গ্রেফতার, তদন্ত, জামিনঃ মন্তব্যের পূর্বে একটু তলিয়ে দেখি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 2 Feb 2013, 05:49 AM
Updated : 2 Feb 2013, 05:49 AM

বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনেই অনেকে আদালত সম্পর্কে বেসামাল মন্তব্য করে বসেন। আদালত সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে তাদের তদন্ত, গ্রেফতার, জামিন, মামলা রুজু, সাক্ষ্য গ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত না হলেও সাধারণ জ্ঞানলাভ করা দরকার। কারণ, আদালত সম্পর্কে লাগামহীন বিরূপ মন্তব্য মানুষকে দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতে পারে।

আদালতের দেয়া জামিন নিয়ে অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না, অভিযুক্তের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে জামিন অধিকার। কোন নাগরিককে দীর্ঘ দিন ধরে জেলখানায় বন্দি রাখার সপক্ষে রাষ্ট্র তথা পুলিশকে সন্তোষজনক কারণ উপস্থাপন করতে হয়। যথাযথ কারণ দেখাতে না পারলে কোন নাগরিককে বিচারের রায় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত হাজতে বন্দি রাখার আবেদন নাকচ হওয়াই স্বাভাবিক।

ধরা যাক, কোন ব্যক্তির প্রতি কোন ফৌজদারি অভিযোগ নিয়ে আসা হল। এই অভিযোগের বিচার চলল প্রায় দুই বছর ধরে। এই দুই বছর অভিযুক্তকে জেল হাজতে বন্দি রাখা হল। চূড়ান্ত বিচারে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেল। অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে আনিত ফৌজদারি অপরাধ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। অথবা এমনও হতে পারে ঐ অভিযোগ ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। এখন এই মিথ্যা অভিযোগের জন্য কোন লোককে দুই বছর জেলখানায় বন্দি রেখে যদি বিচার কার্য পরিচালনা করা হয়, আর সে বিচারের ফলাফল হয় অভিযুক্তের বেকসুর খালাস, তাহলে, এই নির্দোষ ব্যক্তির জীবন থেকে যে দুইটি বছর হারিয়ে গেল তার ক্ষতিপূরণ কে দিবে এবং কিভাবে দিবে? তাই, গ্রেফতার, তদন্ত, অভিযোগ গঠন ও বিচার প্রক্রিয়াকে অভিন্ন করে দেখা উচিত নয়।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ফৌজদারি অপরাধের বিচারের জন্য আদালতকে সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। গণচীনের বিচার ব্যবস্থা পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুততর সময়ে সম্পন্ন হয়। সেই দেশের ফৌজদারি আদালতের আইনে বলা হয়েছে, কোন মামলা আদালতে উপস্থাপনের এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে তার বিচার কার্য সম্পন্ন করতে হবে। তবে সেই দেশে এক-দেড় মাস নয়, মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পুরো বিচার কার্য সম্পন্ন করার নজিরও রয়েছে। একবার কুমিং প্রদেশে এক হংকংবাসী দম্পতিকে হেরোইনসহ পুলিশ গ্রেফতার করে। এই দম্পতি গ্রেফতার হবার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের বিচারকার্য সম্পন্ন করে তাদের মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকর করা হয়েছিল। তবে দ্রুত বিচারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। বলা হয়,Justice hurried, justice buried।

বাংলাদেশের আইনেও বিচারকার্য সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ অনেক বিশেষ আইনে তো বটেই এমনকি ফৌজদারি কার্যবিধির মতো আইনেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত ও বিচারকার্য পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত ও বিচারের সুনির্দিষ্টতা সর্বাংশে বাধ্যতামূলক নয়। এই ক্ষেত্রে আইনের বিধিগত শিথিলতা বা ফাঁকফোকর বেশ বড়। এখানে রয়েছে মামলার জট, বিচারকের স্বল্পতা, তদন্তের দুর্বলতা, তদন্তকারী কর্মকর্তার অপ্রতুলতা। অধিকন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার দরুন ফৌজদারি ব্যবস্থাকে বছরের অনেকগুলো দিন অঘোষিত কর্মবিরতি পালন করতে হয়। এমতাবস্থায়, মামলার তদন্ত চলতে পারে যুগ যুগ ধরে, আর বিচার কার্য চলতে পারে শতাব্দীকাল পর্যন্ত।

এই যে বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা কিংবা বিচার প্রক্রিয়া ও তদন্তের সাথে জড়িত সরকারি যন্ত্রসমূহের অযোগ্যতা বা জনবল স্বল্পতা এর জন্য কি কোন বিচারপ্রার্থী, তিনি হতে পারেন অভিযুক্ত, হতে পারেন বাদী, দায়ী? যদি বিচারপ্রার্থীগণ দায়ী নাই হন, তবে বিনা বিচারে তাদের আটক রাখা কি রাষ্ট্রের জন্য অমানবিক নয়?

