আধুনিক পুলিশিং ধারণায় তৃণমূল পর্যায়ের পুলিশ হল নাগরিকদের Home Physician বা গৃহ চিকিৎসকের মতো। গৃহ চিকিৎসকগণ তাদের রোগীদের শুধু চিকিৎসাপত্রই দেন না, তারা সুখে-দুঃখে তাদের রোগীদের পাশে থাকেন, রাত-বিরাতে তারা রোগীর বাড়িতে গিয়ে মুমূর্ষু রোগীর পাশে সময় কাটান। চাইলেই হাতের কাছে গৃহ-চিকৎসককে পাওয়া যায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ তেমনটি নন। তারা রোগীদের হাতের কাছে বসবাস করেন না। তাদের চাইলেই কাছে পাওয়া যায় না। ১০/১৫ দিন, এমনকি এক বছর আগে সিরিয়াল দিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে হয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অনেক দূরের ডাক্তার, অনেক ব্যয়ের ডাক্তারও বটে।
তাই মানুষের নির্ভরতা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরে উপর নয়, গৃহ চিকিৎসকদের উপরই। গৃহ চিকিৎসক যদি অভিজ্ঞ বা ভাল চিকিৎসক হন তবে রোগীকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে অনভিজ্ঞ, আনাড়ী গৃহচিকিৎসকের পাল্লায় পড়লে সাধারণ ডায়োরিয়ার রোগীও অল্প সময়ের মধ্যে কাহিল হয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেন। রোগের প্রতিরোধ বা প্রতিকার হয় সাধারণ গৃহ ডাক্তারদের চিকিৎসাপত্র, উপদেশ ও সময় মতো রোগীকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগীকে সম্পূর্ণ পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারেন না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ রোগ সারাতে চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদের কিচিৎসা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তারা রোগ সরাতে রোগীকে কাটাছেঁড়া করেন। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীর মৃত্যুর হার বেশি।
স্থানীয় পুলিশ বিশেষজ্ঞ ডাকার নয়, গৃহ ডাক্তারের মতো। এরা জনগণের জন্য গৃহ চিকিৎকদের মতোই নিত্য প্রয়োজনীয়, এরা সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখের সাথী। তাদের বন্ধু, প্রতিবেশী। তাই স্থানীয় পুলিশকে দক্ষ, সৎ, প্রশিক্ষিত ও মানবিক করতে না পারলে উচ্চ পর্যায়ের যতই এলিট পুলিশ তৈরি করা হোক, আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বা বিচার ব্যবস্থার কোন উন্নতীই হবে না।
আধুনিক পুলিশিং এর মূলনীতি হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধার্থে অপরাধমূলক সমস্যার সমাধান। কিন্তু অপরাধ সমস্যার মূল নিহিত থাকে স্থানীয় পর্যায়ে । তাই স্থানীয় পর্যায়ের পুলিশকে সমস্যা সমাধানের জন্য যোগ্য করে তুলতে না পারলে উচ্চ পর্যারে কোন পদক্ষেপই কার্যকর বা ফলপ্রুসু হবে না। কোন রাষ্ট্র যদি তার আমজনতার দৈনন্দিন সুখে-দুঃখে কাছে পাওয়ার পর্যায়ভুক্ত স্থানীয় পুলিশের উপর গুরুত্ব না দিয়ে শুধু উচ্চ পর্যায়ের এলিট ফোর্স তৈরির কাজে অর্থ বিনিয়োগ করতে থাকে, তবে তারা কোন দিনই একটি নিরাপদ সমাজ গঠন করতে পারবে না। তাই বাংলাদেশের থানা পুলিশকে সহায়-সম্পদ, জনবল, প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ও কার্যকরী করে তুলতে না পারলে নিরাপদ বাংলাদেশ গঠন সম্ভব হবে না। (আগস্ট ১৭ ২০১৩)
আব্দুল মোনেম বলেছেনঃ
আব্দুর রাজ্জাক ভাই,
পুলিশের প্রধান কাজ হতে হবে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ, সহযোগিতাপূর্ণ, আস্থাপূর্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। একটি আদর্শ সমাজে ফৌজদারি অপরাধ দমনে পুলিশের প্রয়োজন পড়বে না, কারণ সেখানে সেরকম অপরাধ এমন মাত্রায় সংঘটিতই হবে না যার জন্য পুলিশ প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু সেই সমাজেও পুলিশকে যদি থাকতে হয় তবে প্রথমে উল্লেখিত কাজটির জন্যই থাকতে হবে। এখনও যদি পুলিশের প্রধান কাজ সেটিই হয় তবে অপরাধ কমতে থাকবে; পুলিশই সমাজে নৈতিক শিক্ষা ও আত্মসচেতনতা বিকাশে বাস্তব শিক্ষকের ভূমিকায় চলে আসবে—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে থাকবে নৈতিকতার তাত্ত্বিক শিক্ষালয়। বিরোধের সূচনাটি প্রোএকটিভ ভাবে চিহ্নিত করতে পারলে ও সম্পর্কের অবনতি ঘটার আগেই সকল পক্ষের সাথে কথা বলা, মধ্যস্থতা করা গেলে, তার একটি বড় মাপের বাস্তব উপকার হয় বলেই আমার ধারণা। এবিষয়ে আপনার ভাল অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। তবে আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে হয়তো পৌঁছেছে যেখানে ডায়ালগ, নেগোসিয়েশন কেউই মানেন না, মানাটাও ভান মাত্র। তবুও পুলিশ ফেয়ার, দক্ষ ও আন্তরিক নেগোশিয়েটর হয়ে উঠতে পারলে উপকার পাওয়া যাবে। এপর্যন্ত আমার কথা আপনি যা বলেছেন তারই নকল মাত্র।
কিন্তু যে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যটা, সামাজিক এলিটদের আত্মরক্ষার চিন্তাটা প্রকট হয়ে উঠে সে সমাজে সবকিছুই বৃত্তাবদ্ধ হয়ে যায়; সবকিছুই কেমন যেন গুলিয়ে যায়—তখন এলিট ফোর্স কাজে লাগে। তারপরও স্বপ্ন দেখতে তো আর বাধা নেই। কবে সেই সমাজ আসবে যে সমাজের মানুষ তাদের অভিধানে লিখবে “এককালে ‘এলিট’ শব্দটির ব্যবহার থাকলেও এখন এর ব্যবহার পরিত্যক্ত হয়েছে”। সেই সভ্য সমাজের জন্য আপনার ও আমাদের সকলের চিন্তা ও চেষ্টা সচল থাকবে—এই আশা।