দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোরদের কোরবানি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 23 Oct 2012, 08:09 AM
Updated : 23 Oct 2012, 08:09 AM

নিজের প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করাই হল কোরবানি। হযরত ইব্রাহীম (আ) আল্লাহর নির্দেশে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজ পুত্র ইসমাইল (আ) কে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। আল্লাহ পাক এতে সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইলের পরিবর্তে একটি ভেড়া/দুম্বা কোরবানি মঞ্জুর করেন। অর্থাৎ পশু কোরবানি আল্লাহর উদ্দেশ্যে মুসলমানের সর্বোচ্চ ত্যাগকেই মহিমানিত্বত করে।

ধর্মীয় বিধান অনুসারে একাধিক পশু কোরবানি দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। গরু, মহিশ, গয়াল, উট ইত্যাদি শ্রেণির পশু হলে সাতজন মিলে একটি এবং ভেড়া, ছাগল, দুম্বা শ্রেণির পশু হলে একজন ব্যক্তি এশটিমাত্র পশু কোরবানি দিতে পারেন। অধিক অর্থের মালিক হলে অধিক সংখ্যক পশুর প্রাণ হরণ করতে হবে, এমন নির্দেশনা ইসলামে নেই। বিত্তবানদের প্রতি অধিক দান-খয়রাত করার নির্দেশনা ইসলামে আছে। কিন্তু যত বেশি সম্পদশালীই হোক, কোন মুসলমানের প্রতি একাধিক পশু কোরবানি দিতে হবে বলে কোন ধর্মীয় নির্দেশনা নেই।

কিন্তু আমাদের সমাজে বিত্তবৈভবের মালিকগণ একাধিক পশু কোরবানি দেয়ার একটি জনপ্রিয় ফ্যাসান বা রীতি চালু করেছেন। কেউ কেউ একটি বা দুইটি নয়, এক দুই শতটি পশু পর্যন্ত কোরবানি দিয়ে নিজেদের বৈভব-লীলা প্রচারে লিপ্ত হন। অনেকে অধিক সংখ্যক পশু কোরবানি দেওয়ার বিষয়টি রীতিমত প্রচার করে নিজেকে শুধু জাতে তোলা নয়, জাতের চেয়ে এক ধাপ উপরে ওঠার টিকেট কিনতে চান।

সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও এইরূপ একটি শ্রেণি রয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা ইত্যাদির মাধ্যমে তারা অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। কিন্তু সরকারিভাবে সম্পদ সঞ্চিত করার উপায় নেই বলে তারা বিভিন্ন পূজা-পার্বণে মুক্ত হস্তে অর্থ খরচ করেন। তাদেও নিজ নিজ এলাকায় তারা রীতি মত দানবীর, সমাজ সেবক ও জন-দরদী। কোরবানির পশু ক্রয়ে কিছু বাড়তি অর্থ খরচ তাদের সম্পদ গোপন করার একটি প্রক্রিয়ার অংশ। শিক্ষা অফিসের কেরানি, ভূমি অফিসের কানুনগো, সচিবালয়ের দফতরি, কাস্টমস অফিসের পিওন কিংবা পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে অফিসের টপ বস বা কর্ণধার পর্যন্ত একাধিক পশু কোরবানির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন।

এই সব কর্মকর্তা কর্মচারিদের মধ্যে আবার কতিপয় সর্বভূক রয়েছেন, যারা নিজ অর্থে বা ঘুষের অর্থে নয়, বরং জলজ্যান্ত কোরবানির পশুটিই মক্কেলের কাছ থেকে সরাসরি ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেন। কোরবানির পশু ঘুষ হিসেবে পেয়ে তারা সেগুলো ঘটা করে কোরবানি দিয়ে নিজ এলাকার গরিব-মিসকিনদের খাওয়াইয়ে নিজেদের জন্য আখেরাতের পথ প্রসস্ত করেন। প্রজাতন্ত্রের সকল শ্রেণির সরকারি অফিসে এই শ্রেণির জীবগণ মহাদাপটে জনসেবা করেন।

প্রত্রিকার খবরে প্রকাশ, বহুল বিতর্কিত হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির হোতা তারুয়া গ্রামের তানভির নাকি সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের গাড়ি-বাড়ি-ইজ্জত উপহার দেওয়ার পাশাপাশি কোরবানির পশুও উপহার দিতেন। সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মন রক্ষা করতে ২০১১ সালে কোরবানির ঈদে গড়ে ৪৫ হাজার টাকা মূল্যের ৮৫ টি গরু কিনেন হলমার্ক গ্রুপের মালিক তানভীর। এসব গরুর ৩০টি তানভীরের নিজস্ব কোরবানির জন্য রাখা হয়। বাকী গরুগুলো উপহার হিসেবে পাঠানো হয় তানভীরের অবৈধ কাজে সহাযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন মহলের কাছে ।

কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যারা সরাসরি ঘুষ হিসেবে গরু গ্রহণ করেন না। কিন্তু সরকারি সম্পদকে কোরবানির সাথে গুলিয়ে ফেলেন। যেমন, একজন সরকারি কর্মকর্তা তার কর্মস্থলে কোরবানির মাস খানিক আগে একটি গরু ক্রয় করেন। গরুটি সেইখানে কেরানি-অর্ডালীদেও দ্বারা লালিত পালিত হতে থাকে। এর মাঝে সেই কর্মকর্তা অন্যত্র বদলী হয়ে যান। কিন্তু গরুটি তার পূর্বের কর্মস্থলেই রয়ে যায়। কোরবানির পূর্ব মুহুর্তে সেই গরুটি ঢাকায় আনার প্রয়োজন হলে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে একটি ট্রাকে করে সেই গরুটি কোরবানির জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।

এখানে হয়তো গরুটি নিজের টাকায় কেনা হয়েছিল। কিন্তু একটি ট্রাকের ভাড়া কিংবা সরকারি জ্বালানীর দাম যুক্ত হয়েছিল সেই গরুর দামের সাথে। যদি ঢাকা থেকে দূরবর্তী সেই কর্মস্থলে গরুটি ৪০ হাজার টাকায় কেনা হয়, তাহলে তা ঢাকায় পাঠাতে সরকারি অর্থ ও জনবলসহ তার দাম পড়ে গিয়েছিল ৭০ হাজার টাকা।

এই ভাবে যে সব এলাকায় গরুর দাম কম, বিশেষ করে চরাঞ্চল রয়েছে এমন সব জেলাগুলোর স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীগণকে ঢাকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফরমায়েস পেয়ে কম দামে বড় গরু কিনে সরকারি অর্থে তা পরিবহন করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য নিম্নতম কর্মকর্তাদের সরকারি অর্থের এই শ্রাদ্ধ এক মহান ত্যাগ বৈকি!

এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা তাদের নিম্নতম কর্মচারিদের দিয়ে কৌশলে বেশি দামের কোরবানির পশু কম দামে ক্রয় করেন।

যেমন, বস বললেন, 'এই তোমার এলাকায় কোরবানির পশু নাকি বেশ সস্তা'?
অধঃস্তন বলেন, 'স্যার, খুবই সস্তা। কিনব আপনার জন্য এক-দুটো'?
বস বলেন, 'কত দাম পড়বে'?
অধঃস্তন বলেন, 'স্যার ১০/১২ হাজার হলে ১৫/১৬ মণ ওজনের গরু পাওয়া যাবে'!

বেজায় খুশি বস। ১০ হাজার টাকা দিয়ে বলেন, 'দাও তো পাঠিয়ে একটা বড় গরু'।
অধঃস্তন ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনে বসকে খবর দেয়ঃ
– 'স্যার, আপনার জন্য একটা ভাল গরু সস্তায় কিনেছি মাত্র ০৮ হাজার টাকায়। আপনার দেওয়া টাকা থেকে দুই হাজার টাকা বেঁচে গেছে'।

এরপর সরকারি গাড়ি বা পরিবহনের সুবিধা ব্যবহার করে সেই গরু পাঠানো হয় ঢাকায়। অফিসের বস তার অধঃস্তনের বড়ই তারিফ করে। বড় কামের অফিসার সে। ০৮ হাজার টাকায় ১৫ মণ ওজনের একখান গরু কিনে কোবরানির সুযোগ করে দিয়েছে সে।

কোরবানি হল প্রকৃত ত্যাগ। এই ত্যাগ হতে হবে বৈধ বস্তুর উপর নির্ভেজাল বৈধ দখলি সত্বের ত্যাগ। ঘুষের অর্থের পশু কিংবা অধীনস্তদের উপহার দেওয়া ১০ হাজার টাকায় কেনা ১৫ এ (!) ওজনের গরু দিয়ে কোরবানির দিনে রক্তপাত ঘটানো যায়, কিন্তু কোরবানি দেওয়া যায় না। কোরবানির ঈদকে ঘিরে অবৈধ অর্থে একাধিক পশু কোরবানির অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়তো করতে পারব না। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায়, অবতীর্ণ হওয়া থেকে আসুন সবাই বিরত থাকি। ২৩/১০/২০১২

সূত্রঃ দৈনিক যায়যায় দিন/০৮ সেপ্টেম্বর/২০১২
(http://www.jjdin.com/?view=details&type=single&pub_no=234&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=23)