সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত ও ডিএনএ প্রযুক্তি বিতর্ক

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 17 Sept 2012, 04:49 PM
Updated : 17 Sept 2012, 04:49 PM

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত পুলিশি তদন্ত হল, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড। গত ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২ তারিখে এই সাংবাদিক দম্পতি তাদের পশ্চিম রাজা বাজারের ভাড়া বাসায় অজ্ঞাত অপরাধীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। মামলাটি প্রথম তদন্ত শুরু করে তেজগাঁ থানা পুলিশ। পরে এর তদন্তভার অর্পণ করা হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপর। সব শেষে, আদালতের নির্দেশে, এর তদন্তভার অর্পিত হয় র‌্যাব এর উপর। সংগত কারণেই পুলিশ মামলাটি তদন্তের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু আপাতত সাধারণ মনে হলেও এই জটিল মামলাটির রহস্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তকারীগণ জনপ্রত্যাশা পূরণের মতো তড়িৎ সাফল্য প্রদর্শন করতে পারে নাই। বর্তমানে র‌্যাবের তদন্তের অগ্রগতি নিয়েও প্রচার মাধ্যমে ইতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে না।

র‌্যাবের সাম্প্রতিক উদ্যোগের মধ্যে প্রধানতম হল সাগর-রুনি হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘটন তথা অপরাধী শনাক্ত করতে ডিএনএ প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়া। র‌্যাব ইতোমধ্যে সাগর-রুনির শরীরের ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের দু্‌ইটি গবেষণাগারে প্রেরণ করে সেই নমুনার সাথে একাধিক ভিন্ন ব্যক্তির ( ফরেন বডি) ডিএনএ নমুনার অস্তিত্ব পেয়েছে বলে প্রচার মাধ্যমগুলোকে জানিয়েছে [1]। সম্প্রতি তারা সন্দিগ্ধ কয়েকজন চোরের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে তার প্রোফাইলিং করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একই গবেষণাগারে পাঠিয়েছে বলে প্রত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। [2]

সাগর-রুনি হত্যা মামলাটি তদন্তের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ নানাবিধ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়। ঘটনাস্থলসহ অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় প্রথম থেকেই তদন্তকারীগণ এই ঘটনার জন্য দায়ী সন্দিগ্ধদের তালিকার শীর্ষে রেখেছিলেন কতিপয় পেশাদার চোরকে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২ সংখ্যার খবর থেকে জানা যায়, গ্রিলকাটা চোর মফিজুল, এনামুল, হালিম, ফজলুল ও হানিফকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের তদন্তকারীগণ ঘটনার পরপরই আটক করেছিল। ডিএমপি এর গোয়েন্দারা শুধু সন্দেহ ও জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। সন্দেহের সপক্ষে তারা পর্যাপ্ত আলামত না পেলেও বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন।

এর মধ্যে অন্যতম ছিল চোরগণ সাগর-রুনির ফ্ল্যাটে টয়লেটের পাইপ বেয়ে উপরে উঠে কর্তিত গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে কিনা, তার বাস্তবতা প্রতিপাদন করা। বলা বাহুল্য, তাদের এই পরীক্ষণ সফল হয়েছিল। চোরগণ মাত্র ১৫ মিনিটে বাথরুমের বাইরের পাইপ বেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছিতে পেরেছিল। পুলিশ তাদের এই পরীক্ষণকর্মটি রীতিমত ভিডিও করেও রেখেছিল [3]। তবে এটা ছিল একটি যুক্তির প্রতিপাদন মাত্র । এই ঘটনার মাধ্যমে আদালতের মনে বিশ্বাস জন্মান যেত যে এই গ্রিল কাটা পেশাদার চোরদের সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকা সম্ভব। টয়লেটের পাইপ বেয়ে তরতর করে উপরে উঠে জানালার গ্রিল কেটে সাগর-রুনির শয়ন কক্ষে ঢুকে হত্যা ও লুন্ঠনের মতো সহিংস অপরাধ সংঘটিত করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই তারা একই পথে পালাতে পারে। কিন্তু এই যুক্তির সপক্ষে গোয়েন্দা পুলিশ কোন বস্তুগত আলামত উদ্ধার করতে পারেনি। যেমন, তারা সাগর-রুনির খোয়া যাওয়া ল্যাপটপটি যদি চোরদের কাছ থেকে বা অন্য কোনভাবে উদ্ধার করতে পারতেন, তাহলে চোরদের সন্দেহকরণ বিশ্বাসযোগ্য বা আদালতে উপস্থাপনযোগ্য হত।

