ফ্রাংক সার্পিকোঃ দুর্নীতি-বিরোধী এক নির্মোহ পুলিশের প্রতিকৃতি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 31 August 2012, 01:22 PM
Updated : 31 August 2012, 01:22 PM

পুলিশের ইতিহাস যদি সভ্যতারই ইতিহাস হয়, তাহলে পুলিশের দুর্নীতির ইতিহাসও সভ্যতার সমান বয়সী। কারণ, সমাজে যেদিন থেকে পুলিশ সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই দিন থেকে দুর্নীতিও তার পিছু নিয়েছিল। তাই পুলিশের ইতিহাস অধ্যয়ন করা মানেই পুলিশের বিচ্যুতি, দুর্নীতি এবং অসদাচরণ অধ্যয়ন করা। তবে মজার ব্যাপার হল পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাজ বা রাষ্ট্র মাঝে মধ্যে সোচ্চার হলেও পুলিশ বিভাগের লোকজন কিন্তু এই ব্যাপারে বরাবরই নিশ্চুপ। যদি দেখা যায় এই চিরায়ত পুলিশি জুগুপ্সা ও পারস্পরিক লাভবান হওয়ার জন্য পরিকল্পিত নিরবতা খোদ কোন এক পুলিশ অফিসারই ভঙ্গ করেন, তিনি হবেন পুলিশের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক পুলিশের নিম্ন পদস্থ কর্মচারী ফ্রাংক সার্পিকো এমনি একজন ব্যতিক্রমী মানুষ যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করার ঝুঁকি নিয়েও সততার দৃঢ়তায় তার নিজ পুলিশ বিভাগের সর্বব্যাপী দুর্নীতির খবর জনসম্মুখে সবিস্তারে প্রকাশ করে সারা পৃথিবীতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

ফ্রাংক সার্পিকো ১৯৩৬ সালের ১৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রাজ্যের ব্রুকলিনে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ভিনসেনজো ও মা মারিয়া গিওয়াভানা যুক্তরাষ্ট্রে ইটালীয়ান অভিবাসী। ১৮ বছর বয়সে সার্পিকো মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাকে দুই বছরের জন্য পাঠানো হয় কোরিয়ায়। সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করে সার্পিকো ব্রুকলিন কলেজে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য এই সময় তিনি বেসরকারী তদন্তকারী ও আইনজীবী হিসেবে খণ্ডকালীন কর্মেও নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫৯ সালে পড়াশোনা শেষ করে সার্পিকো নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগে শিক্ষানবিস পেট্রোলম্যান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে ফ্রাংক সার্পিকোকে ব্রুকলিনের সাদা পোষাকধারী গোয়েন্দা ইউনিটে বদলী করা হয়। এই ইউনিট অবৈধ বেশ্যাবৃত্তি, অবৈধ মাদকদ্রব্য, জুয়া খেলাসহ অন্যান্য অভিযোগহীন সামাজিক অপরাধগুলোর বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত অভিযান পরিচালনা করত। কিন্তু সার্পিকো এই নতুন ইউনিটে যোগ দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারলেন নিউ ইয়র্ক পুলিশের সাদা পোশাকধারী ইউনিটগুলো মদ-জুয়া-বেশ্যাবৃত্তি রোধ করা নয়, বরং মাসিক বখরার বিনিময়ে এই সব অপরাধকে টিকিয়ে রাখে।

নতুন বিভাগে যোগদানের প্রথম মাসেই এক পুরাতন সহকর্মী নগদ ৩০০ ডলারের একটি খাম সার্পিকোর হাতে ধরিয়ে দেন। সার্পিকো এই অর্থ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাকে বলা হয়, এটা হল স্থানীয় জুয়াড়ুদের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে আদায়কৃত তোলার বখরা। বিষয়টি সার্পিকোর কাছে অনেকটাই অস্বাভাবিক ঠেকে। খামটি নিয়ে সার্পিকো তার তত্ত্বাধানকারী ক্যাপ্টেন ফিলিপ ফোরানের কাছে গেলেন। ফোরান ছিলেন এই বিভাগের তদন্ত স্কোয়াডের প্রধান। সার্পিকো বখরা না নিয়ে বরং এর বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেনের কাছে অভিযোগ করলেন। কিন্তু সার্পিকো জানেন না এই ইউনিটের ঊর্ধ্বতন-অধঃস্তন সবাই জুয়াড়ুদের চাঁদায় লালিত, পালিত। যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হয়ে ক্যাপ্টেন ফোরান সার্পিকোকে বললেন, তোমার সামনে দুইটি পথ খোলা আছে। হয় কুলুপ এঁটে মুখ বন্ধ করে থাক, অন্যথায় এখান থেকে বিদায় হও। সার্পিকো তার সার্জেন্টের কাছে ফিরে এসে জুয়াড়ুদের থেকে নেওয়া বখরার ৩০০ ডলারের খামটি তার মুখের উপর ছুড়ে দিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে উপরে কোথাও আর অভিযোগ করলেন না।

