিষ্কৃত হবে। তখন রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ লেখকদের হয়তো সেই নামেই ডাকা হবে। কিন্তু ততোদিন পর্যন্ত এই সব যুক্তিবাদি লেখকদের কখনো পার্শ্ববর্তী দেশের দালাল, কখনো তারও চেয়ে একটু দূরের কোন দেশের দালাল, কিংবা আটলান্টিক পারের সেই স্বপ্নের দেশের চর বলে মনে করা হবে।

যাহোক, আমরা ইউনুসের কথা বলছিলাম। প্রফেসর ইউনুস ও তার প্রতিষ্ঠান এবং সেই সাথে তার ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেই যে কেবল আলোচিত হয়েছে তা সঠিক নয়। নোবেল পাওয়ার পূর্বেই ইউনুস একটার পর একটা পুরস্কার পেতে শুরু করেছিলেন। নোবেল পাওয়ার অনেক পূর্বেই ইউনুস একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তার আদর্শ নোবেলের উপর নির্ভরশীল নয়। এটা নিজ গুণেই আলোচিত, অনুসৃত ও বিস্তৃত। তবে তার নোবেল পাওয়ার পরে যা হয়েছে তা হল, বিদেশের মাটিতে তিনি আরো অনেক বেশি সমাদৃত, বিস্তৃত ও অনুসৃত হয়েছেন। আর দেশের মাটিতে তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচিত হয়েছেন, পুনর্মূল্যায়িত হয়েছেন এবং ক্ষুদ্রতার প্রতিযোগিতায় পতিত হয়েছেন।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর বলে ইউনুসকে প্রচার করা হলেও মার্কিনীদের আদর্শ, অর্থনীতি, রাজনীতি এমনকি সমরনীতির একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বি চীন প্রজাতন্ত্রেও শুনেছি তাকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। তিনি এমন এক মতবাদ বা ঋণদান কৌশল আবিষ্কার কিংবা প্রবর্তন করেছেন যা পূঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র দুই মতবাদের মাঝখানে অবলিলায় ঠাঁই করে নিয়েছে। চীনের সান-ইয়াৎ-সেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষুদ্র ঋণ ধারণাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন সেন্টার খুলতে যাচ্ছে। এর নাম দেওয়া হবে ইউনূস সেন্টার ফর মাইক্রোক্রেডিট অ্যান্ড সোশ্যাল বিজনেস। বলাবাহুল্য, ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা ১৯৯৪ সাল থেকে চীন গ্রহণ করেছে। সেখানে ১০টি প্রদেশে ১৭টি ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে গ্রামীণ ট্রাস্ট। (দৈনিক মানব জমিন, ১৫ আগস্ট, ২০১২) ।

চীনের ১১২ বছরের পুরাতন এই বিশ্ববিদ্যাল ও ১০টি প্রদেশের ইউনুসপ্রীতি আমাদের কি শিক্ষা দেয়? এখন আমরা কি বলব, ইউনুস একধারে সমাজতন্ত্র ও পূঁজিতন্ত্রের বরপুত্র। তিনি এতবেশি গুপ্তচর বৃত্তি আয়ত্ব করেছেন যে একই সাথে দুই বৈরি পক্ষের কাছ থেকে পাত্তি কামাচ্ছেন? তাই যদি হয়, তাহলে ইউনুস পৃথিবীর ইতিহাসের গোয়েন্দাবৃত্তির পরিভাষায় বিশ্বসেরা ডাবল এজেন্ট বা দ্বৈতচর ।

অনেকে ইউনুসকে পশ্চিমাদের কাছে দেবদূত বলে কটাক্ষ করছেন। কেউ কেউ বলছেন ইউনুস পশ্চিমা অর্থনীতির রক্তচোষা নীতিকে বেগবান করেছেন। তাই পাশ্চাত্যে তার এত কদর। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশ চীনও যখন ইউনুস ধারণাকে আপন করে নেয় তখন এই লোকটি যে শুধু পশ্চিমের কেউ নয়, তার কদর প্রতীচ্যে এবং পূঁজিতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয় জগতেই সমান সে বিষয়ে সন্দেহ করার কিছু থাকে না।