তবে যদি চোরগণ বিশ্বাসযোগ্য সময়ে বা আচরণে টয়লেটের পাইপ বেয়ে পৌঁছেই থাকে, তাহলে তাদের অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার না করার কারণ কী? অভিযুক্তের পক্ষ থেকে দোষ স্বীকারোক্তি সব সময় পাওয়া যাবে এমন কোন কথা নেই। অপরাধ বিজ্ঞান বলে, এই জাতীয় চোর হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সাধারণত গোপন রাখতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা এটা স্বীকার করে। যেমন, ঢাকার বক্ষব্যধী ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার নারায়ন চন্দ্র নিতাই এর হত্যার সাথে জড়িত গ্রিলকাটা চোরগণ প্রায় সবাই তাদের অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করে আদালতে নিজেদের ও তাদের সহযোগিদের জড়িত করে স্বীকারোক্তি দিয়েছে [4]।

কিন্তু সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম রয়েছে। দাগী ডাকাত বা বিশেষ আদর্শে উদ্বুদ্ধ গোপন সংগঠনের নেতাকর্মীদের মতোই অনেক ছোট খাট ছিঁচকে চোর রয়েছে যারা পুলিশের সকল মাত্রার জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও কোন অপরাধের দায়ই স্বীকার করে না। আমাদের সমাজে এই জাতীয় অপরাধীর সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। অনাদি কাল থেকেই তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে রহস্যময়ই রয়ে গেছে। এই জাতীয় চোরদের চরিত্র সম্পর্কে অনেক লোকগাথা বা সংগীতও রচিত হয়েছে। একটি বিখ্যাত গানে বলা হলেছে,
'যেমন সিঁধেল চোরে ধরা পড়ে কবুল করে না,
মরি, স্বভাব তো কখনো যাবে না'।

প্রথম আলোর খবরে আরো জানা যায়, গ্রেফতারকৃত উক্ত চোরদের কাছ থেকে গোয়েন্দা পুলিশ প্রথম দিকেই আঙ্গুলের ছাপ ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছিল [5] । কিন্তু এই সব নমুনার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য কোন গবেষণাগারে পাঠানোর কোন প্রচেষ্টার কথা জানা যায় না। যে কাজটি গোয়েন্দা পুলিশের করার কথা ছিল। তারা তা শুরু করেও সম্পন্ন করেননি। পত্রিকার ভাষ্য মতে 'এ জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করতে পেশাদার ওই চার চোরের সঙ্গে আরও দুজনের মুখের লালা ও হাতের ছাপ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাঁদের এ মামলায় গ্রেফতার করা হয়নি [6]।' অর্থাৎ একটি অতি স্পর্শকাতর হত্যা মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে ঢাকা মহাগর গোয়েন্দা পুলিশ অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করলেও তা শেষ করেনি।

বলা বাহুল্য, অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহ করলেই কোন ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করার আইনী বাধ্যবাধকতা নেই। অন্যদিকে, গ্রেফতার করা না হলে তাদের ডিএনএ নমুনা প্রোফাইলিং করা যাবে না, আইন এমন কথাও বলে না । ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করা পুলিশি তদন্তের একটি অংশ মাত্র। অপরাধী গ্রেফতার হোক বা না হোক, তদন্ত চলবেই। তাই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেও তা পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়টি ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের অদূরদর্শিতাই প্রকাশ করে।

ডিএনএ প্রযুক্তি বর্তমানে ফৌজদারি মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অব্যর্থ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোন ঘটনাস্থল থেকে প্রচলিত পদ্ধতিতে আলামত সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে পায়ের বা হাতের আঙ্গুলের ছাপ একটি চিরায়ত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা প্রচুর। সাধারণত ঘটনাস্থল থেকে যে আঙ্গুলের ছাপ উত্তোলন করা হয় তাদের অধিকাংশই অপাঠযোগ্য থাকে। এক্ষেত্রে সংগ্রহীত ছাপ থেকে গবেষণাগারের পরীক্ষকগণ কোন সিদ্ধান্তেই আসতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক পুলিশের মতো উন্নত বিভাগের সদস্যগণও ঘটনাস্থল থেকে যে আঙ্গুলের ছাপ উত্তোলন করেন, তার মাত্র ১৫% পাঠ যোগ্য হয়। আর যাও ব্যবহার উপযোগী হয়, তার মাত্র ৩% ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেফতার সম্ভব হয়। [7]

