পুলিশের রোজনামচা’ একটি ব্যতিক্রমি পুলিশ-জীবনী

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 8 May 2015, 05:14 AM
Updated : 8 May 2015, 05:14 AM

বইটির কলেবর বেশ বড়। প্রায় ৪৩০ পৃষ্ঠা। লিখেছেন, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি জনাব জাকির হোসেন। লেখক ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। ১৯৮২ সালে সামরিক আইনের বলে এক আদেশে এরশাদ সরকার তাকে ডিআইজি পদ থেকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করেন। এ অবসর ছিল তার স্বাভাবিক অবসরের বয়স থেকে প্রায় এক যুগ পূর্বে।

বইটিতে লেখক তার জন্মস্থান নোয়াখালী জেলার ইতিহাস থেকে শুরু করে তার নিজের পেশাগত জীবনের প্রায় সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সাধারণত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের আত্মজীবনীতে তাদের নিজস্ব কর্মকাণ্ডের আলোচনা-পর্যালোচনার চেয়ে রাজনীতি, সমাজনীতি এমন কি বিশ্ব রাজনীতি পর্যন্ত আলোচিত হয় যা প্রায়শই পাঠক হিসেবে আমাকে আহত করে। কারণ, কোন পুলিশ অফিসারের জীবনী পড়ার সময় আমি তার পুলিশ জীবনের কথাই শুনতে চাই। তার পেশাগত জীবনের উত্থান-পতন, ক্ষমতা-অক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হলেই তার জীবনীর স্বার্থকতা রক্ষিত হয়। কিন্তু আমাদের আত্মজীবনীকার পুলিশ অফিসারগণ, বিশেষ করে সিনিয়র পুলিশ অফিসারগণ, সে বিষয়ে কর্ণপাতই করেন না। সিনিয়র অফিসার নয়, বরং বেশ কিছু জুনিয়র পুলিশ অফিসারের আত্মজীবনী পড়ে আমি সে বিষয়ে বেশ তৃপ্তী পেয়েছিলাম। সে দিক বিবেচনায় আমার কাছে জনাব এস জাকির হোসেইনের 'পুলিশের রোজনামচা' বইটি বেশ ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়েছে।

লেখকের পিতা ছিলেন একজন কলেজ অধ্যাপক। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী কলেজটি তার পিতা টি. হোসেনের আজীবন চেষ্টার ফসল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তার পরিবার ছিল স্বচ্ছল| কিন্তু উচ্চ শিক্ষা লাভের পর তার পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে প্রবেশের ব্যাপারে ছিল বেশ অনিশ্চয়তা। পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে যোগদানের পূর্বে তিনি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের নৈশ বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক থেকে শুরু করে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারিয়াল চাকরি পর্যন্ত করেছেন।

পুলিশের বিভিন্ন পদে চাকরির সময় তার বেশ কিছু অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি সৈয়দপুরে রেলওয়ে জেলার এসপি ছিলেন। তিনি সহ বেশ কয়েকজন রেলওয়ে অফিসার সে সময় ছিলেন গৃহবন্দী। অবশ্য পাক সরকার এ যুদ্ধকালীনই তাকে সৈয়দপুর রেলওয়ে জেলা থেকে যশোর জেলার এসপি হিসেবে বদলি করে। এ সময় কোন না কোন ভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সুযোগ তার ছিল বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে পাক সরকারের চাকরিতে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে তিনি সীমান্তবর্তী এই জেলার পুলিশ প্রশাসন চালিয়েছিলেন। এ সময় ভারতে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে তিনি অনেক কর্মকর্তার মতোই পাকিস্তান সরকারের অনুগত থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার বর্ণনা থেকে, তাই, বোঝা যাবে সেই সময় অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারগণ কিভাবে প্রশাসন চালিয়েছেন, কিভাবে বৈরি শক্তির সহযোগী হয়েও মুক্তির জন্য প্রহর গুণেছেন তারা।

এক সময় অমুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তাগণ পাকিস্তান আর্মি ও মুক্তি যোদ্ধা উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সে সময়ের সরকারি কর্মচারিদের মানসিক অবস্থা ও সরকারি প্রশাসনের ইতিহাস জানতে গেলেও জনাব জাকির হোসেইনের আত্মজীবনী 'পুলিশের রোজনামচা' পাঠকদের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হবে।

স্বাধীনতার পরের বেশ কিছু আলোচিত বিষয়ের ভিন্নতর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে  পুলিশের রোজনামচায়। বঙ্গবন্ধুর শাসন, জিয়া-মোস্তাকের বিপ্লব, খালেদ মোশারফের প্রতিবিপ্লব এবং সব শেষে এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনের খণ্ড চিত্রও এ বইটি ধারণ করে। লেখক এখানে কোন ইতিহাস বর্ণনা করেননি। ইতিহাসের সাথে তার যে টুকু সম্পর্ক তিনি তাই বর্ণনা করেছেন। তাই তার লেখনির তথ্যগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ হিসেবে ধরে নেয়া যায়।