দারিদ্র্য একটি ব্যাপক ধারণা। এটাকে একক সংজ্ঞায় বাঁধা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষ দুবেলা খাবার পায় না। আমেরিকার দরিদ্র মানুষেরা হয়তো দুবেলা বিয়ার কিনে খেতে পায় না কিংবা রুশগণ ভোডকা কিনতে পারে না। আগেকার দিনের গ্রামের দরিদ্র মানুষগণ রুটি খেত, অনেকে খেত মিষ্টি আলু। বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্রগণ ভাত খায়, কারণ গমের দাম চালের দামের চেয়ে বেশি। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানকে আমল না দিলে, আমি বলব, ঢাকা শহরের রিকসা চালকগণ রীতিমত ধনী। কারণ ঢাকার রাস্তায় রিকসা চালায়, এমন কম সংখ্যক পেডলারের হাতে আমি মোবাইল সেট দেখি নাই।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে গ্রাম-বাংলার ধনী লোকটির প্রাচুর্য্য মাপার এক সময়ের মাপকাঠি ছিল, তার বাড়িতে একটি সিটিজেন রেডিও সেট আছে কিনা। এর পরে মাপা হত তার বাড়িতে টেলিভিশন আছে কিনা। গ্রামে যাদের বাড়িতে রংগিন টেলিভিশন আছে, তাদের ধনী বলে জয়ধ্বনি দেওয়া হয় এখন।

আমার উপরিউল্লিখিত উদাহরণগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের একটি ক্রমধারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। শহরের কথা বলব না। গ্রামের খুব কম সংখ্যক বাচ্চাই আছে যারা পায়ে স্যান্ডেল না দিয়ে স্কুলে যায়। ( সব খানে একই অবস্থা নাও থাকতে পারে)। আমাদের গ্রামের মানুষকে আগে একটি মাত্র জামার অধিকারী হতে দেখেছিলাম। তাদের পায়ে স্যান্ডেল উঠত শুধু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে পা ধোয়ার সময়। একটি মাত্র গামছা ঘাড়ে নিয়ে তারা মাতব্বরি পর্যন্ত করে বেড়াত। বর্তমানে একটি ফিটফাট জামা না থাকলে মোড়লগিরি হয় না। মোড়লরা সবাই ধনী নয়। অন্তত আমাদের গ্রামের মোড়লরা নয়।

গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণে ইউনুসের অবদান কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে তার গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলোর মনে দারিদ্র্যকে ছুড়ে ফেলে দেবার প্রত্যাশা তৈরিতে বড় অবদান রেখেছে। গ্রামের মহাজন আর ফড়িয়াদের অমানবিক আচরণ থেকে বাঁচিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষগুলোকে দারিদ্র্যের ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এটা হয়তো তর্কের খাতিরে অনেকেই অস্বীকার করবেন। কিন্তু এটা সত্য। যারা আগে মহাজনদের কাছে গিয়ে সর্বস্ব খোয়াত, তারা গ্রামীণ ব্যাংকের দারস্থ হয়ে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য অর্জন করেছে। আমি তো মনে করি ইউনুসের কৃতিত্ব মূল্যায়নের জন্য এই একটি তথ্যই যথেষ্ঠ। আবার বলছি, ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা সম্পূর্ণ পূঁজিহীন মানুষকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ শোধ করার সামর্থ্য তৈরিতে সহায়তা করেছে। এক সময় যাদের কিছুই ছিল না, এখন তাদের অন্তত একটি জিনিস আছে আর তা হল নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের আশা।

ইউনুস বিষয়ক নিবন্ধের অনেক লেখক আমাকে এবং আরো কয়েকজনকে তাদের লেখায় মন্তব্য করতে নিষেধ করেছেন। মন্তব্য হয় কোন ধারণা বা আদর্শকে সমর্থন করে, নয়তো তার বিরোধীতা করে। সমর্থকগণ যুক্তি দিবেন পক্ষে এবং বিরোধীরা যুক্তি দিবেন তা খণ্ডন করার জন্য বিপক্ষে । যুক্তি প্রদর্শন ও খণ্ডনের মধ্য দিয়েই লেখার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়। কিন্তু যখন একদম মন্তব্য করতে নিষেধ করা হয়, তখন বুঝতে হবে লেখক বড়ই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। কোন লেখার সকল মন্তব্যের উত্তর লেখককে দিতেই হবে, এমন মাথার কিড়া কি ব্লগটিমগণ এখানে দিয়েছেন? তা হলে এই অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন কেন? আমি ব্লগে যা ছেড়ে দিলাম, তাই যদি সকল পাঠক মেনে নিবেন, তাহলে ব্লগে একাধিক লেখক বা বহুসংখ্যক পাঠক থাকার দরকার নেই।

