রাজনীতি, পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থায় গণ-অনাস্থা জাতীয় দুর্যোগের নামান্তর

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 10 March 2014, 11:35 AM
Updated : 10 March 2014, 11:35 AM

আধুনিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিই হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের কাঠামোর উরপর রক্ত মাংসের প্রলেপ দেন রাজনীতিবিদগণ। রাজনীতিবিদগণ আইন তৈরি করেন। সেই আইনের ধড়ে আবার প্রাণের সঞ্চার করে পুলিশ বা আইন প্রযোগকারী সংস্থাগুলো। পুলিশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার উৎস মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ এক দিক দিয়ে কোন রাষ্ট্রের গোটা বিচার ব্যবস্থার দাররক্ষক কা গেইট কিপার অন্য দিকে সার্বক্ষণিক নানামুখি দায়িত্ব পালনে পুলিশ গোটা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে চলমান রাখে। অন্য দিকে রাজনীতিবিদগণ রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে পুলিশের জন্য নীতি নির্ধারণ করেন, পুলিশকে সচল রাখার জন্য বাজেট বরাদ্ধ করেন, তাদের সঠিক দায়িত্ব পালনে আদেশ-উপদেশ ও নির্দেশনা দান করেন। এমতাবস্থায়, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনীতিবিদ, পুলিশ আর বিচারকগণ একই সূত্রে গাঁথা একটি প্রয়োজনীয় পুঁতির মামলার মতো।

পুলিশ কোন দেশের জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার জীবন্ত প্রতীক। জাতি তার পুলিশ ব্যবস্থার উপর এমন বেশি আস্থা ও বিশ্বাস অর্পণ করে যে তাদের মান-সম্মান, স্বাধীনতা-স্বকীয়তার প্রায় সবটুকুই পুলিশের উপর ছেড়ে দিতে চায়। পুলিশ হল সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় শক্তির দৃশ্যমান বহিঃপ্রকাশ। এমন কূট-প্রশ্নও উত্থাপিত হয়ে থাকে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের একটি নগর পুলিশের সার্জেন্টের মধ্যে কে বেশি ক্ষমতাধর অর্থাৎ জনগণ কাকে বেশি ক্ষমতা অর্পণ করেছে? কিংবা জনগণ কাকে বেশি মান্য করে? কেউ কেউ বলবেন, আমেরিকার রাষ্ট্রপতিই অধিক ক্ষমতাবান ও মান্যবর। কারণ দৃশ্যত যাই হোক, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি শুধু আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রই নয়, সারা পৃথিবী পরিচালনা করেন। শুনেছি, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি তার সরকারি গোপনীয় ব্রিফকেইসে এমন একটি চাবি বহন করেন, যেটা একবার ঘুরান দিলে পৃথিবীতে পারমাণবিক যুদ্ধ, তারকাযুদ্ধ আর যা যা বলা যায়, সে জাতীয় সকল প্রকার অনিষ্ট শুরু হবে (১) । রিগান প্রশাসনের সময় রাষ্ট্রপতি রোনান্ড রিগান নাকি একবার বোতাম টিপে তৎকালীন ইউএসএসআর (রুশ যুক্তরাষ্ট্র) এর বিরুদ্ধে পারমাণবিক যুদ্ধের ঘোষণা দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কি ভেবে যেন রিগান একটু সময় নিলেন। এর মাঝে নতুন খবর এলো। না, অবস্থা যুদ্ধে যাওয়ার মতো নয়। রিগান বোতাম টিপলেন না। সারা পৃথিবী প্রথম বারের মতো নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেল।
অর্থাৎ সারা পৃথিবীকে ধ্বংস করার মতো ক্ষমতার প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখন পর্যন্ত করেননি। আর ভবিষ্যতে করবেন বলেও মনে হয় না। কারণ, যে বিশ্বে আমেরিকানরা নিজেও বসবাস করেন, যে বিশ্বকে নিয়েই তাদের রাজনীতি, সেই এক মাত্র বসবাসযোগ্য পৃথিবীকেই তারা ধ্বংস করবেন, এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত তারা কোন দিনই নিবেন না। এ যেন শ্রীকৃঞ্চের প্রতি অর্জুনের আকুতি: আমরা যাদের জন্য রাজ্য, ভোগ, সুখাদি কামনা করি, তারাই অর্থ ও প্রাণের আশা ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য উপস্থিত। হে মধুসূদন! আমাকে বধ করতে উদ্যত হলেও অথবা ত্রিলোকের রাজত্বের জন্য হলেও আমি এদের বধ করতে চাই না, পৃথিবীর রাজত্বের তো কথাই নেই (২) ।

। তাই যতই যুদ্ধের জুজুর কথা বলি না কেন, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি সারা বিশ্বকে ধ্বংস করার মতো কোন যুদ্ধের ঘোষণা দিবেন না। তাই কাগজে কলমে রাষ্ট্রপতি যতই শক্তিশালী হোন না কেন, বাস্তবে তিনি সেই শক্তির প্রয়োগের সুযোগই পান না।