এক্ষেত্রে ডিএনএ টাইপিং করাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তদন্ত পদ্ধতি। কেননা, ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত অণু পরিমাণ নমুনা যেমন, অপরাধীর চুলের অগ্রভাগ, হাতের স্পর্শের সাথে লেগে থাকা মৃত চামড়ার অংশ, মাথার খুশকী, মুখের লালা, বীর্যের দাগ, অপরাধীদের ফেলে যাওয়া কাপড়-চোপড় বা ঘটনাচক্রে রক্তপাত হলে সেই রক্তের সামান্য নমুনাই সন্দিগ্ধ ব্যক্তির ঘটনাস্থলে উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ দিতে পারে।

তবে ঘটনাস্থল থেকে সন্দিগ্ধ ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পেলেই যে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে, এমনটি নয়। পরীক্ষাটি অতি সুক্ষ্ণ হওয়ায় ভিকটিমের শরীরে বা ঘটনাস্থলে হাজারো ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া যেতে পারে। যেমন, ভিকটিমের শরীরে তার সন্তান, স্বামী , নিকটাত্মীয়গণ, এমনকি যারা ভিকটিমের কাপড়-চোপড় ইস্ত্রী করেন তারাসহ নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের সাথে জড়িত পুলিশ অফিসারদের ডিএনএ নমুনাও পাওয়া যেতে পারে। গবেষণাগারে এই সব নমুনার প্রত্যেকটিরই প্রোফাইলিং এর প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন মাত্র অপরাধীকে শনাক্ত করার জন্য কয়েক ডজন, কয়েক শত, এমনকি কয়েক হাজার লোকের ডিএনএ নমুনার পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। আর এ জন্য বছরের পর বছর সময়ের প্রয়োজন হতে পারে।

উদাহরণ স্বরূপ, ফৌজদারি মামলার ইতিহাসে সর্ব প্রথম ডিএনএন প্রোফাইলিং এর ঘটনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। পৃথিবীর ফৌজদারি তদন্তের ইতিহাসে এই মামলাটি এন্ডারবি মামলা নামে খ্যাত [8]। ১৯৮৩ সালে ইংল্যান্ডের এন্ডারবি গ্রামে লিন্ডা মান নামের এক ১৫ বছর বয়সী কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ভিকটিমের শরীর থেকে সন্দেহভাজন অজ্ঞাত ব্যক্তির বীর্যের নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এই হত্যার রহস্য অনুদ্ঘাটিত রয়ে যায়।

প্রায় দুই বছর পরে ডন আসওয়াথ নামের পনের বছর বয়সী আর একজন কিশোরী একই উপায়ে ধর্ষণের পর নিহত হয়। আসওয়াথের শরীর থেকেও সন্দেহভাজনের বীর্য সংগ্রহ করা হয়। এই দুই বীর্যের নমুনা ডিএনএ প্রোফাইলিং করে অভিন্ন পাওয়া যায়। এর অর্থ হল লিন্ডা মান ও ডন আসওয়াথ এর ধর্ষণ ও হত্যাকারী মূলত একই ব্যক্তি। এই অপরাধের দায়ে ১৭ বছর বয়সী এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিকভাবে সে পুলিশের কাছে একটি হত্যার দায় স্বীবার করে। কিন্তু পরবর্তীতে ডিএনএ প্রোফাইলিং করে নিশ্চিত হওয়া যায়, একই ব্যক্তি মান ও আসওয়াথের মৃত্যুর জন্য দায়ী হলেও পুলিশের হেফাজতে হত্যার দায় স্বীকারকারী ব্যক্তি কোন ক্রমেই এর জন্য দায়ী নয়। অর্থাৎ দুই ভিকটিমের শরীর থেকে প্রাপ্ত বীর্যের ডিএনএ প্রোফাইলিং অভিন্ন হলেও তা পুলিশের হেফাজতে থাকা ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইলিং এর সাথে মিলে না। পুলিশের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে নির্দোষ প্রমাণে মুক্তি দেওয়া হয়।