পূর্বেই বলেছি, আমার চিন্তার ক্ষেত্র আর যুক্তি প্রদর্শনের পাতা এটা নয়। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই। অনার্স পর্যায়ে সাবসিডিয়ারী হিসেবে মাত্র ৩০০ নম্বরের অর্থনীতি পড়েছিলাম। এতে এবিসি শেখার কথা। কিন্তু গণিতের ছাত্রদের অর্থনীতির সাবসিডিয়ারী সেই সময় ছিল সময় বাঁচিয়ে গণিতের মূল বিষয়গুলোতে তা বিনিয়োগ করার একটি উত্তম কৌশল। আমিও এই কৌশলটি গ্রহণ করেছিলাম। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষে বসে সনামধন্য শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনলে কোন কিছুই বৃথা যায় না। পরবর্তীতে বিসিএস পরীক্ষার জন্য কিছু কিছু পরিভাষার পাঠ নিতে হয়েছিল। এই সময় অর্থনীতি বিষয়ে দুইটি ধারণা ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমাদের পড়তে হত। এদের একটি হল ইসলামী ব্যাংক অন্যটি গ্রামীণ ব্যাংক। অতীতের বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রগুলো ঘাঁটলে দেখবেন এই দুইটি বিষয়ের উপর অনেকবার প্রশ্ন এসেছিল। তাই, ইউনুস কতটা অর্থনীতিবিদ আর কতটা শান্তি উৎপাদনকারী তা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।

ক্ষুদ্র ঋণের ঋণভার কিভাবে নোবেল কমিটিকে শান্তির জন্য শান্ত করেছিল, তা অবশ্য তারাই বলতে পারবেন। তবে দরিদ্রগণ অশান্ত। হয়তো ইউনুসের ক্ষুদ্রঋণ এদের কিছুটা শান্তি দিতে পেরেছিল বলে নোবেল কমিটি বিশ্বাস করেছে। আর আমার ব্যাখ্যাই বা নোবেল কমিটি নেবেন কেন? তারা কি কোন প্রকার যুক্তি প্রদর্শন না করেই ইউনুসকে নোবেল দিয়েছেন? নোবেল কমিটির মতো ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংক অর্থনীতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার জন্যই এই শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। যারা পুরস্কার দেয়, পুরস্কারের শর্ত নির্ধারণ করেন তারাই। তো যুদ্ধ থামানোর প্রচেষ্টার পরিবর্তে তারা যদি নিরন্তন দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধরত কিছু মানুষের মনে উন্নয়নের আশা জাগানোর প্রচেষ্টার জন্য ইউনুসকে শান্তি পদক দেন তাহলে আমাদের কি?

আমি বিশ্বাস করি ইউনুসকে ছোট করার প্রচেষ্টা প্রকারান্তরে তাকে বড়ই করে। যারা ভাবতে পছন্দ করেন, ইউনুসকে আমাদের মাঝে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের চর হিসেবে আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু নেওয়ার জন্য। তাদের ভাবনা বড়ই অদ্ভূত; অনুমান বড়ই অনুগ্রহের। ইউনুসকে ব্যবহার করে আমাদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র কি নেবে? আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, আমাদের গোপন পরিকল্পনা? অধিকন্তু, ইউনুস কি কোন গোপন বা প্রভাবশালী পোর্টফলিও ধারণ করেন যে আমাদের সহায়-সম্পদ ব গোপন প্লান-পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দিয়ে দিবে? আর যদি এটাই ওদের ইপ্সিত হয়ে থাকে তাহলে ইউনুসের মতো ক্ষমতাহীনকে আঁকড়ে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র?