কিন্তু আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের রাসত্মার পুলিশটিকে দেখুন। জনগণ যে ক্ষমতা তার পুলিশ বাহিনীকে অর্পণ করেছে, পুলিশ প্রতি নিয়তই তার প্রয়োগ করছে; অপপ্রয়োগও করছে। রাস্তার পুলিশ কনস্টেবলটি আপনাকে বলতে পারে, এই পথে যাবেন না। সে যে কোন সময় আপনার বিএমডাব্লিউ গাড়িটি আটক করে দিতে পারে। সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যক্তিটি থেকে শুরু করে রাস্তার ভিক্ষুকটি পর্যন্ত তাই পুলিশের আদেশ নিষেধ মেনে নেয়। পুলিশ যা করতে বলে, তারা তা করে, পুলিশ যা করতে নিষেধ করে, পারত পক্ষে, তারা তা করেন না। এই যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্যকে দিয়ে নিজের মতো করে নিজেদের বা অপরের কাজ করানো বা করতে বাধ্য করা অর্থাৎ অন্যের আচরণকে নিজেদের ইচ্ছার অনুরূপে পরিচালিত করা — এটাই আসলে ক্ষমতা। কোন দেশের রাষ্ট্রপতি তার ইচ্ছা দিয়ে দেশের প্রতিটি মানুষের আচরণ পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু তা সব সময় ঘটে না; তা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রকটরূপে প্রষ্ফুটিত হয়ও না। কিন্তু রাস্তার মোড়ের ট্রাফিক পুলিশটির ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় দেশের নাগরিকগণ প্রতিনিয়তই আত্মসমর্পণ করেন। তাই সূর্যাপেক্ষা কোটিগুণ তাপ ও আলোর অধিকারী হাজারো জ্যোতিষ্কের চেয়ে আমাদের সবচেয়ে কাছের মাঝারি ধরনের একমাত্র সূর্যটিই আমাদের কাছে নিত্যপূজ্য, যুগযুগান্তরের আরাধ্য। সূর্যই আমাদের কাছে অমিত তেজা- রিগেল কিংবা ভিওয়াই কেনিস মেজোরিস নয় (৩)।

পুলিশ হল আমাদের কাছে মাঝারি ধরনের একটি সরকারি শক্তি। পুলিশ আইন তৈরি করে না, আইনের ব্যাখ্যা করতে পারে না; সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করতে পারে না কিংবা সরকাকে ক্ষমতায় আনতেও পারে না। আইন-বিধি অনুশাসনে পুলিশ সব সময় হাত পা বাঁধা। কিন্তু তাই বলে কি পুলিশকে উপেক্ষা করার সাহস আমাদের আছে? আমরা কি পুলিশের আদেশ, নিষেধ আর সতর্কবাণীকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেই না? আমাদের স্বাধীন চলাফেরা, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের কৌশল, একত্রিত হবার সাংবিধানিক অধিকারগুলো পুলিশের জিম্মায় দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছি। যে সমাবেশ, মিছিল, মিটিং আর অনুষ্ঠানের অধিকার খোদ সংবিধান আমাদের দিয়েছে, সেই অধিকার চর্চা করতে গেলে দেশের সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলকেও মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। সাংবিধানিক অধিকারকে মহানগর পুলিশ কমিশনার সাময়িকভাবে হলে স্তব্ধ করতে পারে। এটা তার আইনী এখতিয়ার। তিনি কারফিউ জারির মাধ্যমে মানুষকে তাদের ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে গণস্থানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে পারেন। এমনকি কোন নাগরিককে পুলিশ কমিশনার তার মেট্রোপলিটন অধীক্ষেত্র থেকে বহিষ্কার করতে পারেন, তাকে তার অধীক্ষেত্রে প্রবেশের উপর শর্তারোপ করতে পারেন। আর শর্তভঙ্গের অপরাধে বিনাপরোয়ানায় তাকে গ্রেফতারও করতে পারেন (৪) ।

কিন্তু যে পুলিশের প্রতি সাংবিধানিক অধিকার ও ক্ষমতাগুলোর সুরক্ষার ভার আমরা দিয়েছি, যে পুলিশের আদেশে আমরা বাড়ির বাইরে যাওয়া, সমবেত হওয়া, ইচ্ছে মতো রাস্তা দিয়ে পথ চলা বন্ধ করি; যে পুলিশের আদেশে আমরা গভীর রাতে আমাদের শয়ন কক্ষ পর্যন্ত তলস্নাসির জন্য খুলে দেই, সেই পুলিশকে আমরা বিশ্বাস করি না। পুলিশের প্রতি আমাদের আস্থা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে।

হ্যাঁ, আমি বলতে চাচ্ছি সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার(পিপিআরসি) নামের একটি গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে। বাংলাদেশ ২০১৩: সুশাসন প্রবণতা ও ধারণাসমূহ' শীর্ষক গবেষণায় পিপিআরসি দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি, পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি দ্রুত আস্থা হারাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আস্থাহীনতার কৃঞ্চ গহব্বরে প্রবেশের গতির দ্রুততায় এ সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাজনীতিবিদগণ, তার পরে আছে পুলিশ ও তৃতীয় অবস্থানে আছে বিচার বিভাগ/ব্যবস্থা।