এরপর শুরু হয় প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্তকরণের অভিযান। এন্ডারবি এলাকায় বসবাসকারী ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সী সকল পুরুষের ডিএনএ নমুনা প্রোফাইলিং করার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। প্রত্যেককে স্বেচ্ছায় মুখের লালা নমুনা হিসেবে প্রদানের আহ্বান জানান হয়। এই সময় এন্ডারবি গ্রামের ১৩ থেকে ৩০ বছরের বয়স সীমার পুরুষের সংখ্যা ছিল ৫,৫০০ জন যাদের দুই জন ছাড়া সবাই পুলিশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ডিএনএ নমুনা প্রদান করে। এর পর পুলিশ জানতে পারে যে কলিন পিচফর্ক নামের এক ব্যক্তি নিজের ডিএনএ নমুনা প্রদান না করে তার এক বন্ধুকে দিয়ে তার নামে ডিএনএ নমুনা প্রদান করে নিজেকে ডিএনএ পরীক্ষা থেকে বাঁচিয়েছে। পরে পুলিশ পিচফর্ককে গ্রেফতার করে তার ডিএন এ নমুনা পরীক্ষা করে তার সাথে ভিকটিমদের দেহে প্রাপ্ত ডিএনএ নমুনার সাথে নির্ভুল মিল খুঁজে পায়। এক পর্যায়ে পিচফর্ক তার অপরাধের কথা স্বীকার করে। প্রকৃত পক্ষে কলিন পিচফর্কই ছিল ডিএন এ পরীক্ষার প্রথম ব্যক্তি যার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এন্ডারবি অফিযানে সেই ছিল ৫,৪৯৯তম ব্যক্তি। একই ভাবে অস্ট্রেলিয়ায় নিউ সাউথ ওয়েলসের উয়ি-ওয়া নামের একটি ছোট্ট শহরে ২০০০ সালে একজন বৃদ্ধ মহিলাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এই ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য এই শহরের প্রায় ৬০০ ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা ( মুখের লালা) পরীক্ষা করা হয়েছিল [9]।

অনেকে মনে করেন, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাদের মতে ডিএনএ শুধু মৃত ব্যক্তির পরিচয় উদ্ঘাটন বা বিতর্কিত সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণেই প্রয়োগ করা সম্ভব। কিন্তু পাশ্চাত্যের ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ার দিকে তাকালে তাদের এই জ্ঞানসীমার বিস্তৃতি ঘটবে। ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অগণিত ফৌজদারি মামলার ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমেই জট খুলেছে ।

একটি ধর্ষণ মামলার তদন্তকালে ভিকটিমের শরীরে একটি কামড়ের দাগ পাওয়া যায়। কামড়ের দাগ থেকে প্রাপ্ত তরল পদার্থ (মুখের লালা) সংগ্রহ করে তার ডিএনএ প্রোফাইলিং করা হয়। পরে সন্দিগ্ধ ব্যক্তি এক ডেন্টিস্টের কাছে কৃত্রিম দাঁত তৈরি করতে গেলে, তিনি যে ছাঁচের মধ্যে দাঁতের মাড়ির মাপ দেন, সেই ছাঁচ থেকে সংগ্রহ করা লালার ডিএনএ প্রোফাইলিং করে ভিকটিমের শরীর থেকে প্রাপ্ত লালার প্রোফাইলিং মিলে গেল তাকে নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়। অন্য একটি ধর্ষণ মামলার তদন্তকালে জানা যায় মুখোশধারী ধর্ষক ধর্ষণকালে তার ভিকটিমকে দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ লেহন করান। ধর্ষণ ঘটনার প্রায় ৬ ঘন্টা পরে সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে তার পুরুষাঙ্গে লেগে থাকা তরল পদার্থের ডিএনএ প্রোফাইলিং করানো হয়। ভিকটিমের মুখের লালার সাথে আসামীর পুরুষাঙ্গে প্রাপ্ত তরল পদার্থের ডিএনএ প্রোফাইলিং সম্পূর্ণরূপে মিলে যায়। ফলে ধর্ষককে শতভাগ নিশ্চয়তাসহ শনাক্ত করা হয়। [10]

ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল, ঘটনাস্থল বা ভিকটিমের শরীর থেকে সন্দিগ্ধদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা। ধর্ষণের মতো অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে ভিকটিমের সাথে অপরাধীদের শারীরিক সংশ্রব থাকে, সেই ক্ষেত্রে অপরাধীর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা অতি সহজ হয়। যেমন ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভিকটিমের শরীরে অপরাধীর বীর্য, মুখের লালা বা ধ্বস্তা-ধ্বস্তির সময় অপরাধীর শারীরিক কোন না কোন ডিএনএ নমুনা মিশে যেতে পারে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ডিএনএ নমুনা পাওয়া বড়ই দূরহ । এক্ষেত্রে পুলিশকে অদৃশ্য নমুনা সংগ্রহের অভিযান পরিচালনা করতে হয়।

