বাংলাদেশ পুলিশঃ একটি যুগোপযুগী আইন সময়ের দাবি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 4 Dec 2012, 06:08 AM
Updated : 4 Dec 2012, 06:08 AM

অন্যান্য উপনিবেশগুলোর মতোই বঙ্গ-ভারতে ব্রিটিশদের পুলিশ সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ছিল তাদের শাসন ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করা। এই লক্ষ্যে তারা স্বাধীকার আন্দোলনকারীদের দমন, পীড়ন, ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পরিবর্তে পুলিশকেই ব্যবহার করা অধিকতর সমীচীন বলেই মনে করত। ক্রমবর্ধমান অপারধ যে ব্রিটিশদের শাসন ব্যবস্থাকে সংক্ষিপ্ত করবে তা বোঝার মতো যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান ইংরেজগণ ছিল। তাই নিয়মতান্ত্রিক একটি পুলিশ বাহিনী গঠনের জন্য তারা ১৮৬১ সালে যে আইনটি প্রবর্তন করেছিল তা হল বিখ্যাত, কুখ্যাত, আলোচিত, সমালোচিত এবং একই সাথে কালোত্তীর্ণ ভারতীয় পুলিশ আইন। বৃটিশ আশ্রিত ভারতীয় উপমহাদেশের সকল প্রদেশ/রাজ্যেই একই আইনের অনুলিপির বাস্তবায়ন করা হয়েছিল।

ব্রিটিশগণ ভারত ছেড়েছে ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ব্রিটিশগণ এদেশ ছাড়লেও বাংলাদেশের জনগণ ব্রিটিশদের উত্তপ্ত খোলা থেকে পাকিস্তানীদের ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়ে দগ্ধ হতে থাকে। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হই ১৯৭১ সালে। তবে স্বাধীন দেশেও আমরা আগাগোড়া অবিকৃত রাখি ব্রিটিশদের পুলিশ-ব্যবস্থাকে।

সাধারণত কোন দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলে তারা তাদের শাসন ব্যবস্থাকে নিজেদের জাতি ও সমাজের প্রত্যাশার অনুরূপে সাজিয়ে নেয়। নাগরিকদের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অপরাধ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ঘাটন করে নাগরিকদের মনে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করতে তারা তাদের পুলিশ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হয়। এক্ষেত্রে আমরা এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশের পুলিশ বাহিনীকে স্বদেশী বানাবার প্রক্রিয়া আলোচনা করতে পারি।

প্রথমেই আসি অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপ-রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডে। এই দেশের শুধু পুলিশ ব্যবস্থাই নয়, প্রায় পুরো জনগোষ্ঠীই ইউরোপ এবং বিশেষত ব্রিটেন থেকেই আগত। তাদের সাথে ব্রিটিশ মূল ভূখণ্ডের সমাজ-সংস্কৃতির বড়ই মিল রয়েছে। কিন্তু এর পরেও ভৌগোলিক কারণে তারা স্বকীয়। নিউজিল্যান্ড প্রথম পুলিশ আইন প্রণয়ন করে ১৯৪৭ সালে[১] । এর পর ১৯৫৩ সালে এই আইন বাতিল করে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্ট সম্পূর্ণ আধুনিক ও যুগোপযোগি একটি পুলিশ আইন প্রণয়ন করে যার অধীন বর্তমান পুলিশ সার্ভিস পরিচালিত হচ্ছে ।

আমাদের সার্কভক্ত দেশ পাকিস্তান যা এক সময় আমাদের দেশের মতো একই ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালের পর দীর্ঘদিন ধরে এই দেশের পুলিশ-ব্যবস্থা ভারতীয় পুলিশ আইনের অধীনে পরিচালিত হত। কিন্তু পাকিস্তান ২০০২ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক আইনকে বাতিল করে নতুন পুলিশ আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইন সর্বশেষ ২০০৬ সালে আরো যুগোপযোগি করা হয়েছে[২] ।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ঔপনিবেশিক পুলিশ আইনকে ভেঙ্গে চুরে একটি নতুন আইন পুলিশ প্রণয়নের রূপরেখা দিয়ে তা রাজ্যগুলোকে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনা মোতাবেক রাজ্যগুলো নতুন পুলিশ আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত রয়েছে। ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভারতের কেরালা রাজ্য একটি সম্পূর্ণ নতুন পুলিশ আইন গ্রহণ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের পুলিশ-ব্যবস্থায় কেরালা পুলিশ আইনটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন এবং বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে[৩]।

শ্রীলংকার পুলিশ আইনকে অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে পাশ করা হয় পুলিশ কমিশন আইন। এই আইনের বলে পুলিশের দেখভাল ও নিয়ন্ত্রণের ভার একটি সর্বদলীয়, স্বাধীন পুলিশ কমিশনের হাতে তুলে দেওয়া হয়[৪] ।

একই ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ব্রিটিশ গায়ানা প্রভৃতি সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর পুলিশ-ব্যবস্থাকে নতুন আইন দিয়ে স্বাধীন দেশের উপযোগী করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও রয়েছে সেই ঔপনিবেশিক আইন নিয়ে। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কোন আইনকেই আমরা পরিত্যাগ করতে পারছি না।

উল্লেখ্য, পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির কারিগরী ও আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের জন্য ২০০৭ সালে একটি খসড়া পুলিশ আইন তৈরি করা হয়েছিল। এই আইনের খসড়াটি বর্তমানে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এই আইনের পক্ষে বিপক্ষে থাকতে পারে হাজারো আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দীর কিনারে এসে, হয়তো এই সত্যটি কেউ অস্বীকার করবেন না, আমাদের জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বকীয় প্রেক্ষাপটে একটি যুগোপযুগী আইনে আমাদের পুলিশকে পরিচালনা করা বর্তমানে সময়ের দাবী।

রচনা সূত্রঃ
১.The Police Force Act of 1947 /The Police Act 1953, The Policing Act 2008
http://www.legislation.govt.nz/act/public/2008/0072/latest/whole.html
২. http://www.nrb.gov.pk/publications /Police_order_2002_with_amendment_ordinance_2006.pdf

৩.http://keralapolice.org/newsite/pdfs/kp_act/kerala_police_act_eng_2011.pdf

৪. http://www.npc.gov.lk/npc/index.php?lang=en