পতিত স্বৈরশাসক এরশাদের ব্যক্তিগত জীবনের বেশ কিছু ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যাবে এ বইতে। তার নারী লিপ্সুতার কিছু বাস্তব চিত্রও আমরা এখানে পাব। বিশেষ করে এরশাদের রক্ষীতা মমতাজ মেরি ও তার স্বামী বদরুদ্দীনের বিষয়টির প্রামাণ্য দলিল বলতে পারেন এ বইটি। ব্যাংকার বদরুদ্দীনকে দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচাতে তৎকালীন মেজর জেনারেল এরশাদের দুয়ারে ধর্ণা দিতে এসে সুন্দরী মমতাজ মেরি কিভাবে এরশাদেরই রক্ষিতা হয়ে ওঠেন তার কিছু চিত্র এখানে পাওয়া যাবে। লোলুপ এরশাদের ক্ষমতার ফাঁদে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে শেষ পর্যন্ত মেরি তার স্বামীকে বাঁচাতে পারলেও নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। বেচারা বদরুদ্দীন জেল থেকে বেরিয়েছেন আর তার সুন্দরী স্ত্রী এরশাদের ঘরে ঢুকেছেন। মুক্ত জীবন ফিরে পেলেও তিনি তার স্ত্রীকে এরশাদের কাছে হারিয়েছিলেন।

লেখকের অকাল অবসর পুলিশ অফিসারদের হটাৎ পতনের সম্ভাবনাকে আপনার সামনে প্রকট করে তুলবে। একজন চাকরি হারানো পুলিশ অফিসার শেষ জীবনে কিভাবে জীবিকা অর্জনের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন; কিভাবে একটার পর একটা ব্যবসা শুরু করে লোকসান খেয়ে শেষ পর্যন্ত একটি বেসরকারি চাকরি সংগ্রহ করে অকাল অবসর কাটাতে বাধ্য হন একজন মেধাবী পুলিশ অফিসার, তা বুঝতে হলে 'পুলিশের রোজনামচা' বইটি পড়ে দেখতে পারেন।

'পুলিশের রোজনামচায়' প্রশাসন ক্যাডারের অফিসারদের সাথে পুলিশ অফিসারদের স্নায়ুযুদ্ধের কিছুটা বিবরণ পাওয়া যাবে। কিছু কিছু সরকারি কর্মচারি তাদের পদের ক্ষমতাকে কতটা ব্যক্তিগত বলে মনে করেন এবং কতটা জনগণের আমানত বলে স্বীকার করেন তারও স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যাবে এ বইটি পড়ে।

তবে পুলিশের নিম্নপদের কর্মচারিদের সুখ-দুঃখের তেমন কোন বিবরণ এ বইটিতে পাবেন না। তাছাড়া পুলিশের চিরায়ত দুর্নীতির তেমন কোন চিত্রও এখানে ফুটে ওঠেনি। এ দিক দিয়ে বইটিতে বেশ কিছু অপূর্ণতা রয়েছে বলে আমি মনে করি।

পুলিশ অফিসারদের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলো বাংলাদেশ পুলিশকে আরো সম্মৃদ্ধ করবে বলে আমি মনে করি। পুলিশ অফিসারগণ পেশাগত কারণে যত উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাত, মান-সম্মান আর কষ্টকর অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন, সেগুলোর সামান্যতম চিত্রও কেউ যদি কাগজ-কলমে ধরে রাখেন, তাহলে সেগুলো পুলিশ-সাহিত্য তো বটেই সাধারণ সাহিত্যেরও বড় অংশ হবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশ অফিসারদের মধ্যে একটি চিরাচরিত গাফিলতি লক্ষ করা যায়। যে পুলিশ অফিসার হাজার হাজার পৃষ্ঠার কেস ডকেট তৈরি করেন; মামলার সপক্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলোকে সাক্ষ্য আইনের আলোকে ফৌজদারি কার্যবিধির পদ্ধতি অনুসারে যে নিখুঁত বিন্যাসে সাজিয়ে একজন অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করেন, সে একই পুলিশ অফিসারকে কয়েক পৃষ্ঠার জীবনী লিখতে বললেই নিজেদের অজ্ঞ বলে জাহির করেন। আমি মনে করি, এটা বড় ধরনের অসঙ্গতি।

পুলিশ অফিসারদের তাই অন্তত কয়েক পাতার জীবনী লিখতে আহব্বান জানাই। গিরিশ চন্দ্র বসু, ধীরাজ ভট্টাচার্য, সা'দত আলি আখন্দ, কাজী আনোয়ার হোসেন, এস জাকির হোসেইন, সিকান্দার আলি প্রমূখ পুলিশ অফিসারদের কাছে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ। কেননা, তারা আমাদের জন্য অতীতের পুলিশের কিছু ইতিহাস ও কাহিনী আমাদের জন্য রেখে গেছেন। ০১/১০/২০১২