পিপার স্প্রে বিতর্ক নিতান্তই অহেতুক

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 Jan 2013, 06:08 PM
Updated : 16 Jan 2013, 06:08 PM

অবৈধ জনতার উপর মারাত্মক বল প্রয়োগ না করেই ছত্রভঙ্গ করার রীতি সার্বজনীন।বিশেষ করে নিরস্ত্র জনতা বা ব্যক্তির উপর লাঠিচার্জ কিংবা গুলি বর্ষণ করা কোন ক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়।

এমতাবস্থায়, কোন প্রকার হতাহত বা প্রাণহানীর ঘটনা না ঘটিয়ে পুলিশকে জনতা ছত্র ভঙ্গ করার জন্য বিশেষ কিছু কৌশল গ্রহণ এবং ক্ষেত্রমতে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর বা কোন ক্ষতিই করে না এমন ধরণের অস্ত্র প্রয়োগ করতে হয়। এই জাতীয় কৌশলের মধ্যে আছে মৌখিকভাবে সতর্কীকরণ, লাঠিচার্জ/ব্যাটন চার্জ করা, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ, জলকামান ব্যবহার, ফাঁকা গুলি করা এবং প্রয়োজন মতো রাবার বুলেট ব্যবহার করা।

অবৈধ জনতার উপর কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার একটি অতি পুরাতন জনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশী-অনুশীলন। কাঁদানে গ্যাস একটি রাসায়নিক দ্রব্য। এটাকে বলা হয় সিএস গ্যাস। এটা মূলত সায়ানোকার্বন জাতীয় জৈব পদার্থ। এই গ্যাস ব্যবহারের ফলে চোখ জ্বালা-পোড়া করে, চোখ দিয়ে পানি ঝরে এবং এর বেশি ব্যবহারে অন্য সমস্যাও হতে পারে যার মধ্যে হতে পারে শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্র কিংবা রেচন যন্ত্রের ক্ষতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান উত্তরাধুনিককাল পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এই সিএস-কাদানে গ্যাস ব্যবহার করে আসেছ। বৃটিশ-বঙ্গের পুলিশ থেকে শুরু করে আধুনিক বাঙগালি পুলিশের কাঁদানে গ্যাস খেতে আমরা অভ্যস্ত।

পেপার স্প্রে হল একটি অতি আধুনিক কাদানে গ্যাস। এর প্রধান উপাদান হল মরিচের গুড়া। এটার রাসায়নিক নাম হল ওসি গ্যাস। অবৈধ জনতা ছত্রভঙ্গ করার জন্য এই অস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশের কাছে নতুন হলেও বাংলাদেশের বাইরে এই গ্যাস সম্পূর্ণ নতুন নয়। পৃথিবীর অনেক দেশের পুলিশ সদস্যরা ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে ক্ষুদ্র অস্ত্র ও হ্যান্ডকাফের পাশাপাশি পেপার স্প্রেও সাথে বহন করেন। তবে আত্মরক্ষা ও অবৈধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার কাজেই এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। অবৈধ জনতার উপর লাঠি চার্জ না করে সামান্য যন্ত্রণার বিনিময়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করা যায়। এটা কাঁদানে গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। পেপার স্প্রে প্রয়োগের ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মতো চোখে দেখতে পারে না। ৩ থেকে ৫ মিনিট পর্যন্ত শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং প্রায় এক ঘন্টার মতো শরীরে যন্ত্রণা থাকে।

আমেরিকা ও পাশ্চাত্য দেশে পেপার স্প্রে প্রায় ১৫/২০ বছর পূর্ব থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু কিছু দেশে এর ব্যবহার পুলিশ তথা শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও অনেক দেশে শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ মানুষও হিংস্র পশু বা মনুষ্য শত্রু থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই স্প্রে সঙ্গে রাখতে পারে। কিছু কিছু দেশে সরকার থেকে সাধারণ লাইসেন্স বা প্রাক-পরিচয় যাচাই এর পর কেনার বা বহন করার বিধান থাকলেও অনেক দেশে খোলা বাজারে পেপার স্প্রে কিনতে পাওয়া যায়। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও পেপার স্প্রে অপরাধ-ইতিহাসহীন যে কেউ কিনতে ও বহন করতে পারে।