প্রচার মাধ্যমের প্রাত্যহিক প্রতিবেদন সমূহে অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করে আমাদের অনেক নাগরিক ধরেই নেন যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় কিংবা যারা অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হন তারা বিতর্কহীনভাবে অপরাধী। তারা মনে করেন অপরাধীদের আবার অধিকার বা মানবাধিকার কী? বিভিন্ন মন্তব্যে অনেক অনাড়ী ব্যক্তি মন্তব্য করেন অপরাধীদের পক্ষে কোন আইনজীবী যেন না দাঁড়ান। কিন্তু আইনের ভাষায় এই জাতীয় মন্তব্য বা মানসিকতার কোন স্থান নেই।

পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে কোন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সাজা দেওয়ার কোন বিধান নেই। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত কোন তৃতীয় পক্ষকে তার জন্য ওকালতী করার অনুমতি না দিয়ে নিজেই নিজের পক্ষে যুক্তিতর্ক খণ্ডন করতে পারেন। তবে সব চেয়ে নিরাপদ ও বিজ্ঞতার কাজ হল একজন আইনজীবীকে নিয়োগ করা করা। যদি কোন অভিযুক্ত নিজ খরচে কোন আইনজীবী নিয়োগ দিতে অসামর্থ্য হন তবে সরকারি খরচে তার জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। এই নিয়ম সার্বজনীন। পৃথিবীর সব উন্মুক্ত বিচার ব্যবস্থার দেশেই এই সরকারি সাহায্য পাওয়া যায়।

আমাদের অনেকের ধারণা আদালত যেহেতু বাদীর আনিত অভিযোগের বিচার করেন তাই তিনি বাদীর প্রতি সহানুভূতিশীল আর আসামীর প্রতি অনুভূতিহীন। কিন্তু এই ধারণা মোটেই সঠিক নয়। আদালত শুধু সরকার বা পুলিশের আদালত নয়, আদালত চোরের জন্যও আদালত। আদালত কোন পক্ষের নয়, তিনি আইনের পক্ষের। আমাদের দেশের মতো 'কমল ল' ভূক্ত দেশ সমূহ যেখানে বিচার প্রক্রিয়া 'এডভার্সারিয়াল' পদ্ধিতে পরিচালিত হয়, সেখানে বিজ্ঞ আদালত একজন উচ্চমার্গের নিরপেক্ষ রেফারির ভূমিকা পালন করেন। আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিতিত্তে আইন যার দিকে, আদালতের রায়ও তার দিকে হবে। এক্ষেত্রে কোন অভিযুক্ত যদি বাস্তবে অপরাধের সাথে জড়িতও থাকে কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য সক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে, আইনের চোখে সেই অভিযুক্তকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে না।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন অংগ যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, বিশেষ করে, পুলিশ ও সরকারি প্রসিকিউশনের যোগ্যতা যদি প্রদর্শনযোগ্য না হয়, তাহলে অপরাধ করেও কেউ কেউ সাজা পেতে পারে। অন্যদিকে প্রসিকিউশনের অযোগ্যতায় নির্দোষ ব্যক্তিও সাজা পেতে পারেন। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার এই সম্ভাব্য এবং আমাদের দেশের মতো ফলিত অযোগ্যতার জন্য কোন নাগরিককে দীর্ঘ দিন ধরে বিচারহীনভাবে কারারুদ্ধ করে রাখা শুধু অমানবিকই নয়, অসভ্যতাও বটে। আইনের নীতি দ্রুত বিচার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। বিনা বিচারে দীর্ঘকাল কারাবাসের বিধান কোন সভ্য দেশের বিচার ব্যবস্থাই সমর্থন করতে পারে না।