পুলিশ সংস্কারঃ বোঝাবুঝির সমীকরণ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 13 Oct 2012, 06:41 PM
Updated : 13 Oct 2012, 06:41 PM

সংস্কার কি?
'সংস্কার' শব্দটি নানাবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর একটি ধর্মীয় দিক ও একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিক রয়েছে। হিন্দু ধর্মে সংস্কার হল দশটি আবশ্যিক কর্মসম্পাদন। ধর্মনিরপেক্ষ দিকটির অর্থ হল শুদ্ধিকরণ, পতিত অবস্থা হতে উদ্ধার, শোধন, পরিষ্কার বা নির্মল করা, অলঙ্করণ বা প্রসাধন, উৎকর্ষবিধান, উন্নতি বিধান, ত্রুটি বা অপূর্ণতা সংশোধন, মেরামত ইত্যাদি।

পুলিশ সংস্কার কি?

পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ সংজ্ঞাটিই গ্রহণ করব। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সংস্কার বলতে পুলিশকে নানা প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে সংশোধান বা শুদ্ধ করা বোঝায়। এই বাইরেও পুলিশ সংস্কার পুলিশের উৎকর্ষবিধান, উন্নতি বিধান, নির্মল বা পরিষ্কার করা মেরামত করা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপূর্ণতা দূর করে পুলিশকে জনগণের জন্য প্রদেয় সেবার জন্য প্রস্তুত করাইকেই বোঝাবে। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পুলিশ সংস্কার বলতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে বোঝান হবেঃ

• পুলিশকে আইনের প্রতি জবাবদিহি করা;
• পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ এবং নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট ও কাঙ্খিত মানদণ্ড তৈরি করা;
• পুলিশের কার্যসম্পাদন ও সেবাদানের শর্তাবলী ও মান উন্নত করা;
• পুলিশের উপর থেকে অবৈধ ও অনাকাঙ্খিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অপসারণ করা;

পুলিশ সংস্কার কিভাবে পুলিশ সদস্যদের জীবন মান ও সেবাদান কর্মে কাঙ্খিত ভিন্নতা নিয়ে আসবে। উদাহরণগুলো হলঃ

১. নির্বিচার ও স্বেচ্ছাচারীভাবে পুলিশ সদস্যদের বদলী বা পদায়নের পথ বন্ধ হবে;
২. নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার ফলে যোগ্য ব্যক্তিরাই পুলিশে যোগ দিতে সমর্থ হবে;
৩. সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের সময় মতো পদোন্নতি;
৪. পুলিশ অফিসারগণ তদন্ত ও অন্যান্য আইনগতকর্মে বিধিমত নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে;
৫. সাধারণ মানুষের সাথে নৈকট্য ও সুসম্পর্ক তৈরি হবে যার ফলে পুলিশের কর্তব্য পালন সহজতর হবে;
6. অফিসারগণ অপেক্ষাকৃত স্বল্পমাত্রার মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে কর্তব্য পালন করতে সক্ষম হবে;
7. পুলিশ বিশেষ মহলের স্বার্থ সিদ্ধির পরিবর্তে দেশ ও জাতির সেবা করা।

পুলিশ সংস্কারের ফলে সাধারণ মানুষের কি লাভ হবে?

১. সংস্কারকর্ম সম্পন্ন হলে জনগণের পক্ষে পুলিশের সেবাপ্রাপ্তি সহজতর হবে এবং পুলিশ জনগণের সমস্যা ও দুর্ভোগের প্রতি অধিক পরিমাণে সহানুভূতিশীল হবে;
২. পুলিশ জনগণের প্রতি নম্র-ভদ্র ও শালীন আচরণ করবে এবং তথ্য উদ্ঘাটন বা জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে নির্দয় বা তথাকথিত তৃতীয় মাত্রার পদ্ধতি অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকবে;
৩. সুবিচার প্রাপ্তি সহজতর হবে;
৪. জনগণের মনে নিরাপত্তা বোধ তৈরি হবে;
৫. এমন একটি সামাজিক অবস্থা তৈরি হবে যাতে সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে তাদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারবে এবং মানবাধিকার সমূহ নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবে।

পুলিশ সংস্কার কী নয়?

পুলিশ সংস্কারের প্রসঙ্গ এলেই এক শ্রেণির মানুষ বুঝে নেন এবং অন্যদের বোঝাবার চেষ্টাও করেন যে পুলিশ সংস্কার হলে পুলিশ বিভাগের উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। অর্থাৎ পুলিশ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন হয়ে যাবে। আর বাংলাদেশও পরিণত হবে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে।

কিন্তু এই ধরণের মতাম অত্যন্ত স্থূল। পুলিশ সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সার্বজনিনও বটে। শুধু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত দেশগুলোই নয়, পুলিশ সংস্কার ঔপনিবেশের শাসনকারী দেশগুলোতেও লক্ষণীয়। ব্রিটিশ মূল ভূখণ্ডের পুলিশগুলোকে সংস্কারার্থে সেখানে যে সর্বশেষ যে বিলটি পাশ হয় তা হল, ২০০২ সালের পুলিশ সংস্কার আইন। অন্যদিকে প্রাক্তন কলোনিগুলোতে যে পুলিশ সংস্কার চলছে তার কোথাও পুলিশকে সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোন উপাদান নেই।

সর্বত্রই পুলিশ নির্বাহী বিভাগের অংশ এবং সংস্কারের পলেও তা্‌ই থাকবে। পুলিশ সংস্কার সম্পন্ন হলে পুলিশ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অধীনে থেকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। এর ফলে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সরকারেরও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে পুলিশ সংস্কারের উদ্দেশ্য কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণহীন বা অদায়িত্বশীল পুলিশ বাহিনী তৈরি করা নয়। একটি দায়িত্বশীল, সুসংঘটিত, পেশাদার, দক্ষ ও জনসম্পৃক্ত পুলিশ বাহিনী যে কোন গণতান্ত্রিক সরকারের জনগণের কাছে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য নিজগুণেই অপরিহার্য। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই পুলিশের সংস্কার হওয়া বাঞ্ছনীয়।

সূত্র:
১।পুলিশ সংস্কার ও আপনি- দোয়েল মুখার্জী।
২। সংসদ বাংলা অভিধান