১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সার্পিকোকে ব্রুকলিন থেকে ব্রোনক্স বিভাগে বদলী করা হল। ব্রুনক্সও ছিল সাদা পোষাকের ইউনিট। এই নতুন বিভাগে দায়িত্ব শুরুর প্রথম মাসেই সার্পিকোকে ঘুষের টাকার মাসিক বখরা নিতে সাধাসাধি করা হয়। সার্পিকো জানতে পারলেন, তার নতুন বিভাগ পুরাতন বিভাগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু তিনি কিছুতেই দুর্নীতির সাথে জড়িত হতে চাইলেন না। বরং তা প্রতিরোধের জন্য প্রচেষ্টা অব্যহত রাখলেন। এই নিয়ে তিনি নিউ ইয়র্ক পুলিশের প্রথম ডেপুটি কমিশনার জন ওয়ালস এর নিকট বিষয়টি পর পর তিনবার উত্থাপন করেন। নিউ ইয়র্ক পুলিশের অভ্যন্তরে তার অভিজ্ঞতায় দেখা দুর্নীতির গভিরতা ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ডেপুটি কমিশনারকে তিনি বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে নিউ ইয়র্ক পুলিশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিটিও কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করলেন না।

এর পর সার্পিকো গোপনে নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র জন লিন্ডসের কাছে বিষয়টি উত্থাপনের প্রচেষ্টা চালান। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য স্থানীয় পুলিশ বিভাগগুলোর মতো নিউ ইয়র্ক পুলিশ মেয়রের অধীনে। নির্বাচিত মেয়রই পুলিশ প্রধানকে নিয়োগ দেন। যাহোক, সার্পিকো বিষয়টি মেয়রের কানে দেওয়ার জন্য মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী জাই ক্রিগজেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন । কিন্তু ক্রিগজেল সার্পিকোকে জানালেন যে এ সম্পর্কে কিছুই করা যাবে না। কেননা পুলিশকে অসন্তুষ্ট করার মতো কোন কাজ এই মুহূর্তে মেয়র মহোদয় করার ঝুঁকি নিবেন না। বিষয়টি সার্পিকো তদন্তের দায়িত্বে থাকা কমিশনার আরন্ড ফ্রেইম্যানকেও অবহিত করলেন। কিন্তু তিনিও কিছু করতে পারলেন না।

সর্বশেষে সার্পিকো তার নিজ বিভাগের প্রধানের কাছে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। এই সময় তার সাথে আরো দু'এক জন সহকর্মী যোগ দিলেন যাদের মধ্যে ডেভিড ডার্ক ছিলেন উল্লেখযোগ্য। সার্পিকোর প্রচেষ্টা এই বার কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখল। তার অভিযোগ ও তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য একটি গ্রান্ড জুরি গঠন করা হল। এই জুরির তদন্তে তার আটজন সহকর্মীকে অভিযুক্ত করা হল। সার্পিকোকে বোঝানোর চেষ্টা চলল যে নিউ ইয়র্ক পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির আসলে কোন প্রতিকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু সার্পিকো আরো কয়েকজন সমমনা সহকর্মীর সহায়তায় বিষয়টি নিয়ে এখানেই থেমে থাকতে চাইলেন না।

১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সার্পিকো তার অন্য তিনজন সহকর্মীসহ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সম্পাদক ডেভিড বার্নহামের নিকট গেলেন। তারা পত্রিকার সম্পাদকে নিউ ইয়র্ক পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি সম্পর্কে ভয়ংকর সব তথ্য প্রমাণসহ হাজির করলেন। দুর্নীতির খবর নিউ ইয়র্ক টাইমসে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকল। বিষয়টি সারা শহরে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হল। তখন মেয়র লিন্ডসে এর টনক নড়ল। তিনি গোটা নিউ ইয়র্ক পুলিশের দুর্নীতি তদন্ত করে তা দূর করার সুপারিস প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন নিয়োগ করলেন। এটা ছিল নিউ ইয়র্ক পুলিশকে নিয়ে পঞ্চম কমিশন/কমিটি যার নাম ছিল ন্যাপ কমিশন।