বিষয়টি হচ্ছে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন ইউনুসের ব্যক্তিগত বন্ধু। বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ক্লিনটনের ভাব ধারায়। অধিকন্তু, আমাদের দেশের মতো এক রাষ্ট্রপতির আদর্শ অন্যজনের কাছে সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য নয়। আর এটাও সঠিক যে ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা যুক্তরাষ্ট্রও গ্রহণ করেছে। মক্কার মান-অপমান সব মুসলমান ভাগাভাগি করে, সেইরূপ গ্রামীন ব্যাংক ও ইউনুসের বিপদে ক্ষুদ্র ঋণের ধ্বজাধারীগণও নিজেদের বিপদ বলে মনে করাই স্বাভাবিক।

কোন এক সময় সাবমেরিন কেবলের সাথে যুক্ত হলে বাংলাদেশের সবকিছু অন্যত্র চলে যাবে বলে তৎকালীন ক্ষমতাসীনগণ বিশ্বাস করে আমাদের তথ্যপ্রযু্ক্তির মহাসড়ক থেকে দূরে রেখেছিলেন। পরে শতশত কোটি টাকা ব্যয়ে আমরা সেই সড়কে কোন রকম ঠাঁই করে নিয়েছি। যারা আমাদের স্বকীয়তা হারানোর ভয়ে অন্যদের থেকে দুয়ার বন্ধ করে থাকার পরামর্শ দেন তাদের আর যাই বলি সুবিবেচক বলতে পারি না। ইউনুস যদি পাশ্চাত্যের বন্ধু হয়, তাহলে সেই বন্ধুত্বকে ভয় না করে তা ব্যবহার করে সম্মৃদ্ধি অর্জনই মঙ্গল জনক।

ইতোপূর্বে একটি লেখার মন্তব্যে বলেছি এখনো বলছি, বাংগালীর সৌর্য্য আছে, বীর্জ আছে; কিন্তু আত্মসম্মান বোধ নাই। যদি থেকেও থাকে, তাহলে তা হবে অতি নগন্য। বাংগালী অন্যদের পূজো করে, নিজেদের অর্ঘ্য দিতে জানে না। অতীশ দীপঙ্কর এক সময় বাংগালীর কেউ ছিল না, কিছুই ছিল না। আর আজ অতীশের দেহভস্মের জন্য বাংগালী উন্মুখ হয়ে থাকে তিব্বতের দিকে। বাংগালীরা জীবনের দাম দেয় না, মরণ এদের কাছে অতি প্রিয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের অধিকাংশগুলোর প্রাপকগণ তা গ্রহণের জন্য ধরাধামে থাকেন না। বাংগালীর এই মানসিকতা সম্ভবত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও ছেড়ে কথা কয় নাই। তিনিও লিখেছিলেন,

মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমন ।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান ।।

সতিই মৃত না হলে বাঙালিরা স্বজাতীর কোন ব্যক্তিকে অমৃত দান করতে বড়ই কুষ্ঠিত বোধ করে। ইউনুসকে নিয়ে আজ যা হচেছ, তা শুধু এই সত্যটিই প্রকাশ করে না; এটা ইতিহাসের পূনরাবৃত্তিও ঘটাচ্ছে। সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ আর শান্তির ইউনুস উভয়েই হত দরিদ্রদের ঋণ পাবার অধিকারের কথা বলেন— একজন কৃষকদের অন্যজন কৃষক মজুর সবাইকে।

প্রিয় পাঠকগণ, ইউনুস সম্পর্কে আমার এটাই প্রথম ও শেষ পোস্ট। এই সম্পর্কে আর অগ্রসর হওয়া আমার জন্য সম্ভব নয়। কারণ, দ্বিবিধঃ এর একটি রাজনৈতিক দিক আছে। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে যা সচেতনভাবেই আমি পরিহার করতে চাই। অন্যদিকে আমার নিজস্ব ক্ষেত্রের মধ্যে এটা পড়ে না। এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত পড়তে ও লিখতে হলে আমার পুলিশিং বিষয়ের জন্য নির্ধারিত সময়ের ঘাটতি পড়বে।

আমার পোস্টে মন্তব্য করুন। তবে মন্তব্যের উত্তর দিতে পারব না। উত্তর দিতে না পারার কারণগুলোও একই। প্রিয় পাঠকগণ, ক্ষমো হে, দীনতা।