এই কাজটি এক দিকে যেমন জটিল ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের, অন্যদিকে অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি( এনএফডিপিএল) তে এক একটি নমুনার প্রোফাইলিং করতে খরচ পড়ে পাঁচ হাজার টাকা। আর দেশের বাইরে এই পরীক্ষার খরচ আরো বেশি যা বাংলাদেশের খরচের চেয়ে ১০ গুণ বেশি [11]। যদি বাংলাদেশের বর্তমান বাজার দরেই হিসেব করি, তাহলে, উপরে বর্ণিত এন্ডারবি মামলার তদন্তকালে শুধু ডিএনএ পরীক্ষাতেই খরচ হয়েছিল প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা। কিন্তু সময় বা খরচ যাই হোক যে কোন ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে তা চূড়ান্ত বাধা হতে পারে না। বিশেষ করে আলোচিত সাগর-রুনি মামলার ব্যয়ের চেয়ে সরকারের কাছে এর রহস্য উদ্ঘাটনই অগ্রাধিকার পাচ্ছে যা প্রত্যাশিতও বটে।

অনেকে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে ডিএনএ প্রযুক্তির ব্যবহারকে অপ্রয়োজনীয় বলে মত দিচ্ছেন। কিন্তু তদন্তের অর্থ শুধু অপরাধীকে খুঁজে বের করাই নয়; সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সন্দেহমুক্ত হওয়াটাও তদন্তের অংশ। যেমন, সন্দেহ বসত পুলিশ কোন অপরাধের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারে। প্রায় ক্ষেত্রে কিছু সন্দেহ যৌক্তিক হলেও অপরাধ প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে পুলিশ প্রায়শই সন্দেহকে তাদের সপক্ষে বিবেচনা করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র প্রেরণ করে। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে পুলিশের সন্দেহ আসামীর পক্ষেই যায়। অর্থাৎ সে বেকসুর খালাস পায়। এ ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে অভিযুক্তের নির্দোষত্ব প্রমাণের ব্যবস্থা করা গেলে নির্দোষ ব্যক্তিকে এত হয়রানির শিকার হতে হতো না।

নির্ভুল বা সন্তোষজনক তদন্তের ক্ষেত্রে পেশাদার প্রত্যাশা হল, পুলিশ সন্দেহের সব বিষয়গুলিই খতিয়ে দেখবে। হাতের নাগালে থাকা সব কয়টি কৌশল প্রয়োগ করেও যদি অপরাধী শনাক্ত করা না যায়, তবে কোন মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা পুলিশের জন্য যৌক্তিক হবে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীতে সংঘটিত সব অপরাধই যে শনাক্ত হবে এমন কোন কথা নেই। হত্যা মামলার কথাই যদি বলি, তাহলেও বলতে হবে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের দেওয়া পরিসংখ্যানই বলে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ১০০ টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মাত্র ৬৩ টি ঘটনার কুল কিনারা করতে পারেন। বাকী ৩৭ টি হত্যা ঘটনার ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি, অর্থ-সম্পদ কোন কাজেই আসে না [12]। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশে সংঘটিত প্রত্যেকটি হত্যা কাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করার মতো অসম্ভব কর্মদক্ষতা আমরা বাংলাদেশ পুলিশের কাছ থেকে প্রত্যাশা করতে পারি না। সাফল্যের নিশ্চয়তা নয়; বরং নির্ভুল তদন্তের জন্যই সাগর-রুনি হত্যা মামলায় ডিএনএ প্রযুক্তির ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন।(১৬/০৯/২০১২)

সূত্রাবলীঃ
[1] http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-08-24/news/283521 / দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ আগস্ট ২০১২
[2] http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-15/news/289459/ দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২
[3] http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-15/news/289459/ দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২
[4] দৈনিক আমার দেশ ২৬ আগস্ট, ২০১২
[5] http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-15/news/289459/ দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২
[6] http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-15/news/289459/ দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২
[7] The New York Times, August, 17, 1986
[8] Criminal Investigation (seventh edition) by Charles R. Swanson et al. McGrw-Hill; ISBN: 0-07-228594-X
[9] DNA Identification in the Criminal Justice System Jeremy Gans and Gregor Urbas in crime and criminal justice by Jeremy Gans and Gregor Urbas )
[10] What Every Law Enforcement Officer Should Know About DNA Evidence / https://www.ncjrs.gov/pdffiles1/nij/bc000614.pdf
[11] http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-04/news/286442/ দৈনিক প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২
[12] http://www.fbi.gov/news/stories/2009/september/crimestats_091409 /on 21/02/2012 at 10 am.

***
ফিচার ছবি: আইরিন সুলতানা