ন্যাপ কমিশন তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে দুর্নীতিবাজ সহকর্মীদের চক্ষুশূল হলেন সার্পিকো। নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের সিনিয়র, জুনিয়র ও সম পর্যায়ের সহকর্মীদের সবাই তাকে এক প্রকার অচ্ছুত মনে করলেন। সবাই তাকে শুধু বয়কটেই করল না, তারা নানা ভাবে সার্পিকোকে হেস্তনেস্ত করা শুরু করলেন। শুধু আইনগত বা বিভাগীয়ভাবেই নয়, বরং তাকে শারীরিকভাবেও বিপদে ফেলার চেষ্টা চলতে থাকল।

১৯৭১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী। উত্তর ব্রুকলিনের চারজন অফিসার একটি বড় ধরণের মাদক লেনদেনের গোপন খবর পায়। রাত পৌনে এগারটায় তারা এই জন্য একটি সশস্ত্র অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করে। ব্রুকলিনের ইউলিমাসবার্গ সেকশনের ৭৭৮/ ড্রিগ এভিনিউতে এই মাদক বিরোধী অভিযানে অংশ নেয় সার্পিকো। গ্যারি আর্থার ও আর্থার সিজার নামের দুই অফিসার বাড়ির বাইরে গাড়িতে অবস্থান করে। পল হেলি এপার্টমেন্টের সামনে অবস্থান নেয়। ফ্রাংক সার্পিকো গাড়ি থেকে বের হয়ে এপার্টমেন্টের ছাদ দিয়ে দরোজার কাছে উপস্থিত হয়। তার কাজ ছিল রেকি করে গূঢ় তথ্য বের করা। এই সময় সার্পিকো হিরোইন ব্যবসায়ীদের কথা বার্তা শুনতে পায়। তারা সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছিল। এর পর সে দুই যুবককে অনুসরণ করে। এই মুহূর্তে পুলিশ দুই যুবককে চ্যালেঞ্জ করে বসে। তারা তাদের উপর ঝাঁপিড়ে পড়ে। এদের একজনের কাছে দুই ব্যাগ হিরোইন পাওয় যায়।

অফিসার হেলি গাড়িতে বসে দুই যুবককে আটক করে রাখে। এর পর অফিসার রোটম্যান অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে মাদক ক্রেতার ছদ্মবেশে এপার্টমেন্টের দরোজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয়। তিনজন অফিসার এটার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলায় সিড়ির কাছে চলে যায়। সার্পিকো তার এক হাত জ্যাকেটের পকেটে পিস্তলের উপর রেখে অন্য হাতে ঘরের দরোজায় আঘাত করে। ঘরের দরোজা সামান্য খুলে যায়। এতে দরোজা যতটুকু ফাঁক হয় তাতে সার্পিকো ভিতরে ঢুকতে পারত। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীরা ভিতর থেকে দরোজা বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করে পাল্টা আক্রামণ শুরু করে।

সার্পিকো তার সহকর্মীদের চিৎকার করে ডাকতে থাকে। কিন্তু তার ডাকে কেউ সাড়া দেয় না। সুযোগ বুঝে তারা সটকে পড়ে।
মাদক ব্যবসায়ীরা সার্পিকোকে খুব কাছে থেকে গুলি করে। গুলি তার চোখের নিচে গালের চোয়ালের উপরে লাগে। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে মেঝের উপর পড়ে যান। তার শরীর থেকে প্রচণ্ড বেগে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। অন্য তিন সহকর্মী তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে চলে যায়। এমনকি তারা বিষয়টি জরুরী বিভাগেও জানায়নি। সার্পিকোকে নিকটবর্তী এক বৃদ্ধ লোক বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি জরুরী মেডিকেল সার্ভিসে খবর দেন। এ্যামবুলেন্স না আসা পর্যন্ত তিনি আহত সার্পিকোর শ্রুশ্রূষা করতে থাকেন।