অনেকে মনে করেন রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাদের কথায় আংশিক সত্যতা রয়েছে। ১৯৯৭ সালে রাসায়নিক অস্ত্র কনভেনশনে যুদ্ধক্ষেত্রে কাদানে গ্যাসসহ যেকোন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ। এর কারণ হল এক পক্ষ কাদানে গ্যাস ব্যবহার করলে অন্যপক্ষ এর চেয়েও মারাত্ম রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। তাই সশস্ত্র বাহিনীর জন্য কাঁদানে গ্যাব ব্যবহার নিষিদ্ধ। তবে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহনিীর জন্য কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা কোন দিনই নিষিদ্ধ ছিল না।

বাংলাদেশে সম্ভবত চলতি জানুয়ারী মাসে বেসরকারী নন-এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের অনুমতিহীন সমাবেশ বা অবস্থান ধর্মঘট বানচাল করতেই সর্বপ্রথম পেপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়। আর এর প্রয়োগ ফলপ্রুসু হয়েছে বলেই অনুমিত হয়। এর বিরুদ্ধে যে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে তা নিতান্তই আটপৌরে ও সাধারণ মানুষের বক্তব্য। দেশের বাইরে যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে এই নিয়ে নানা প্রকারের তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে এর প্রয়োগের বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছিল। কিন্তু এই গ্যাস ব্যবহারের ধরণ সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দেওয়ার বাইরে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আদালত পিপার স্প্রেকে অবৈধ বা জন-স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর বলে রায় দেয় নাই।

তবে ভাল হত যদি বাংলাদেশে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়া যেত । বিদেশে তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেক হয়েছে, তাই বাংলাদেশের কেউ যদি এই গ্যাস পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে এ সম্পর্কে ভালমন্দ ব্যাখ্যা দিতেন তবেই বাদ-প্রতিবাদের মূল্য দেওয়া যেত।

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের বাজারে পিপার স্প্রে কিনতে পাওয়া যায় না। অন্য দিকে বাজারে সহজলভ্য হলেও ডিএমপি পুলিশ ইচ্ছেমত আজ বাজার কেনে নিয়ে এনে আগামীকাল কোন রাসায়নিক দ্রব্য জনতার উপর প্রয়োগ করতে পারে না। পুলিশ তথা যে কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কোন দ্রব্য/সেবা ক্রয় করতে হলে সুনির্দিষ্ট সরকারি ক্রয় নীতিমালা (পিপিপি) অনুসরণ করতে হয়। এর বাইরেও পুলিশকে তার ব্যবহার্য বস্তু সম্পর্কে পুলিশ প্রবিধানের আদেশ-নিষেধ পুরোপুরি মেনে চলতে হয়। এমনকি একটি বেতের লাঠির জন্যও পুলিশকে বিধিবদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে অগ্রসর হতে হয়। পুলিশ ইচ্ছে করলে জনতার উপর বাঁশের লাঠি প্রয়োগ করতে পারে না। সুনির্দিষ্ট দৈর্ঘ ও ব্যাসার্ধের বেতের লাঠি ছাড়া অন্য কোন লাঠি ব্যবহারের কোন অনুমতি নেই।

বলাবাহুল্য, আলোচিত পেপার স্প্রে বিধিমতো টেন্ডার দিয়ে অনেক আগেই কেনা হয়েছে। এই গ্যাস প্রয়োগের ফলে মানুষের কি ক্ষতি হতে পারে সেই সম্পর্কে সব দিক বিবেচনা না করে সরকার নিশ্চয়ই পুলিশকে এই গ্যাস প্রয়োগের অনুমতি দেয় নাই।

বেসরকারি নন-এমপিও ভূক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পেপার স্প্রে ব্যবহার না করে যদি পুলিশ লাঠি চার্জ করত তাহলে শিক্ষকরা আহত হত, হাসপাতালে যেত এবং তাদের কেউ কেউ মারাও যেতে পারত। পেপার স্প্রে তাদের এই অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছে। আর পুলিশ তথা সরকারও বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হয় নাই। অতএব, এই বিষয়ে অহেতুক বিতর্ক করা অবাঞ্ছনীয়।