খানা জরিপের মাধ্যমে তারা দেখিয়েছেন দেশের ৭৫.৬ মানুষ মনে করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থা কমেছে। ৭১.২ শতাংশ মানুষের আস্থা কমেছে পুলিশের প্রতি। আর বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমেছে ৫৩.৪ শতাংশ মানুষের। পিপিআরসি র‌্যাবকে আলাদাভাবে জরিপ করেছে এবং তাদের জরিপে এসেছে র‌্যাবের প্রতি দেশের ২৬.৮ শতাংশ মানুষের আস্থা কমেছে। পিপিআরসির জরিপ মতে, দেশের ৭০.৯ শতাংশ মানুষ অপরাধের প্রতিকারই চায় না। বাকী ২৯.৩ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৩.৪ শতাংশ পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যান (৫) ।

কোন জাতির অধঃপতনের ধারাকে পরিমাপ করতে হলে তার বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের অধোঃগতির ধারাকে পরিমাপ করা হয়। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর প্রতি আস্থা হারালে মানুষের ইহজগতে আর হারাবার মতো তেমন কিছু থাকে না। এই আস্থা হারানোর প্রথমেই আসে বিচার ব্যবস্থা। দেশের বিচার বিভাগ যদি সঠিক বিচার দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই বিচারের আপীল চলে যায় স্রষ্টার কাছে। গণতান্ত্রিক দেশের সার্বভৌমত্বের সারিতে বিচারকদের স্থান স্রষ্টার পরেই। এখন কোন দেশের অর্ধেরকও বেশি মানুষ যদি মনে করে তারা বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখেন না বা রাখতে পারছেন না, তাহলে আমাদের দেশের, জাতির আর জনগণের সার্বভৌমত্ব থাকল কোথায়? বিচারের আপীল যদি বিচার ব্যবস্থার বাইরে চলে যায়, তাহলে আমাদের জাতির আর আশ্বস্ত হবার কি আছে?

অন্যদিকে দেশ পরিচালনার পুরো ভার ন্যাস্ত থাকে রাষ্ট্রের সরকারের উপর। গণতান্ত্রিক দেশের সরকার চালায় রাজনীতিবিদগণ। দেশের অভ্যন্তরে যত প্রতিষ্ঠানই থাকে সেগুলো কোন না কোনভাবে সরকারের আজ্ঞাধীন। আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি উপাঙ্গ যেমন, সরকার (নির্বাহী বিভাগ), আইন বিভাগ (সংসদ) ও বিচার বিভাগ নিজ নিজ বলয়ে স্বাধীন হলেও সরকার থাকে এর কেন্দ্রে । সংসদ কর্তৃক পাশ করা আইন প্রয়োগ করে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগের আদেশ নিষেধ পালন করে নির্বাহী বিভাগ। তাই অন্য দুটি বিভাগের বাস্তব অস্তিত্ব নির্ভর করে নির্বাহী বিভাগের আচরণের উপর। আর এই নির্বাহী বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতিবিদগণ। কিন্তু এই রাজনীতিবিদগণই যদি দেশের মানুষের অনাস্থার পাত্র হন, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা যাচ্ছি কোথায়? দেশের মানুষের বিশ্বাসের ত্রিমাত্রিক স্তর আজ একই সাথে কীটদষ্ট হয়েছে। পুলিশ, সরকার আর আদালতের প্রতি যদি আমাদের আস্থা না থাকে তাহলে আমাদের গোটা জাতিই আজ আস্থাহীনতার নৌকার যাত্রী।

যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতে চাই সিপিআরসির গবেষণায় ভুল আছে। কেননা, আমি আস্থাশীল হতে চাই আমাদের রাজনীতি, পুলিশ আর বিচার বিভাগের উপর। কিন্তু আমার এই অন্তরের চাওয়া বাস্তবের সাথে নিতান্তই সাংঘর্ষিক। কারণ, আমার ব্যক্তি, পেশা ও সামাজিক অভিজ্ঞতাগুলোর তিল তিল সমাহার তো এই গবেষণাপত্রকেই সমর্থন করে। তাই আমরা একটি পরিপূর্ণ জাতীয় দুর্যোগের দিকেই অগ্রসর হচ্ছি।

সূত্রঃ
১. Police Brutality: Current Controversies; Edited by William Dudely; Greenhaven Press. Inc .p-77
২. শ্রীমতৎ ভগবৎ গীতা, শ্লোক ৩৩ ও ৩৫
৩.http://en.wikipedia.org/wiki/Alpha_Centauri_A#Names;
http://space.about.com/od/stars/tp/The-Top-10-Largest-Stars.htm
৪. ঢাকা মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশের ৩৯ থেকে ৪৫ ধারায় বিস্তারিত দেখুন
৫. Prothom Alo 16 February, ২০১৪