কিন্তু ডাক্তারী এ্যামবুলেন্স আসার আগেই সেখানে একটি পুলিশের টহলগাড়ি উপস্থিত হয়। তারা গুলিবিদ্ধ এই ব্যক্তিকে গ্রিনপয়েন্ট হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা জানত না যে এই গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিটি তাদেরই সহকর্মী ফ্রাংক সার্পিকো। গুলির আঘাতে সার্পিকোর বাম কান বধির হয়ে যায়। তাকে দেখার জন্য নিউ ইয়র্ক মেয়র জন লিনডসে ও পুলিশ কমিশনার হাপাতালে যায়। ক্রমে সার্পিকো সেরে ওঠেন। কিন্তু তার সহকর্মীগণ হাসপাতালে যখন তখন গিয়ে তাকে যতদূর সম্ভব বিরক্ত করে।

এই ঘটনাটি নিউ ইয়র্কবাসীর কাছে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। ধারণা করা হয়, নিউ ইয়র্ক পুলিশের দুর্নীতিবাজ চক্রটি ন্যাপ কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দানের পূর্বেই সার্পিকোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাই কমিশনের কাছে সাক্ষ্যদানের নির্ধারিত তারিখের কয়েক মাস আগেই এই মাদক অভিযানের ঘটনা সাজানো হয়। এখানে সার্পিকোকে তার অন্য তিন সহকর্মী পরিকল্পিতভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের গুলির মুখে ঠেলে দেয়। যখন তারা নিশ্চিত হয় যে সার্পিকো একাকী সশস্ত্র মাদক ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়েছে এবং তার মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রচুর, তখন তারা সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে। আর তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তারা তাকে ঘটনাস্থলে রেখেই অভিযান এলাকা পরিত্যাগ করে। চার জনের একটি অভিযাত্রী দলের একজন সদস্যকে রেখেই অফিসে চলে যায় এবং এই খবর পুলিশ বিভাগের কাছে রীতিমত গোপন রাখে। একজন বেসরকারি ব্যক্তির আন্তরিক সহায়তা না পেলে সার্পিকোর বাঁচার আশা ছিল না।

সাধারণত কোন অভিযানে গোলাগুলির ঘটনা ঘটলে তা বেতারে পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে জানানো হয়। কেউ আহত হলে তাকে হাসপাতারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সার্পিকোকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বলেই তার সহকর্মীগণ এসবের কিছুই করেননি। কেননা, ফ্রাংক সার্পিকো নিউ ইয়র্ক পুলিশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে তার সহকর্র্মীদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তারা চাইছিল এই বেয়াড়া পুলিশরূপী বিশ্বাসঘাতকটি যে কোন প্রকারেই হোক নিউ ইয়র্ক পুলিশ থেকে বিদায় হোক।

১০ মে ১৯৭১ তারিখে সার্পিকো বিভাগীয় বিচারে তার সহকর্মী জনৈক লেফটেন্যান্ট এর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন ১৪ মে তারিখে তাকে পুলিশ কমিশনারের স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয় এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা (ডিটেকটিভ) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সার্পিকো ন্যাপ কমিশনের সামনে প্রথমবার ১৯৭১ সালের অক্টোরব মাসে ও পরের বার অক্টোবর মাসে সাক্ষ্য প্রদান করেন। তার সাক্ষ্যের কিয়দংশ এরূপ ছিলঃ

দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার ফলে আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাতে গত পাঁচ বছর ধরে আমি যে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি; যে হতাশা ও উদ্বেগের মধ্যে কালাতিপাত করেছি, আমার আজকের এই সাক্ষ্যদানের মধ্য দিয়ে, আমি আশা করব, ভবিষ্যতে আর কোন পুলিশ অফিসারকে আর এমনটি সইতে হবে না। তারা আমাকে এটা দারুণভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে আমার কর্মকাণ্ড তাদেরকে দারুণ এক অনাকাঙ্খিত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সমস্যা হল, এখনো সেরকম পরিবেশ তৈরি হয়নি যেখানে কোন সৎ পুলিশ অফিসার তার সহকর্মীদের ভর্ৎসনা ও প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। যদি কোন পুলিশ বিভাগের উচ্চতম পর্যায় থেকে দুর্নীতিকে অন্তত প্রশ্রয় দেওয়া না হয়, তা হলে সেই পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি থাকতে পারে না। তাই এই শুনানির মধ্য দিয়ে যে ফল অর্জিত হবে তা হল, পুলিশ অফিসারদের মনে এই ধারণার জন্ম হবে যে আমাদের পুলিশ বিভাগ পরিবর্তিত হবে। আর এটা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশের দুর্নীতির বিষয়গুলোর সুরাহা করার নিমিত্তে এই কমিশনের মতো একটি স্থায়ী তদন্তকারী সংগঠন থাকা জরুরী।

ন্যাপ কমিশন ১৯৭২ সালে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে সার্পিকো নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ খেতাব, 'মেডেল অব অনার' গ্রহণ করেন এবং তার পরের মাসেই অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৫ জুন তারিখে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

ফ্রাংক সার্পিকো নিউ ইয়র্ক পুলিশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাকী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তা যেমন ছিল তার নিজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা এমনকি শহরের মেয়রের জন্যও বিব্রতকর। তার সততা, একগ্রচিত্ততা ও অপরিণামদর্শী ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা পৃথিবীর পুলিশ প্রশাসনের ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। সার্পিকোর দুর্নীতিবিরোধী একক কর্মকাণ্ড সেই সময় সারা যুক্তরাষ্ট্রে এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে সার্পিকোর দুর্নীতি বিরোধী সংগ্রাম নিয়ে রচিত জীবনী ''সার্পিকোঃ নির্মোহ একজন পুলিশ অফিসারের চিরায়ত উপাখ্যান (Serpico: The Classic Story of the Cop Who Couldn't Be Bought) বইটি সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায় স্থান করে নেয় এবং প্রায় ৩০ লাখ কপি বিক্রয় হয়। এর পর ১৯৭৩ সালে এই বইয়ের কাহিনী নিয়ে স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক সিডনি লুমে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি তৈরি করেন যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন অস্কার বিজয়ী বিখ্যাত হলিউড নায়ক আল পাচিনো। এ ছাড়াও সার্পিকোর কাহিনী নিয়ে অনেক টিভি সিরিয়ালও তৈরি হয়েছে।

সার্পিকো মনে করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুবিচারের জন্য সংগ্রাম করা কোন ক্রমেই একটি সহজ কাজ নয়। এটা কখনো সহজ ছিল না এবং ভবিষ্যতেও সহজ হবে না। দুর্নীতি নাগরিক জীবনের উপর বিশেষ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত সহকর্র্মীগণ প্রকাশ্যে বিরোধীতা করলেও গোপনে গোপনে তারা দুর্নীতি বিরোধীদের সাহসকে সমীহ করে; সততাকে ঈর্ষা করে।

সমাজের অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতো বাংলাদেশ পুলিশও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির দোষে দুষ্ট। বঙ্গভারতে পুলিশ চালুর আদিকাল থেকেই দুর্নীতি এর মজ্জায় স্থায়ী আসন পেতে বসেছে। ঔপনিবেশিক আমলে লালিত-পালিত সনাতনী ধারার বঙ্গীয় পুলিশ বর্তমানে স্বাধীন দেশে দায়িত্ব পালন করলেও এই সংগঠনের দুর্নীতির বিস্তৃতি কমেনি বরং অনেক ক্ষেত্রে তা বেড়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ পুলিশেরও একটি জুগুপ্সার সংস্কৃতি রয়েছে। বাইরে থেকে সাধারণ মানুষ যা জানে বা বুঝতে পারে পুলিশের ভিতরে তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ ও মাত্রায় দুর্নীতি রয়েছে। কিন্তু ফ্রাংক সার্পিকোর মতো কোন ব্যতীক্রমী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ পুলিশে এখনও জন্ম নেয়নি। বাংলাদেশের জনগণ কি পুলিশের ভিতরে অন্তত একজন সার্পিকোর জন্ম প্রত্যাশা করতে পারে না?

রচনা সূত্রঃ
1. http://veracitystew.com/2011/04/14/frank-serpico-celebrating-honor-and-courage/
2. http://en.wikipedia.org/wiki/Serpico
3. Forces of Deviance – Understanding the Dark Side of Policing Second Edition by Victor D. Kappeler, et all/ Waveland Press, Inc/ ISBN- 978-0-88133-983-3
4. Maas, Peter; Serpico, Frank (2005), Serpico: The Classic Story of the Cop Who Couldn't Be Bought, New York: Perennial, ISBN 978-0-06-073818-1